আবদুল্লাহ আল মোহন
‘‘আজি এ ঊষার পুণ্য লগনে উদিছে নবীন সূর্য গগনে’’
১.
শুভ নববর্ষ। বিদায় বাংলা ১৪২৬। সুস্বাগতম ১৪২৭। আজ বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন। পহেলা বৈশাখের প্রথম প্রভাতের অগ্নিচ্ছটায় বাংলার দিক-দিগন্ত উদ্ভাসিত আজ। আকাশ-বাতাস ও প্রকৃতিকে অগ্নিস্নানে শূচি করে তুলতে আবার এসেছে বৈশাখ। তাই ‘আজি এ ঊষার পুণ্য লগনে, উদিছে নবীন সূর্য গগনে।’ আসুন আমাদের সকলের আজকের শপথ হোক- ‘নববর্ষে প্রিয়জনকে বই উপহার দিন’। নতুন সনকে স্বাগত জানিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে তার হাজার বছরের ঐতিহ্য ধারণ করে। এই নবপ্রভাতে প্রার্থনা: যা কিছু ক্লেদাক্ত, গ্লাণিময়, যা কিছু জীর্ণ-বিশীর্ণ-দীর্ণ, যা কিছু পুরাতন তা বৈশাখের রুদ্র দহনে পুড়ে হোক ছাই। গ্রীষ্মের এই তাপস-নিঃশ্বাস বায়ে পুরাতন বৎসরের সব নিষ্ফল সঞ্চয় উড়ে যাক, দূরে যাক, যাক দূর-দিগন্তে মিলিয়ে। বর্ষবরণের উৎসবের আমেজে মুখরিত আজ বাংলার চারিদিক। এই বৈশাখে অগ্নিবরণ নাগ-নাগিনীপুঞ্জ বুঝিবা তাদের সঞ্চিত বিষ উগরে দিচ্ছে বাংলার ভূ-প্রকৃতিতে। ‘তাপস নিঃশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে উড়ায়ে’ দিতে প্রভাতের আলোকচ্ছটায় আবহমান এ বাংলার দিক-দিগন্ত উদ্ভাসিত করে আজ এলো নতুন দিন। ‘দুরান্তের পলাতক বলাকার ঝাঁকে’ হারিয়ে গেল পুরাতন বছর। সকলের মতোনই আশাকরি- পুরাতন বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক যাক। বর্ষবরণের উৎসবের আমেজে মুখরিত আজ বাংলার চারদিক। নতুনের আবাহনে কবিগুরুর সেই চিরায়ত সুর বাঙালির প্রাণে প্রাণে অনুরণন তুলবে : এসো হে বৈশাখ এসো এসো . . .। গ্রীষ্মের অগ্নিজিহ্বা বাংলার বাতাসে ভূ-প্রকৃতিতে লকলক করে নেচে উঠবে। বসন্তের সুধাভরা মদির রূপমাধুরীকে বিবর্ণ করে দিয়ে গ্রীষ্ম তার উদগ্র থাবা মেলে ধরবে আবার প্রকৃতিতে। প্রকৃতিতে জাগবে প্রলয় নাচন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়: বৈশাখে বিদ্যুৎ-চঞ্চুবিদ্ধ দিগন্তকে ছিনিয়ে নিতে আসা কালো শ্যেনপাখীর মতো প্রলয়ংকরী ঝড় ধেয়ে আসবে বাংলার গ্রামে-গঞ্জে নগরে-বন্দরে। গ্রীষ্মের অগ্নিবাণে প্রাণী, বৃক্ষ, লতা গুল্ম, মৃত্তিকায় জাগে তৃষ্ণা। সেই আকুল নিদাঘ তিয়াষা ঘুচাতে বজ্রের রথে চেপে আসে প্রলয়ংকরী কালবৈশাখী। ঘনকৃষ্ণ মেঘরাশির গুরুগম্ভীর গর্জনে আকাশ যেন ভেঙ্গে পড়ে জলপ্রপাতের ছন্দোময় বর্ষণ ধারায়। বাংলার প্রকৃতি আবার হয়ে উঠবে উর্বর সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা। “তোরা সব জয়ধ্বনি কর / তোরা সব জয়ধ্বনি কর / ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কাল বোশেখীর ঝড়”. . . কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই সুর ধ্বনির ভেতর দিয়েই বাঙালি নতুন বছরে সব অপ্রাপ্তি ভুলে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে । ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা’ পুরনো ব্যর্থতাকে বিদায় জানিয়ে নতুনের প্রত্যাশায় আজ বাঙালির সার্বজনীন প্রাণের উৎসব; বাংলা নতুন বছর -পহেলা বৈশাখ । নববর্ষের এ উৎসব বাঙালির অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের বিমূর্ত প্রতিচ্ছবি। তবে অবরুদ্ধ এই করোনাকালে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, আদিবাসী সকলে মিলে দেশজুড়ে আজ মেতে উঠবে না এবার এ উৎসবে। যান্ত্রিক নগর জীবনে অভ্যস্ত নগরবাসী অন্তত আজকের এই দিনটির জন্য হলেও সাজসজ্জায় পোশাকেও বের হবে না বাঙালি। প্রযুক্তির দাপটে এ যুগে ব্যবসায়ীরা এ দিনে এখনও সাড়ম্বরে আয়োজন করে ‘শুভ হালখাতা’। যা বাঙালির চিরন্তন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বহি:প্রকাশ। গতকাল চৈত্রের শেষ সূর্য পশ্চিম সাগর তীরে অস্তমিত হবার সাথে সাথে বিদায় নিয়েছে ১৪২৬। নবপ্রভাতের দুরন্ত ঝঞ্ঝার কাঁধে ভর করে বাঙালির জীবনে চারদিকে নতুনের কেতন উড়িয়ে এসেছে বৈশাখ। বৈশাখের আগমনীর মধ্য দিয়ে প্রকৃতিতে জাগবে প্রলয় নাচন। বাতাস পাবে উদ্দামতা, প্রকৃতি হয়ে উঠবে রুক্ষ্ম, আকাশে ঝলকাবে বিদ্যুৎবহ্নি ঈশান-দুয়ার খুলে পশ্চিমা ঝড় দৈত্য সৈন্যের মত ধেয়ে আসবে বাংলার জনপদে-বসতিতে। বাংলার প্রকৃতিতে বৈশাখ আসে সকল ভ্রুকুটিকে গ্রাহ্য করে সকল দীনতা হীনতা নিংড়ে শুষে আস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করতে। বৈশাখ আসে তার তাপস নিঃশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুকে উড়িয়ে দিতে। বৈশাখের পদার্পণের মধ্য দিয়ে ষড়ঋতুর এই বাংলায় নামে গ্রীষ্মের খরতাপ। গ্রীষ্মের সে অগ্নিবাণে প্রাণী, বৃক্ষ-লতা-গুল্ম, মৃত্তিকায় জাগে তৃষ্ণা। সেই আকুল ‘নিদাঘ তিয়াষা’ ঘুচাতে বজ্রের রথে চেপে আসে প্রলয়ংকরী কালবৈশাখী। আকাশ যেন ভেঙ্গে পড়ে জলপ্রপাতের ছন্দোময় বর্ষণ ধারায়। ড. আলাউদ্দিন আল আজাদের ভাষায়- বাংলা কৃষ্টি ও সংস্কৃতির জাদুকরি দিনটি পহেলা বৈশাখ এসে দেখা দিলে আমি কেমন যেন বৈতাল হয়ে যাই। তিনি আরো বলেছেন- বাংলা সন, মাস, বছর বিশাল বঙ্গভূণ্ডের নিজস্ব ভূগোল এবং তাতে সম্পৃক্ত গণঅভিজ্ঞতা ও চেতনা থেকেই উৎপন্ন হয়েছিল- এটা অন্য কোনো জাতির বর্হিপ্রভাব নয়। বাংলা সনের সাথে আমাদের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, কৃষি ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সম্পর্ক গভীর। আবহমানকাল ধরে গ্রাম-বাংলার জনগণের সাথে বাংলা সনের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। প্রাত্যহিক জীবনের সাথে বাংলা সন ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে। বাংলা সন বাঙালীর ঐতিহ্য ও চেতনায় নতুন করে বারি সিঞ্চন করে, সিক্ত করে চেতনার ভাবাবেগকে। বাংলা নববর্ষ সবাইকে নবউদ্দীপনায় উদ্বুদ্ধ করে, অনুপ্রেরণা যোগায় দৃঢ় প্রত্যয়ে কাজ করার।
২.
শেকড়ের সন্ধানে –
বাংলা নববর্ষ পালনের সূচনা হয় মুঘল সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে। তখন এ উৎসব পালিত হতো ঋতুধর্মী উৎসব হিসাবে। এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল কৃষিকাজ। এ সময় কৃষকেরা চৈত্র মাসের শেষ দিন পর্যন্ত জমির খাজনা পরিশোধ করতেন। পরদিন তথা নববর্ষের প্রথমদিন পহেলা বৈশাখ ভূ-স্বামী ও জমিদাররা তাদের মিষ্টিমুখ করাতেন। একে বলা হতো পূণ্যাহ। এরপর ইংরেজ গেল, জমিদার গেল এবং তাদের জমিদারি গেল। পূণ্যাহ প্রথার বিলোপ ঘটল, অভিষিক্ত হলো বিশ্বকবির মিলনোৎসবের ধারণা। এ উৎসবের সাথে এল মেলা ও অন্যান্য অনুষ্ঠান। ক্রমান্বয়ে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের সঙ্গে দ্রবীভূত হয়ে বাড়তে থাকল পহেলা বৈশাখের পরিসর। বাংলা নববর্ষের ইতিহাস বা ঐতিহ্যের সূচনা হয় নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখে ‘বঙ্গাব্দ’ সনের প্রবর্তনের সময় থেকেই। ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ মোগল সাম্রাজ্যভুক্ত হয় এবং এ অঞ্চলের নাম হয় ‘সুবে-বাংলা’। ‘সুবে বাংলা’য় বাংলা সনের প্রবর্তন সম্রাট আকবরের এক অসামান্য কীর্তি। এর আগে এ অঞ্চলে প্রবর্তিত ছিল হিজরি সাল। ৫৯৮ হিজরি মোতাবেক ১২০১ খ্রিস্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির বঙ্গ বিজয়ের মাধ্যমে এই অঞ্চলে যেমন মুসলিম শাসনের সূচনা হয়, তেমনি হিজরি সাল রাষ্ট্রীয় মর্যাদা লাভ করে। ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক ৯৬৩ হিজরিতে মুঘল বাদশাহ আকবর মসনদে অধিষ্ঠিত হন। রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে চান্দ্র বছর হিজরির পরিবর্তে একটি সৌর সাল উদ্ভাবনের লক্ষ্যে তখনকার দিনের প্রখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজীকে দায়িত্ব দেন। তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে, হিজরি সালের অবয়বকে ঠিক রেখে, বর্ষ গণনা ৩৫৪ দিনের পরিবর্তে ৩৬৫ দিন ধার্য করে ১৫৮৪ সালে বাদশাহ আকবরের কাছে পেশ করেন। প্রথমে এ বর্ষপঞ্জির নামকরণ করা হয় ‘তারিখ-ই-এলাহী’। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ বা ১১ মার্চ এটি বঙ্গাব্দ নামে প্রচলিত হয়। আকবরের রাজত্বের ঊনত্রিশতম বর্ষে প্রবর্তিত হলেও বঙ্গাব্দ গণনা করা হয় ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৫ নভেম্বর থেকে। এ তারিখে দ্বিতীয় পানিপথের যুদ্ধে হিমুকে পরাজিত করে আকবর সিংহাসনে আরোহণ করেন। ‘তারিখ-ই-এলাহী’র উদ্দেশ্য ছিল আকবরের বিজয়কে মহিমান্বিত করা ও পদ্ধতিগতভাবে রাজস্ব আদায় করা। তার নির্দেশে তৎকালীন খ্যাতিমান জ্যোতির্বিদ আমির ফতেউল্লাহ সিরাজীর চেষ্টায় বাংলাবর্ষের ৯৬৩ অব্দের সূত্রপাত হয়। হিজরি সালের প্রথম দিন পহেলা মহররমের বদলে বাংলা সালের সূচনা হয় পহেলা বৈশাখ থেকে। ফলে হিজরি সালের সৌর রূপ বাংলা সাল ইসলামী উত্তরাধিকার ধারণ করে পথপরিক্রমা শুরু করে। প্রসঙ্গত বলা যায়, ঐতিহাসিক আবুল ফজলের বাংলা সন প্রবর্তনের আগেও বঙ্গদেশে লক্ষণ সন প্রচলিত ছিল, ‘আকবরনামা’য় এর উল্লেখও পাওয়া যায়। একই সঙ্গে আমাদের আরেকটি কথা স্মরণ রাখতে হবে যে, সম্রাট আকবরের আগে ভারতবর্ষে সৌর বৎসরের প্রচলন থাকলেও কার্যত সৌর মাসের প্রচলন ছিল না। প্রখ্যাত লোকগবেষক শামসুজ্জামান খান উল্লেখ করেন, ‘বাংলা সন প্রবর্তিত হওয়ার পর প্রাচীন বাঙালির উৎসব-অনুষ্ঠান, মেলা, লৌকিক খেলাধুলা, হালখাতা, পুণ্যাহ প্রভৃতি এ সনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ব্যাপারে কোনো বাধা সৃষ্টি হয়নি। অর্থাৎ বাঙালির লোকজীবনের সাংস্কৃতিক ধারাকে বাংলা সন বিচ্ছিন্নতা না করে বরং জোরদার করেছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘বাংলাদেশের মৌল সাংস্কৃতিক উপাদানের সঙ্গে বাংলাসন ওতপ্রোতভাবে মিলে গেছে বলেই এই সন আমাদের বৃহত্তর সামাজিক জীবনে এক নতুন সচলতার সৃষ্টি করেছে।’ শুভ নববর্ষ মূলত একটি ঐতিহ্য। বাংলাদেশের নানাদিকের সাংস্কৃতিক স্রোতধারা এ ঐতিহ্য নির্মাণ করেছে। ড. মুহম্মদ এনামুল হকের কথায়ও এর সমর্থৃন পাওয়া যায়। তিনি বলেছেন, ‘পৃথিবীর সর্বত্র ‘নববর্ষ’ একটি ট্রেডিশন, একটি ঐতিহ্য। এটি আবার এমন এক ঐতিহ্য, যার বয়সের কোনো গাছ-পাথর নেই। গোড়ায় কোনো সুনির্দিষ্ট বছরের সঙ্গেও এর কোনো যোগ ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না অথচ যে কোনো বছরের প্রথম দিনটি ‘নববর্ষ’ নামে পরিচিত হয়ে আসছে। এর মানে এই নয় যে, দিনটিই নতুন বছর বরং এর মানে হচ্ছে- নতুন বছরের আগমন উপলক্ষে অনুষ্ঠিতব্য উৎসবের প্রথম দিন। প্রকৃতপক্ষে ‘নববর্ষ’ একটি নির্দিষ্ট উৎসবের দিন।’ বাংলা সন প্রবর্তনের ফলে বঙ্গদেশে কৃষিজীবী সমাজে কাজের অনেক সুবিধা হয়। সম্রাটের সুবিধা হয় খাজনা আদায়ে। বঙ্গদেশে খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্যই আকবর এ বাংলা সনের প্রবর্তন করেছিলেন অন্যান্য সনকে উপেক্ষা করে। ফলে এই সনের সঙ্গে বাংলার কৃষিজীবী জনপদের একটি নিবিড় ও গভীর সম্পর্ক স্থাপিত হয়। কেননা ‘কৃষি এ অঞ্চলের মানুষের জীবনের প্রধান অবলম্বন হওয়ায় বাঙলা সন সাধারণ মানুষের নিত্যকর্ম ও রুটি-রুজির সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। কারণ উৎপাদন ব্যবস্থা সভ্যতার একটি অঙ্গ। বাঙলা সন সেই মূল শেকড়ের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে রয়েছে।’
৩.
বাংলা বর্ষপঞ্জির ইতিকথা-
বাংলা বারো মাসের নাম নক্ষত্রের সঙ্গে মিলিয়ে করা হয়। বিশাখা নক্ষত্রের নাম থেকে বৈশাখ, জাইষ্ঠা থেকে জ্যৈষ্ঠ, সার থেকে আষাঢ়, শ্রাবণী থেকে শ্রাবণ, ভাদ্রপতা থেকে ভাদ্র, অশ্বিনী থেকে আশ্বিন, কার্তিকা থেকে কার্তিক, অগ্রাহিয়ন থেকে অগ্রহায়ণ, পৌষা থেকে পৌষ, মাঘা থেকে মাঘ, ফালগুনি থেকে ফালগুন, চিত্রা থেকে চৈত্র । পহেলা বৈশাখ বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম ছিল। আগেই বলা হয়েছে, বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রবর্তক মোগল সম্রাট আকবর। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০/ ১১ মার্চ তারিখ থেকে বঙ্গাব্দের গণনা শুরু। দিনটি ছিল তারও ২৯ বছর আগে সম্রাট আকবরের সিংহাসনে আরোহণের দিন। শুরুতে এই বর্ষপঞ্জিকার নাম ছিল তারিখ-ই ইলাহী। মূলত এই সৌরসাল প্রবর্তনের কারণ ছিল খাজনা আদায়ের সুবিধা নিশ্চিত করা। এই বর্ষপঞ্জি প্রণয়নে সর্বাধিক ভূমিকা রাখেন আকবরের মন্ত্রণাসভার অন্যতম ব্যক্তি জ্যোতির্বিদ আমীর ফতেউল্লাহ সিরাজী। উল্লেখ্য, সে সময় এ অঞ্চলে বর্ষপঞ্জি হিসেবে চালু ছিল শকাব্দ। যা শাক্য রাজপরিবার চালু করে ৭৮ খ্রিস্টাব্দে। প্রথম দিকে বাংলা বর্ষপঞ্জি অর্থাৎ তারিখ-এ-এলাহির মাসগুলোর নাম ছিল কারওয়াদিন, খোরদাদ, তীর, আমারদাদ, শাহরিয়ার, আবান, আয়ুব, দাই, বাহাম এবং ইস্কান্দার। পরে বাংলা বারো মাসের নাম নক্ষত্রের সঙ্গে মিলিয়ে করা হয়। বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিম বঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরা প্রদেশে বাংলা বর্ষপঞ্জি ব্যবহৃত হয়। হিজরি সন গণনা হয় চান্দ্রমাসের হিসাবে, আর বাংলা সন গণনা করা হয়ে সৌর মতে। ফলে হিজরি সনের সঙ্গে বাংলা সনের ব্যবধান ঘটেছে কালক্রমে। চান্দ্রমাস সৌর মাসের চেয়ে বছরে প্রায় একপক্ষ ছোট হওয়ার ফলে এই ব্যবধান ঘটেছে। হিজরি সন এগিয়ে গেছে বছরের হিসাবে। শুরুর দিকে বাংলা বর্ষপঞ্জির মাসগুলো সুনির্দিষ্ট ছিল না। অনেকটা ইংরেজি বর্ষপঞ্জির মতো ছিল। ২৯ থেকে ৩২ দিনে মাস গণনা হতো। ১৯৬৩ সালে বাংলা একাডেমি থেকে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর প্রস্তাবনায় বাংলা বর্ষপঞ্জিকে যুগোপযোগী এবং আধুনিক করার উদ্যোগ নেয়া হয়। প্রচলিত বাংলা সন এইভাবে সংস্কার করা হয়: বৈশাখ-ভাদ্র = ৩১ দিন করে = ১৫৫ দিন; আশ্বিন-ফাল্গুন = ৩০ দিন করে = ১৮০ দিন; চৈত্র = ৩০ দিন = সর্বমোট ৩৬৫ দিন; অতিবর্ষ ৩৬৫+১=৩৬৬ দিন । বর্তমানে বাংলাদেশে এই বর্ষপঞ্জিটিই সরকারীভাবে অনুসরণ করা হয়ে থাকে। যদিও ড. গোলাম মুরশিদ ‘কার সন, কার সংস্কার’ প্রবন্ধে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ কর্তৃক বাংলা বর্ষপঞ্জির সংস্কার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন- ‘সত্যি বলতে কি, শহীদুল্লাহ বাংলা সনের যে সংস্কার করলেন, অথবা তাকে দিয়ে যে সংস্কার করিয়ে নেয়া হলো, মাসের হিসেবকে সহজ করলেও, তা আদৌ বৈজ্ঞানিক নয়।’ বাংলাদেশে ১৯৮৮ সালের ১৮ জুন থেকে সরকারি চিঠিপত্রে খ্রিস্টাব্দের সঙ্গে বাংলা সালও ব্যবহৃত হচ্ছে।
৪.
নববর্ষের উৎসব দেশে দেশে-
সারা পৃথিবীতে বহু যুগ ধরে ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদির মধ্যে নববর্ষের উৎসব এক উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আসছে। বিশ্বনিখিলে সৃষ্টি ও সংহারের যে পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী হয়ে দেখা দেয় তাকে গ্রহণ করে সৃষ্টির যে বার্ষিকী পালন করা হয় তাকে ঘিরে নববর্ষের উৎসব। এ উৎসব তা প্রায় চার হাজার বছরের পুরনো। মেসোপটেমিয়ায় এ নববর্ষ বা আকিতু শুরু হতো নতুন চাঁদের সঙ্গে। নববর্ষের উৎসব ‘এনুমা এলিশ’ মহাকাব্যের উপাখ্যান থেকে অভিনয় করা হতো- কেমন করে সূর্য দেবতা মারদুক বিশৃংখল শক্তিকে পরাভূত করে নিখিল বিশ্বের জন্ম দেয় তার কথা। উদ্ভিদ জগতের মৃত্যু ও পুনরুত্থানের কথা স্মরণ করিয়ে ধর্মীয় নাটক অভিনীত হতো। পারসিক রাজা ড্রাগনের হন্তারক হিসেবে নববর্ষের দিনে নিজেকে জাহির করতেন। ব্যাবিলনিয়ায় নববর্ষ শুরু হতো মহাবিষুবের দিনে ২০ মার্চ। অ্যাসিরিয়ায় শুরু হতো জলবিষুবের দিনে ২১ সেপ্টেম্বর। মিসর, ফিনিসিয়া ও পারসিকদের নতুন বছর শুরু হতো ২১ সেপ্টেম্বর। গ্রিকদের নববর্ষ শুরু হতো খ্রিস্টপূর্বৃ পঞ্চম শতাব্দী পর্যন্ত ২১ ডিসেম্বর। রোমান প্রজাতন্ত্রের পঞ্জিকা অনুযায়ী নববর্ষ শুরু হতো ১ মার্চ এবং খ্রিস্টপূর্বৃ ১৫৩ সালের পর ১ জানুয়ারিতে। ইহুদিদের নববর্ষ বা রোশ হাসানা শুরু হয় তিসরি মাসের প্রথমদিন, গোঁড়া ইহুদিদের মতে সে মাসের দ্বিতীয় দিন। মোটামুটিভাবে তিসরি মাস হচ্ছে ৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ অক্টোবর। মধ্যযুগে ইউরোপের বেশিরভাগ দেশে নববর্ষ শুরু হতো ২৫ মার্চ, যেদিন দেবদূত গ্র্যাব্রিয়েল যিশুমাতা মেরির কাছে যিশুখ্রিস্টের জন্মবার্তা নিয়ে যান। অ্যাংলো-স্যাকসন ইংল্যান্ডে নববর্ষের দিন ছিল ২৫ ডিসেম্বর। ১ জানুয়ারি পাকাপোক্তভাবে নববর্ষের দিন হিসেবে নির্দিষ্ট হয় ১৫৮২ সালে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার প্রবর্তনের পর। ধীরে ধীরে শুধু ইউরোপে নয়, সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী নববর্ষ পালন করা হচ্ছে। উত্তর গোলার্ধে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে আবহাওয়াজনিত কারণে নববর্ষের মেজাজ বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। চীন ও জাপানের নববর্ষের উৎসব ঠিক ইউরোপের নববর্ষের উৎসবের মতো নয়। তিব্বতি পঞ্জিকার প্রথম মাসের (ফেব্রুয়ারি-মার্চ) প্রথমদিন তিব্বতে নববর্ষের উৎসব পালিত হয়। সকালে মঠ, মন্দির ও গৃহমন্দিরে দেবদেবতা ও সাধু-সন্তদের মূর্তিতে অর্ঘ দান করা হয়। নববর্ষের দিন অতিথি অভ্যাগতদের জন্য বিশেষ ধরনের পিঠা ও পানীয় প্রস্তত করা হয়। নববর্ষের উৎসবের তিনদিন পর শুরু হয় প্রার্থনা উৎসব এবং তা চলে ১৫ দিন ধরে। চীনে মাসব্যাপী নববর্ষের উৎসব শুরু হয় জানুয়ারির শেষে বা ফেব্রুয়ারির প্রথমে। তার আগে অসুর ও দৈত্যদানবদের বিতারনের জন্য নানা ধরনের নাটকের অভিনয় হয়। গৃহদেবতা, ধনদেবতা ও পূর্বপুরুষদের মঙ্গলের জন্য অর্ঘ অর্পণ করা হয়। জাপানে নববর্ষের উৎসব এখন ১-৩ জানুয়ারি পালিত হয়। দক্ষিণ ভারতে তামিল নববর্ষ শুরু হয় দক্ষিণায়নের (২১/২২ ডিসেম্বর) দিন। তিনদিন ধরে মঙ্গল উৎসব চলে। মন্দির, মূর্তি বা তীর্থ দর্শনে লোক বের হয়। আনুষ্ঠানিকভাব নতুন চাল সিদ্ধ করা হয়। বাংলার নববর্ষ পহেলা বৈশাখ এবং ইরানের নববর্ষ নওরোজ একই ধাঁচের। কিন্তু নওরোজ পালন শুরু হয়েছে খ্রিস্টপূর্ব ৫৪৭ সাল থেকে। ইরানের শ্রেষ্ঠ সম্রাট সাইরাসের সিংহাসন আরোহণের দিন স্মৃতি ধরে এই উৎসব পালিত হচ্ছে আজ অবধি। ইরানের সামসি বছরের প্রথম দিন ২১ মার্চ থেকে সাপ্তাহব্যাপী এখনও প্রাণউদ্দীপনা সহকারে নওরোজ পালিত হয়ে থাকে। বর্তমানে ইরানে কট্টর মোল্লাতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা বিরাজ করছে; তবু ধর্মীয় উৎসব এড়িয়ে নওরোজ জাতীয় উৎসব হিসেবে পালনে বাধা নেই। রোমান বা ইংরেজি কায়দায় ‘নিউ ইয়ারস ডে’ যদিও আন্তর্জাতিকভাবে উৎসব হিসেবে পালনের রেওয়াজ হয়েছে, তবু পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির আলোকে নববর্ষ পালিত হয়ে থাকে। কিন্তু যেসব দেশে এখনও চান্দ্র মাসের বছর গণনার রেওয়াজ অথবা চান্দ্র মাস ধরে ধর্মীয় আচার, আচরণ ও উৎসব রয়েছে সেসব দেশে প্রকৃত নববর্ষ পালন করা সম্ভবপর হয় না। চান্দ্র বৎসর সৌর বৎসরের চাইতে ১১ দিন কম, তাই চান্দ্র বৎসর সঠিক কোন ঋতুতে স্থির থাকে না, ৩৬৫ দিন ৬ ঘণ্টা ধরে বছর গণনা করলে সে অসুবিধা আর থাকে না। পৃথিবীর ইতিহাসে বোধহয় ইরানিরাই প্রথম এই নওরোজ সৌরবৎসর ধরে পালন করে আসছে। গ্রিকরা ‘তার’ অনুকরণে বছর গণনা শুরু করলেও রোমান যুগে তার ব্যতিক্রম ঘটেছিল, খ্রিস্টাব্দ গণনার সূত্র ধরে রোমান সম্রাট গ্রেগরি বর্তমান প্রচলিত ‘ক্যালেন্ডার ইয়ার’ প্রচলন করেন। অবশ্য ইরানিরাও তাদের বছর গণনার খেই হারিয়ে ফেলেছিল ৬৪১ খ্রিস্টাব্দে আরবদের আক্রমণের সময় থেকে একাদশ শতাব্দি অবধি। পারস্যরাজ মালিক শাহ আরবদের জবরদস্তি হিজরি সাল গণনা মুলতবি রেখে সৌর সাল গণনা ফের শুরু করেন। সেই থেকে নওরোজ উৎসব ইরানিদের জাতীয় উৎসব, প্রাণের উৎসব। ইরানিরা জবরদস্তিমূলক আরবদের ধর্ম গলধকরণ করলেও ইরানি জাত্যাভিমান এক বিন্দু ছেড়ে দিতে চায়নি কোনকালে, সেজন্য ইরানে ধর্মীয় উৎসব তেমন প্রাধান্য পায়নি।
৫.
পহেলা বৈশাখ ও হালখাতা-
বাংলাদেশে দু’টি নববর্ষ পালিত হয়। একটি ইংরেজি অপরটি বাংলা। ইংরেজি নববর্ষকে বরণ মূলত খ্রীস্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু বিবর্তন আর সময়ের পরিক্রমায় এটি আজ সকল ধর্ম-সম্প্রদায়ের মধ্যে ধীরে ধীরে প্রসার লাভ করছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার অনেক পরে অর্থাৎ মাত্র কয়েক বৎসর আগে এটি প্রথমে রাজধানী কেন্দ্রিক ছিল আর এখন দেশের ছোট ছোট শহরেও বিস্তৃতি লাভ করছে। অথচ ইংরেজি নববর্ষ আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি বা ঐতিহ্যিক ধারার অংশ নয়। কিন্তু বিশ্বায়ন, আধুনিকতা, শিক্ষা, চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, স্যাটেলাইট প্রযুক্তি ও শক্তিশালী প্রচার মাধ্যমের দ্বারা আমরা প্রভাবিত হয়ে পড়ি, সংক্রমণ ব্যাধির মত আক্রান্ত হয়ে পড়ি। অনুন্নত দেশের মারাত্মক অর্থনৈতিক দুর্বলতা, রাজনীতি ও দেশ পরিচালনায় বলিষ্ঠ নেতৃত্ব শূন্যতা -এর জন্যে দায়ী। অপরদিকে ১লা বৈশাখ বাংলা নববর্ষের চিরায়তরূপ ও ঐতিহ্যিক ধারা যা ঐ ইংরেজি নববর্ষের প্রবল স্রোতের মধ্যে খেই হারিয়ে ফেলেছে। ব্যবসায়ী, কৃষক আর গ্রাম-গঞ্জের সাধারণ মানুষ বাংলা নববর্ষের মূল ধারাকে ধরে রাখতে ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে পড়েছে। বিষয়টি অনেকটা মোম জ্বালিয়ে মৃত ব্যক্তিকে পাহারা দেয়ার মত। গত কয়েক বৎসর থেকে এটি শহরের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে তথাকথিত আধুনিকতার বেহিসেবী মাত্রা তালে জড়িয়ে পড়েছে। শুধু একদিন, শুধু একদিনের জন্যে নব্য বাংলা নববর্ষীরা ইলিশ মাছ দিয়ে পান্তা ভাত খেতে উন্মাতাল হয়ে ওঠে। আর এ সুবাদে নবধারার একটি রমরমা ব্যবসাও চালু হয়ে গেছে। বাংলা নববর্ষ উদযাপন বাঙালি সংস্কৃতির এক ঐতিহ্যিক অঙ্গ। তবে বাস্তবায়ন ও পালন প্রক্রিয়ায় মুসলমান আর হিন্দুতে কিছু পার্থক্য আছে। বাংলাদেশে বসবাসকারী অন্যান্য সম্প্রদায়ও এটি পালন করে। এই অন্য সম্প্রদায় বলতে উপজাতীয় শ্রেণীকে বুঝাতে চাচ্ছি, যারা নিজেদের আলাদা অস্তিত্ব বজায় রেখে টিকে থাকতে চায়। তাদের মূল উৎসবসমূহের মধ্যে নববর্ষ উদযাপন প্রধান ও বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে, তবে তাতে নাম ও প্রকরণ ভিন্নতা রয়েছে। এ পর্যায়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাসকারী বিভিন্ন উপজাতীয় সম্প্রদায়ের বৈচিত্রময় নববর্ষ উদযাপন আকর্ষণীয় ও কৌতূহলোদ্দীপক । বাঙলা নববর্ষ পালনের অন্যতম অনুসঙ্গ হয়ে আছে হালখাতা। হালখাতা অনুষ্ঠান পয়লা বৈশাখ বা নববর্ষের একটি সর্বজনীন আচরণীয় উৎসব বলা যেতে পারে। জীবনের জীর্ণ খাতাকে বদলে একটি নতুন খাতা খোলাই হালখাতার মূল উদ্দেশ্য। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন বছরের হিসাব পাকাপাকিভাবে টুকে রাখার জন্য ব্যবসায়ী মহলের নতুন খাতা খোলার আনুষ্ঠানিক চিরায়ত উদ্যোগ হচ্ছে হালখাতা। এতে ব্যবসায়ীদের কাজ-কারবারের লেনদেন, বাকি-বকেয়া, উসুল আদায় সব কিছু হিসাব-নিকাশ লিখে রাখার ব্যবস্থা থাকে। ড. মুহম্মদ এনামুল হকের মতে- জমিদারী আমলে ‘পুণ্যাহ’ অনুষ্ঠানে প্রজারা আসতো, মিষ্টিমুখ হত, এবং প্রজারা খুশী মনে বকেয়া খাজনা দিয়ে যেত। বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজের সঙ্গে ফসলের মৌসুমকে আলাদা করা যায় না- ফসলের মৌসুমকে ঘিরেই ‘পুর্ণ্যাহ’ হতো। ‘পুণ্যাহ’ অনুষ্ঠানেরই সার্বজনীন রূপ হচ্ছে হালখাতা। রাজ দরবার থেকে সাধারণ মানুষের জীবনাচারের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে ওঠে নববর্ষ পালন, বৈশাখ মেলার আয়োজন, সর্বোপরি হালখাতা অনুষ্ঠান। হালখাতা ইতিহাসের কোন পর্যায়ে কখন কিভাবে শুরু হয়েছে তার সঠিক তথ্য জানা অসম্ভব। তবে হাল শব্দটি হলো ফারসি-যার অর্থ হচ্ছে বর্তমানকাল। হালখাতার দিন ব্যবসায়ীরা বিছানো শতরঞ্জির উপর পিতলের কলসীতে পানিতে একটি আমের ডাল রাখে- এটি সর্বমঙ্গলের প্রতীক হিসেবে রাখা হতো। হালখাতা অনুষ্ঠানের দাওয়াত আসে সাধারণত স্বর্ণকারের দোকান থেকে, কাপড়ের দোকান থেকে এমনকি মিষ্টির দোকান থেকেও। গ্রামেগঞ্জে মুদি, মনোহারীর দোকানিকেও হালখাতা অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে দেখা যায়। হালখাতায় নিমন্ত্রিত হয়ে যারা আসবে তাদের জন্য যথাসাধ্য মিষ্টিমুখ করার রীতি রয়েছে। আগের দিনে হালখাতা অনুষ্ঠানে ভাড়া করা কলের গান বাজানো হতো, এখন লাউড স্পিকারে বাজে ক্যাসেটের গান। আগে গ্রামবাংলার মহাজনের গদীতে যে বর্ণাঢ্যভাবে হালখাতা হতো তা এখন ম্লান হতে চলেছে। তবুও হালখাতা বাঙালির জীবন থেকে একেবারে মুছে যায়নি। হালখাতার মিষ্টিমুখের মতোই হাসি, খুশী, প্রীতি, সম্প্রীতিময় হোক সারাটি বছর এটিই সম্ভবত হালখাতা অনুষ্ঠানের আসল কামনা। বাঙলা নববর্ষেকে ঘীরে বাঙালির জীবনে উৎসব আনন্দের যেন শেষ নেই। নববর্ষের বৈশাখী মেলা তারই প্রমাণ।
৬.
উপেক্ষিত বাংলা সন …
বাংলাদেশে বাংলা ভাষা আছে কিন্তু বাংলা সন থেকে ও নেই। আমরা লক্ষ্য করলেই দেখতে পাই আমাদের দৈনন্দিক জীবনে বাংলা সনের উপস্থিতি নেই। কোন পর্যায়েই নয়। স্কুলে সন্তান ভর্তি অফিস আদালত ব্যাংক বীমা বিদেশ ভ্রমকনের তারিখ নিধারণ ইত্যাদি কোন পর্যায়েই বাংলা তারিখ ব্যবহৃত হয়না। মূলত আমাদের জন্ম থেকে মৃত্য পযর্ন্ত বাংলা তারিখের সাথে তেমন কোন সংশ্লিষ্টতাই দেখা যায় না কিন্তু এমনটি হবার কথা ছিল না। পৃথিবীর বুকে একমাত্র যে দেশটি তার ভাষা রক্ষার জন্য আন্দোলন করে জীবন দিয়েছে, যে দেশে প্রতি বছর বাংলা নববর্ষ পালিত হয়, আনন্দঘন উৎসবে, সে দেশেই বাংলা সন উপেক্ষিত অনাদৃত। এমনটি তো হবার কথা ছিল না এটা ভাবতে অবাক লাগে। এর কারণ সন্ধান করতে গেলে দেখা যায় বাংলা দিন পঞ্জিকার স্থানটি দখল করে নিয়েছে ইংরেজী ক্যালেন্ডার। আমরা জীবনের সব ক্ষেত্রে ইংরেজী সাল তারিখ নির্ভর হয়ে পড়েছি। যার কারণে বাংলা সন তারিখ আমাদের কাছে অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। বর্তমান স্বাধীন বাংলাদেশে বাংলা ভাষা গৌরবে সমাসীন হলেও বাংলা সন উপেক্ষার চাদরে প্রায় ঢাকা পড়ে গেছে। রাষ্ট্রিয়ভাবে জাতীয় জীবনে, বাংলা সন প্রচলনের নিয়ম করা হলেও তার ব্যবহারিক দিকটি তেমন চোখে পড়ে না। বাস্তবে কিছু সরকারী চিঠি পত্রে আর সংবাদ পত্রে ইংরেজী তারিখের পাশা পাশি বাংলা তারিখ দেখা যায়। এছাড়া আর কোথাও বাংলা তারিখের ব্যবহার চোখে পড়ে না। আসলে বাংলা সনের অবস্থাটা এখন এমন অবস্থায় দাঁড়িয়েছে যা একদিন জনজীবনের প্রত্যাহিকতায় জড়িয়ে ছিল তা এখন ঠাঁই নিয়েছে বাংলা পঞ্জিকার পাতায়। বিশেষ করে নগর শহর থেকে একেবারেই বিদায় নিয়েছে বাংলা সনের দিন তারিখ। নাগরিক বহু মানুষই কেবল বৈশাখ ছাড়া আর কোন দিন কোন মাস আসছে যাচ্ছে, বাংলা সন তারিখ মাসের খবর রাখেন না। বাংলা সনের প্রতি এই যে অনাগ্রহ অবহেলা এর কারণ মূলত আমাদের ইংরেজী প্রীতি। বিদেশী শাসকরা একদিন পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে আমাদের ঘাড়ে যে ভাষা ও সাল তারিখ চাপিয়ে দিয়ে গেছে কাল ক্রমে তাই আমাদের কাছে সার্বিকভাবে প্রাধান্য লাভ করেছে। সে কারণেই ইংরেজ শাসকরা চলে গেলেও ইংরেজিকে আমরা ছাড়তে পারিনি তাদের সাল তারিখকেও। আজকের বিশ্ব প্রতিটি স্বাধীন দেশ ও জাতি যখন নিজের জাতীয় ঐতিহ্যকে সযত্নে প্রতিষ্ঠিত করতে ও বাঁচিয়ে রাখতে সর্বতোভাবে সচেষ্ট সেখানে আমরা আমাদের আবহমান কালের ঐতিহ্য বাংলা সনকে জাতীয় জীবন থেকে প্রায় ঠেলে দিয়েছি উপেক্ষা ও অনাদরে। নিজস্ব সনটির জাতীয় পর্যায়ে ব্যবহারের ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছি। পৃথিবীর অনন্য আত্মমর্যাদাশীল দেশে কিন্তু এটা দেখা যায় না। যেমন চীন সংস্কৃতির পালে পশ্চিমা সংস্কৃতির জোর বাতাস লেগেছে। তাতে কিন্তু চীন সংস্কৃতি বেপথু হয়নি। বিশাল জনসংখ্যা আর দারিদ্র্যতাকে কাঁধে নিয়েই আজ উঠে এসেছে উন্নতির শীর্ষে। সে জন্য তাদের নিজস্ব ঐতিহ্যকে বির্সজন দিতে হয়নি। চীনারা নিজস্ব চীন বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করেই বর্তমান অবস্থানে পৌঁছেছে। তেমনি থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ইরান ও সউদী আরব সহ মধ্যপ্রাচ্যের ও অফ্রিকার দেশগুলোতে নিজস্ব বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করা হয় দৈনান্দিন জীবন প্রবাহে ও রাষ্ট্রিয় পর্যায়ে। এসব দেশে ইংরেজী সাল তারিখ কেবল প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। এর ফলে তারা ক্রমশ পিছিয়ে পড়েছে তার যেমন প্রমাণ মেলে না তেমনি আমরা ইংরেজী সাল তারিখ অনুসরণ করে অগ্রগতির শিখরে পৌছে যাচ্ছি তারও প্রমাণ মেলে না। বাংলা সন ক্রমশ নিজ ভুমিতেই পরিণত হচ্ছে এক অনাদৃত উপেক্ষিত পরবাসীতে। বিষয়টি সচেতন কারো চোঁখে যে পড়ছেনা তা নয়। কিন্তু এ নিয়ে কারো কোন মাথাব্যথা নেই। বাংলা সন থাকলেই বা কি না থাকলেই বা কি- ভাবখানা ঠিক এরকমই। বাংলাদেশের বাংলা ভাষী মানুষ শতাব্দীর পর শতাব্দীর ধরে প্রচলিত নিজেদের ঐতিহ্যবাহী সন কে ভুলে যাচ্ছে, যেতে বসেছে, এ এক বিস্ময় বটে। আমরা চেষ্টা করলে আন্তরিক হলেই বাংলা সনকে সকল কাজে কর্মে ব্যবহার করতে পারি। এ ব্যাপারে জন সচেতনতা ও সরকারী পর্যায়ে আন্তরিক উদ্যোগ প্রয়োজন। সম্মলিত উদ্যোগে বাংলা সন তারিখ তার পূর্ব মর্যাদায় পূর্ণ প্রতিষ্ঠিত হয়ে জাতীয় পর্যায়ে সমাদৃত হোক, বাংলা নববর্ষের সূচনা দিনে এটাই প্রত্যাশা।
৭.
নববর্ষ ও আবহমানকালের বাংলার লোক-মেলা …
মেলা বাংলাদেশের আবহমানকালের ঐতিহ্য। মেলা বাঙালির হাজার বছরের লোকসংস্কৃতির বাহন। বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির আবহমান অনাবিল আনন্দ ও আকর্ষণ মেলা। এদেশের নদী-নিসর্গ-মাটি-মানুষের সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে আছে মেলার আবাহন। বাঙালির জীবনে ঐতিহাসিক ঐতিহ্যও অকৃত্রিম আশিবার্দরূপেই মেলার উৎসব আয়োজন। মেলা হলে গ্রামের আবালবৃদ্ধ-বণিতা সকলের মাঝে আনন্দের ধুম পড়ে যায়। বিশেষ করে বৈশাখ মাস এলেই বৈশাখী মেলা বসে গ্রামে গ্রামে। গ্রামীণ জীবনে খেটে খাওয়া মানুষের যে সকল বিনোদনের উপকরণ বিদ্যমান মেলা তার মধ্যে অন্যতম, একথা বলা চলে। মেলা সাধারণত কোন খোলা জায়গায় বসে। আবার অনেক সময় বিশাল কোন বটবৃক্ষের নিচেও বসে। বাংলাদেশে প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান লৌকিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান উৎসব উপলক্ষে মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। কখনো পৌষ সংক্রান্তি, মাঘোৎসব, চৈত্র গাজন, পয়লা বৈশাখ, কিংবা অষ্টমী রথযাত্রা, মাঘীপূর্ণিমা, মহররমসহ বারোমাসের বিশেষ তাৎপর্য নিয়ে মেলা বসে। মেলার সঠিক জন্ম কবে, কোথায়, কিভাবে তার নির্ভরযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি। খ্রীষ্ট-পূর্ব ছয় সালে রাজা জুলিয়াস সীজারের বিজয়ের স্মারক হিসেবে যে মেলার সূচনা হয়েছিল জাঁক-জমকভাবে, স্মৃতির উপহার হিসেবে সেই মেলার বিচিত্র প্রকাশ দেশে মহাদেশে দেখা যায়। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সর্বপ্রথম শান্তিনিকেতনে পৌষমাসের মেলার আয়োজন করেন। সময়টা বাংলা ‘বারো’শ’ ছত্রিশ’ সনের আঠারই পৌষ। পরবর্তীকালে বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠাকাল থেকে জমজমাটভাবে পৌষ মেলা পালিত হয়ে আসছে। প্রকৃতপক্ষে এই মেলার প্রসার ঘটেছে ব্যাপকভাবে এমনকি বিশ্বজুড়ে। আমাদের এই এশিয়া মহাদেশেও এক সময় মুঘল আমলের ও ইরানের নওরোজ মেলা থেকে সময়ের পালাবদলে মেলার পরিবর্তিত ও পরিশীলিত ও প্রগতিশীল আয়োজন আমরা প্রত্যক্ষ করছি। সেকালে মেলার মূলতঃ পৃষ্ঠপোষক ছিলেন রাজা, বাদশাহ, সুলতান বা শাসকরা। মেলার আনন্দ প্রধানত তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতো। এইসব মেলার সাধারণ-সার্বজনীন আনন্দ ছিল না। মেলার আনন্দ ও আয়োজন সবই হতো বাদশাহ বা শাসকদের অভিপ্রায় অনুসারেই। প্রতি বৎসরই বাংলা নববর্ষে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে লোক-মেলা জমে উঠে। আগের দিনে কোন কোন স্থানে প্রায় মাসব্যাপী চলতো এসব মেলা। ১৯২১ সালে লিখিত সি.এ বেন্টলী সাহেবের বর্ণনায়- যিনি ছিলেন তখন বৃটিশ বাংলার জনস্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক- আমরা প্রায় ৭/৮ হাজার মেলার বিবরণ পাই। বেন্টলী সাহেব কোন কোন মেলাকে স্থায়ী মেলা বলেছেন- যেমন ঢাকার লাঙ্গলবন্দ, দিনাজপুরের নেকমর্দন বা ময়মনসিংহ বেগুনবাড়ির মেলা- সীতাকুণ্ড, মহেশখালী, সুরেশ্বর, মাইজভান্ডার ইত্যাদি- সবাই জানেন এখানেই মেলা বসবে এবং নির্দিষ্ট একটি দিনে। অন্যগুলো অস্থায়ী-যে কোন বটের ছায়ায়-হাটে বা বাজারে- বা নদীতীরে বসতে পারতো। মেলাগুলো কিছু ধর্মীয় চৈত্র-সংক্রান্তি, রথযাত্রা, ঝুলন, গাজন, চড়ক, দোল, অষ্টমী, নবমী, বারণী, বুদ্ধ পূর্ণিমা, মাঘি পূর্ণিমা, মহরম, শবেবরাত, ঈদ, গাজীপীরের মেলা, আঞ্চলিক কোন দরবেশ বা লৌকিক দেবতা বা সন্ন্যাসীর মেলা। কোন কোনটি ধর্ম নিরপেক্ষ- বিভিন্ন লোকায়ত মেলা, নববর্ষ, পূণ্যাহ কৃষি মেলা, পৌষমেলা, নৌকা বাইচের মেলা, ঘোড়া বা গরু দৌড়ের মেলা, পশু প্রদর্শনীর মেলা, কিংবদন্তীমূলক মেলা, বাউলের মেলা ইত্যাদি। এটা ঠিক যে শত শত বৎসর পূর্বে বিভিন্ন স্থানের মেলায় যে সংস্কার বা রিচুয়াল ছিল আজ তা বদলিয়েছে- ‘সহেলা’ বা ‘সয়লার’ যে মেলায় বুক পানিতে নেমে সই পাতানো হত- দুই সই জীবনে মরণে যেখানে এক হবার প্রতিজ্ঞা নিত- সে মেলা আজ নেই- সই লো সই মনের কথা কই/ জীবনে মরণে যেন এক হয়ে রই, সে গান তো আজ বাজে না। তবু মেলা জমে উঠে। কবে কোন সুদূর অতীত থেকে কে কবে করেছিল এর প্রবর্তন-সে হিসাব পাওয়াও সহজ নয়। মেলা হয়-মেলা হয়ে আসছে। আমরা দেখতে পাই একসময় রাজদরবার থেকে মেলার মুক্তি হলো সাধারণ মানুষের মাঝে। রাজ-রাজড়ার দরবারের শৃংখল থেকে মুক্ত হয়ে মেলার আনন্দ ছড়িয়ে পড়ল কিষাণ, কুমার, কামার আর মাঠের মানুষের আঙিনায়। মেলার উৎসবের উৎস ততোই প্রবহমান হতে থাকলো নদীর মতোই মেলার মহিমা প্রসারিত হয়ে উঠলো গ্রাম বাংলার খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের মাঝে। এই মেলার মাধ্যমেই মানুষে মানুষে সম্প্রীতি ও মহামিলনের সীমানা সম্প্রসারিত হতে থাকলো। এই এক আনন্দ উৎসব। বিভিন্ন অঞ্চলের লোকের আগমন সামাজিক সম্প্রীতির মত বিনিময় এবং এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চল অবধি পণ্যসামগ্রী আমদানি ও রফতানি করারও অবাধ আয়োজন হলো। এখনতো বিশেষ বিশেষ মেলাকে সামনে রেখে সারাবছর ধরেই আয়োজন চলতে থাকে। বিশেষ করে কুটির শিল্প সামগ্রীর বিচিত্র সমাহার মেলাকে ঘিরেই ঘটে। মেলা বর্তমানে বাঙালির জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে। বিশেষ করে বৈশাখী মেলা এবং বর্ষবরণ উৎসব। মেলাকে এক ধরনের- উৎসবই বলা চলে। গ্রামীণ পণ্যের প্রদর্শনীর মাধ্যমে মেলা আমাদের অর্থনীতিকে সচল রাখছে। মেলা সব ধরনের মানুষের মহামিলনক্ষেত্র। এখানে অসাম্প্রদায়িক চেতনার এক প্রোজ্জ্বল আলো ফুটে উঠে। কি মুসলিম, কি হিন্দু, কি খ্রীস্টান, কি বৌদ্ধ সব ধর্মের বর্ণের মতের পথের মানুষ মেলায় এসে এক জায়গায় জড়ো হয়। আমাদের সমাজ জীবনে এই অসাম্প্রদায়িক চেতনার অসাধারণ ভূমিকা রয়েছে। একজন আধুনিক চেতনা-চিন্তার মানুষ সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে নিজের অবস্থান রাখবে। মেলা এই অসাম্প্রদায়িক বোধ নির্মাণের সহায়ক। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে আমরা মানুষ, আমরা সবাই বাঙালি। সংকীর্ণ মানসিকতা সমাজ প্রগতির অন্তরায়। একটি বৈষম্যমুক্ত উদার সমাজ কাঠামো তৈরিতে মেলার তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বর্ণ, গোত্র, সম্প্রদায়, গোষ্ঠী, ধর্ম, ক্ষুদ্র জাতীয়তাবাদ, এসব মানুষে মানুষে হানাহানি বিভদে অশান্তির মূল কারণ। কিন্তু মেলা কিংবা বর্ষবরণ উৎসবে মানুষ এসব ভুলে সবাই আনন্দ বিনোদনে মেতে উঠে। এখানে সবাই সমান। সাম্যের সুন্দরের এক অপূর্ব অনাবিল সম্মিলন মেলাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। আমাদের নির্মোহ আর্শীবাদ মেলার মতই সকলের জীবন হোক আনন্দমুখর, বিচ্ছেদ বিভদেহীন উৎসবের মতই হোক বাঙালির জীবন।
৮.
মেলা – আমাদের লোক সংস্কৃতির বাহন …
মেলা আমাদের লোক সংস্কৃতির অন্যতম বাহন হিসেবে কাজ করছে। বিপুল ও বিচিত্র উপাদানে আমাদের লোক সংস্কৃতির ভান্ডার সমৃদ্ধ। বাংলাদেশের সামাজিক ও ভূ-প্রকৃতির বিন্যাস, জনবসতির ধরন ও বৈশিষ্ট্য এর লোক সমাজের আচার, বিশ্বাস, সংস্কার এবং মানসিক ও মনস্তাত্ত্বিক গঠনের বৃহৎ পরিমন্ডলের মধ্যেই গড়ে উঠেছে আমাদের এই বিচিত্র, বহুমাত্রিক এবং অভ্যন্তরীণ গতিশীলতায় সমৃদ্ধ লোক সংস্কৃতি। অতীতকালে নানা ঐতিহাসিক ও সামাজিক অভিঘাতে ধর্মীয় খোলস ভেঙে এখানকার আদি জনগোষ্ঠী ও বহিরাগত নানা জাতি উপজাতির সমন্বিত এই ইহজাগতিক ও লোকায়ত সংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে মেলার আয়োজন চলতে থাকে। এরকম দুটি উৎসব তথা মেলার নাম ভাদু ও তুষু। এই দুটি উৎসবই বাঙালির ফসলের উৎসব হিসেবে পরিচিত। ভাদ্র ও পৌষ মাষে এ উৎসব দু’টি বাংলাদেশের প্রান্তিক ও পশ্চিম বাংলায় কোনো কোনো অঞ্চলে উদযাপিত হয়ে থাকে। এই প্রাচীন মেলা দু’টির উল্লেখ রয়েছে সম্রাট অশোকের কলিঙ্গ অনুশাসনে। মধ্যযুগে প্রচলিত ছিল মঙ্গলগীতিকা। মঙ্গলগীতিকার পরবর্তী পর্যায়ে পাই যাত্রা গানকে। পাঁচালী গানের মতো যাত্রা গানও প্রাচীন। আর যাত্রাতো আমাদের মেলার অন্যতম আকর্ষণ। অতি সাম্প্রতিক সময়ে যাত্রা রাজনীতি ও সাহিত্য নির্ভর করেও গড়ে উঠছে। পশ্চিম বাংলায় লেনিন যাত্রা, হিটলার যাত্রা বা রামমোহন যাত্রা এবং বাংলাদেশের মাইকেল যাত্রা যা প্রয়াত অমলেন্দু বিশ্বাস তৈরি করেছিলেন। এভাবে মেলাকে কেন্দ্র করেই আমাদের যাত্রা জারিগানসহ বিপুল ও বিশাল লোকসংস্কৃতি গড়ে উঠেছে।
৯.
মেলা : বাঙালির ঐতিহ্য ও আধুনিকতার অপূর্ব সমন্বয় …
মেলা আমাদের ঐতিহ্য ও আধুনিকতার অপূর্ব সমন্বয় সাধন করছে। বাংলা নববর্ষ পালন পাকিস্তান আমলে প্রচণ্ড বাঁধার মুখে পড়েছিল। তারপর অনেক রক্তের বিনিময়ে এদেশ স্বাধীন হয়। বাংলাদেশ আমলে নববর্ষ মেলা নতুনভাবে বিন্যস্ত হয়ে ধর্ম নিরপেক্ষ সার্বজনীন জাতীয় উৎসবে রূপান্তরিত হয়েছে। এরশাদ সরকার ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণার পর গণতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক কর্মী মহলে তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রতিবাদও লক্ষ্য করা গিয়েছিল। ঢাকার আর্ট কলেজের ছাত্র শিক্ষক ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা নববর্ষের দিনে যে বর্ণাঢ্য মিছিল, শোভাযাত্রা বের করে আসছেন তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এতে আদিকালের গ্রামীণ লোক মিছিলের বৈশিষ্ট্য ও আমেজ পুরোপুরিই এসেছে। চট্টগ্রাম চারুকলা কলেজের ছাত্র-শিক্ষক ও সাংস্কৃতিক কর্মীরাও এ ধরনের বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা করছে সাম্প্রতিককালে। অবরুদ্ধ সময়ের মধ্যে থেকে লোক সংস্কৃতির এই আধুনিক নাগরিক উদ্ভব ও বিস্ফোরণ মৌলবাদী ও তথাকথিত ছদ্মবেশী জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকদের মুখে চপেটাঘাত করে দেখিয়েছে যে, শিকড় সংলগ্ন সংস্কৃতিকে আরোপিত সংস্কৃতি দ্বারা কখনোই নির্মূল করা যায় না। এই ঘটনা লোক সংস্কৃতির অফুরন্ত প্রাণশক্তির পরিচায়ক। ছায়ানট ও বাংলা একাডেমীর বৈশাখী মেলা ও নববর্ষ উৎসব এই ধারায় শক্তি যুগিয়েছে। আশির দশকে জমে উঠা বাংলা একাডেমীর বইমেলাও বাংলাদেশের সংস্কৃতির মূল ধারাকে শক্তিশালী করেছে। ’৯০-এর দশকে এসে তা একই সঙ্গে গ্রামীণ লোক মেলারও কিছু বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছে। লোক ও মৃৎ শিল্প, মুড়ি, মুড়কি, কদমা, চুড়ি, খেলনার দোকানও এখন এই মেলার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে গেছে। এই হলো হাজার বছরের বাঙালী সংস্কৃতির একটি উপাদানের আধুনিক নাগরিক উত্থান। মেলাকেন্দ্রীক লোক সংস্কৃতি আমাদের সংস্কৃতির প্রধান উপাদানই শুধু নয় ক্ষেত্রবিশেষ এর নিয়ন্ত্রক শক্তিও। আমাদের এলিনিয়েটেড বা সমাজ বিচ্ছিন্ন বুদ্ধিজীবী বিশুদ্ধবাদী সাহিত্যকর্মীরা লোক সংস্কৃতির এই বিপুল শক্তি সম্ভাবনা ও প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পর্কে খুব একটা সচেতন, তেমন মনে হয় না। মেলা কিভাবে অমিত শক্তি ও নতুন সম্ভাবনার হিরন্ময় দুয়ার খুলে দেয় তার প্রোজ্জ্বল দৃষ্টান্ত চট্টগ্রামের মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা। আজকাল মানুষ নগর কেন্দ্রীক হয়ে যাচ্ছে। গ্রামীণ জীবনে দুঃখ-দারিদ্র্য নিরন্তর বহমান। এসব কারণে মেলার ঐতিহ্য ক্রমশঃ হারিয়ে যাচ্ছে। আমাদের লোকজ ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক প্রয়োজনেই মেলাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। নিজের মৌলিক সত্তার সন্ধানে আমাদেরকে ফিরে যেতেই হবে মেলার অনাবিল আবাহনে। এর কোন বিকল্প নেই। মহামিলনের এই স্রোতে তৈরি হোক মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্ববোধ।
১০.
‘বাসন্তী হে ভুবন মোহিনী’ …
আজ থেকে ৫০ বছর আগে ১৯৬৭ সালে যখন আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর আঘাত আসে তখন কিছু সাহসী মানুষ রমনা বটমূলে নববর্ষ উদযাপন করেছিল। এখন ছায়ানটের বাইরে সারা দেশব্যাপী উদযাপিত হয় বাংলা নববর্ষ। শুরুটা সেই ১৯৬৭ সালে। বৈরী পরিবেশে পাকি সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে রমনা বটমূলে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করেছিল ছায়ানট। আপন সংস্কৃতির আশ্রয়ে ঘটেছিল বাঙালির স্বতন্ত্র জাতিসত্তার প্রকাশ। বৈশাখে নববর্ষ উদযাপনকেই বিজাতীয় সংস্কৃতি বলে এর বিরোধিতা করেছিল পাকিস্তান সরকার। শহীদ অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী তখন প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘পারস্যে যদি ইসলামপূর্ব নওরোজ উৎসব অব্যাহতভাবে চলে আসতে পারে, তার অনুকরণে পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলে যদি নওরোজ উৎসব অনুষ্ঠিত হতে পারে, তাহলে আমরা কেন বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন করতে পারব না, বিশেষ করে বাংলা নববর্ষ যেখানে মোগলদের প্রবর্তন বলে সর্ববাদী সম্মত?’ ১৯৬১ সালে গড়ে ওঠা ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানটির এ বছরের বর্ষবরণের প্রভাতী সঙ্গীতানুষ্ঠানটি পদার্পণ করবে ৫০ বছরে। ষাটের দশকে রবীন্দ্রসংগীত গাওয়া ছিল আন্দোলনের ব্যাপার। সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে রবীন্দ্র শতবার্ষিকী উদযাপন ও রবীন্দ্রসংগীত গাওয়ার মাধ্যমে বাঙালির সংস্কৃতিচর্চায় নবতরঙ্গের সূচনা। এরই ধারাবাহিকতায় ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তন প্রতিষ্ঠায় ও নববর্ষ পালনে উদ্যোগী ভূমিকা নিলেন মুখলেসুর রহমান (সিধু ভাই), বেগম সুফিয়া কামাল, ওয়াহিদুল হক, সনজীদা খাতুন, জাহিদুর রহিম প্রমুখ। নববর্ষ পালনের সেই উদ্যোগ আজ জাতীয় উৎসবের রূপ লাভ করেছে। এ কৃতিত্বের দাবিদার ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতারা। অন্তত এক দিনের জন্য হলেও বাঙালি খুঁজে পায় আপন জাতিসত্তাকে। আর এটাই হচ্ছে ছায়ানটের অর্জন। ছায়ানটের এবারের পহেলা বৈশাখের বিষয় ‘আনন্দ’। অধ্যাপক সনজীদা খাতুন গণমাধ্যমকে বলেছেন, গান মানুষের অন্তর স্পর্শ না করলে তাদের স্বার্থকেন্দ্রিকতা, আত্মকেন্দ্রিকতা দূর হবে না। একবিংশ শতকে রবীন্দ্রসংগীতের আরেক দিকপাল রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা তাঁর সুরের ধারা প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে এ উৎসবে এনেছেন আরো অর্থবহ উপাদান। চৈত্রসংক্রান্তির অনুষ্ঠানে বিষয়ভিত্তিক আয়োজন দিয়ে দর্শক-শ্রোতাদের মধ্যরাত পর্যন্ত আবিষ্ট রাখেন। ২০০১ সাল থেকে চৈত্রসংক্রান্তির অনুষ্ঠান আয়োজন করছে সুরের ধারা। বিগত বছরগুলোতে একই সঙ্গে নতুন বছরকে বরণ করার অনুষ্ঠানও যোগ করেছে। চ্যানেল আইয়ের সঙ্গে ‘হাজারও কণ্ঠে বর্ষবরণ’ এ যাত্রায় নবতর সংযোজন। বন্যা মনে করেন, পহেলা বৈশাখ একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লব। বর্ষবরণে মঙ্গল শোভাযাত্রার এবারের স্লোগান, ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্য সুন্দর’। স্লোগানের সঙ্গে মিল রেখে বড় সূর্যের প্রতিকৃতি তৈরি হয়েছে, যা শোভাযাত্রায় অনেকে মিলে বহন করবে। আয়োজকদের ভাষায়, ‘সূর্যের সামনের মুখ হবে রঙিন, হাস্যোজ্জ্বল। আর পেছনে থাকবে কালো রঙে কাদাকার অন্ধকার মুখ। আমরা পেছনে অন্ধকার রেখে আলোর দিকে এগিয়ে যাব। ’
(তথ্যসূত্র: ১.বাংলাদেশের উৎসব : নববর্ষ ; সম্পাদক – মোবারক হোসেন, সহকারী সম্পাদক – কুতুব আজাদ, প্রথম প্রকাশ-পহেলা বৈশাখ ১৪১৫ / ১৪ এপ্রিল ২০০৮, বাংলা একাডেমী, ঢাকা। ২. বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্র-পত্রিকা এবং ইন্টারনেট)
আবদুল্লাহ আল মোহন
১৪ এপ্রিল, ২০১৬ / ১৪ এপ্রিল, ২০১৭/ ১৪ এপ্রিল, ২০১৯/ ১৪ এপ্রিল, ২০২০