আবদুল্লাহ আল মোহন
১.
সুযোগ পেলেই শৈশবের স্মৃতিমাখা পাবনার নগরবাড়ি ঘাট সংলগ্ন গ্রামের বাড়িতে চলে যেতাম, প্রাণের উজ্জীবনে-নাড়ীর টানে। কারণ আব্বা-মা সেখানে বসবাস করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য-সুখ বোধ করতেন, খোলামেলা সুশীতল গ্রামীণ অকৃত্রিম পরিবেশে জীবন যাপন করতে বেশ আরাম অনুভব করতেন। আমরা, তাঁদের সন্তানেরা কয়েকজন পেশাগত কারণে ঢাকায় অবস্থান করলেও তাঁরা চিকিৎসার প্রয়োজন ছাড়া আমাদের কারো বাসাতে অবস্থান করেও সবুজঘেরা-পুকুরসংলগ্ন নিজেদের মনের মতোন গড়ে তোলা আপন আলয়ের সুখ নি:শ্বাস অনুভব করতেন না বলেই প্রতীয়মান হতো। কবে চিকিৎসা শেষ হবে আর বাড়ী ফিরে যাবেন সেই দিনক্ষণ গুনতেন। প্রয়োজনের চেয়ে বেশিদিন থাকতে চাইতেন না, আমরা চেষ্টা করেও পারিনি। বেশিদিন গ্রাম ছাড়া ঢাকায় থাকতে হবে বলে সব সন্তানের বাসাতেও গিয়ে থাকতেন না কোন বারই। যতটা গভীর টান অনুভব করতেন গ্রামীণ জীবন ও আত্মীয়-পরিজনের সান্নিধ্যে জীবন কাটাতে, তার অর্ধেকটাও অন্য কোথাও গিয়েও না বলেই অনুমান করি। বিশাল পরিবারের মহীরুহ হয়ে বেঁচে ছিলেন তিনি আমার মাকে নিয়ে, স্বজন সান্নিধ্যে। অন্য সকলকে সাথে করে বাঁচতে ভীষণই ভালোবাসতেন তিনি এবং আমার মা-ও। প্রতীক্ষায় থাকতেন আমরা কে কবে বাড়ী যাবো- সেই প্রত্যাশায়। সর্বনাশা মহামারী করোনাকালে প্রায় প্রতিটি দিনই কথা হতো-আব্বা, মা এবং ছোটভাইয়ের দু’কন্যা লাবন্য ও লুবনার সাথে। কোন কোন দিন একাধিকবারও কথা বলেছি সকলের সাথে। এত নিয়মিতভাবে আব্বা-মাসহ ভাইবোন এবং তাদের সন্তানদের সকলের সাথে পারিবারিক আলাপ-আলোচনা আগে কখনো করেছি বলেও মনে পড়ে না। গৃহবন্দিত্বকালে করোনার সংক্রমণ থেকে নিজেদের সুরক্ষার স্বার্থেই আসলে এই নিয়মিত যোগাযোগ প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছিলো।
২.
আমি, আমরা কেউ বাড়ী যাবো জানালেই আব্বা-মা অস্থির হয়ে পড়তে নিরাপদে না পৌঁছানো পর্যন্ত। মূল বাড়ীতে প্রবেশের মুখেই আব্বা সবসময় প্রিয়জনদের জন্য অপেক্ষায় বসে থাকতেন মিলঘরে। নগরবাড়ী-পাবনা মহাসড়ক সংলগ্ন আমাদের বাড়ির সামনেই গড়ে তোলা মিলঘর, যেটি অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতির হলেও বয়সের কারণে হাঁটা-চলা করতে কষ্ট হয়ে পড়া আব্বার সামাজিক সংশ্লিষ্টতার জন্য ছিলো অতি প্রয়োজনীয় লাভজনক সভাঘর। ফলে অর্থনৈতিক বিবেচনার চেয়েও আব্বার সময় কাটানোর উপযোগিতায় মিলঘরটি হয়ে উঠেছিলো আনন্দ আশ্রম। বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টতার দায়-দায়িত্ব তিনি পালন করতেন এই মিলঘরটিতে বসেই। আব্বার পৌরহিত্যে মিলঘরটি হয়ে উঠেছিলো মিলনঘর, স্বজন সমাবেশের মহাসড়ক ধরে সকলেই এসে থামতেন তাঁর মিলনঘরে। সেই মিলঘর কিংবা মিলনঘরটি খালি পড়ে আছে, বন্ধ আছে, কেবলই আসরের প্রাণশক্তি আব্বাই আর নেই, বসবেন না সেখানো ঘর আলো করে। ভাবতেই পারি না, পারছি না- বাড়ীর প্রবেশপথে দারুণ উৎকণ্ঠায় অপেক্ষমান ভালোবাসার আলো জ্বালিয়ে পরিবারের সবচেয়ে পরম শ্রদ্ধার মানুষটি।
৩.
আব্বা, আপনি যেখানেই থাকুন- আলো করে থাকুন, এবং অবশ্যই ভালো থাকুন, এর চেয়ে আর কী-ই-বা চাইতে পারি ?
আবদুল্লাহ আল মোহন/২৩ মে, ২০২০