এই করোনাকালে সারাদেশের অনেক প্রতিষ্ঠানই শুরু করেছে অনলাইন ক্লাসের ব্যবস্থা। উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে এর কিছু ইতিবাচক দিক থাকলেও প্রাথমিক, নিম্ন মাধ্যমিক বা মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের জন্য এটা কতটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে- তা কি আমরা কখনও ভেবে দেখেছি?
ইন্টারনেট ব্যবহারের ইতিবাচক দিক যেমন রয়েছে, ‘প্রযুক্তিতে আসক্তি’ নামের নেতিবাচক দিকও তেমনি রয়েছে এবং এই নেতিবাচক দিকটাই বেশি। যেকোনো বয়সের মানুষই প্রযুক্তির আসক্তিতে জড়িয়ে পড়তে পারে। আর এই প্রযুক্তিতে আসক্তির শুরুটা হয় মুঠোফোন দিয়েই। এমনকি এটা যে আসক্তি, সেটাও বুঝতে পারে না ব্যবহারকারীরা।
একটি পরিসংখ্যানে জানা যায়, গড়পড়তায় মানুষ এখন প্রতি ছয় মিনিটে তার মুঠোফোনের পর্দায় একবার চোখ রাখে। এই অঙ্কে দিনে আমরা অন্তত ১৫০ বার মুঠোফোনের পর্দায় নজর রাখছি। যুক্তরাষ্ট্রের পিউ রিসার্চ জানাচ্ছে, গড়ে প্রতিজন মার্কিন কিশোর দিনে ১১০টি খুদে বার্তা পাঠায়। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এই সংখ্যা বেড়ে যায় ৫ গুণ পর্যন্ত!
করোনার এই সংক্রমণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে দেশের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে অনলাইনে ক্লাস পরিচালনার ঘোষণা দিয়েছে। ইতোমধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠান এটা শুরুও করেছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কথা বাদই দিলাম। আমি প্রাথমিক, নিম্ন মাধ্যমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের নিয়ে কথা বলছি। প্রাথমিক সমাপনী, জেএসসি ও নবম-দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার ব্যাঘাত ঘটছে ভেবে অনেক প্রতিষ্ঠানই শিক্ষার্থীদের ফেসবুক আইডি খোলার নির্দেশ দিচ্ছে, গ্রুপে যুক্ত হতে নির্দেশ দিচ্ছে। আর এই নির্দেশনা পাওয়ার পর শিশু-কিশোরদের আনন্দের যেন শেষ নেই। যাদের বাসায় স্মার্ট ফোন নেই, তারাও পিতা-মাতাকে চাপ সৃষ্টি করে স্মার্ট ফোন কিনতে বাধ্য হচ্ছে, নেট সংযোগ নিচ্ছে। এখানেই শেষ নয়, অনেক অশিক্ষিত অভিভাবকের চোখে ধুলা দিয়ে অধিকাংশ শিশু-কিশোর অনলাইনে পড়াশুনার নামে দিনরাত ফেসবুক-ইউটিউবে আসক্ত হয়ে পড়ছে। আমি আমার মনগড়া কথা এখানে বলতে আসিনি। ইতোমধ্যে আমার পরিচিত বেশ কয়েকজন অভিভাবক কথাপ্রসঙ্গে তাদের সন্তানদের ইন্টারনেট আসক্তির কথা জানিয়েছেন।
সম্প্রতি মেরিল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা ১০টি দেশের জনসংখ্যার ওপর পরীক্ষা চালিয়ে প্রযুক্তিতে আসক্তির গভীরতা নিয়ে জানার চেষ্টা করেছেন। গবেষণায় দেখা যায়, কিশোরদের ২৪ ঘণ্টা মুঠোফোন ব্যবহারের সুযোগ না দিলে তারা চরম মাত্রায় বিরক্তি প্রকাশ করে। মুঠোফোন না পাওয়ার সময়টাকে ‘একাকী’, ‘হতাশা’ আর ‘মৃত্যু’ বলে জানাচ্ছে ১২ থেকে ১৯ বছর বয়সী শিশু-কিশোর-তরুণেরা। সাইকোথেরাপিস্ট ন্যান্সি কোলিয়ের ভাষ্যে, ‘প্রযুক্তিতে আসক্তি মাদকাসক্তির মতোই। যে আসক্ত, সে কখনই টের পাবে না। প্রযুক্তিতে আসক্তির কারণে মানসিকভাবে অপুষ্ট মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের শিক্ষক বি এম মইনুল হোসেন বলেন, ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছে, মুঠোফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছে, ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছে। এই বিকাশকে আমরা ইতিবাচক হিসেবে দেখলেও অন্যদিকে প্রযুক্তিতে আসক্তি বাড়ছে জ্যামিতিক হারে। সাইবার ক্রাইমের মতোই অনলাইন প্রযুক্তি দুনিয়ার সাইবার স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবনার সময় চলে এসেছে বলে মনে করেন তিনি।
প্রযুক্তিতে আসক্তির কারণে নীরবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কিশোরেরা। মানসিকভাবে কিশোরদের অস্থির ও অধৈর্য করে তোলে প্রযুক্তির মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার। পড়াশুনায় অমনোযোগিতা, ইভ টিজিংসহ বিভিন্ন অসামাজিক কাজে প্রযুক্তিতে আসক্ত কিশোরেরা যুক্ত হচ্ছে। দল বেঁধে নারী শিক্ষার্থীদের বিরক্ত করা, ফটোশপের মাধ্যমে ছবি পরিবর্তন করে সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন করার ঘটনাও ঘটছে প্রতিনিয়ত।
শিশু-কিশোররা ইন্টারনেট তথা ভার্চুয়াল জগতের অপব্যবহারের প্রধান শিকার হচ্ছে, কারণ সীমাহীন কৌতূহল নিয়ে নতুন কিছু জানার আগ্রহে তারা ইন্টারনেট ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু এর অনিরাপদ ব্যবহার তাদের নিরাপত্তাকেও কতটা ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে, সেটা আমরা অভিভাবকরা হয়তো অসচেতনার কারণেই অনুধাবন করতে ব্যর্থ হচ্ছি। আমাদের শিশু সন্তানের হাতে স্মার্ট ফোন তুলে দিয়ে আমরা গর্ববোধ করতে পছন্দ করি। আমরা একে অন্যকে বলি- আমার সন্তান মোবাইল-ইন্টারনেটের সব বুঝে।
১৮ বছরের কমবয়সী কারো হাতে মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়া উচিত নয় বলে জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও বিশিষ্ট নাক, কান গলা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষণার বরাত দিয়ে তিনি আরও বলেন, মোবাইল ফোন ও এর বেইজ স্টেশন থেকে আনলাইকলি ক্যান্সার, ব্রেইন টিউমার ও স্লেভারি গ্লান্ড টিউমারের ঝুঁকির শঙ্কা রয়েছে। ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত বলেন, বিল গেটস ১৪ বছরের আগ পর্যন্ত নিজের কোনো ছেলেকে মোবাইল ফোন দেননি। মোবাইল ফোনের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে বিল গেটস জানেন বলেই দেননি।
প্রিয় অভিভাবক, আপনি আপনার সন্তানের বিষয়ে এখনই সতর্ক হোন। ভূঁইফোর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অনলাইন ক্লাসের নামে অহেতুক বাড়াবাড়িতে আপনি সায় দেবেন না, নিজের সন্তানকে ভার্চূয়াল ভাইরাসে আক্রান্তের হাত থেকে রক্ষা করুন। আপনার সন্তানের সুরক্ষার দায়িত্ব কিন্তু আপনাকেই নিতে হবে। দুই মাস লেখাপড়া না করলে যতটা না ক্ষতি হয়, এক সপ্তাহ স্মার্টফোন-ইন্টারনেট নিয়ে বসে থাকলে তার চে’ শতগুণ বেশি ক্ষতি হয়।