আবদুল্লাহ আল মোহন : যথাযথ মর্যাদায় ঢাকার ভাসানটেক সরকারি কলেজে বিজয় দিবস পালিত হয়েছে। দিনের শুরুতে সূর্যোদয়লগ্নে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। বেলা ১১টায় কলেজ মিলনায়তনে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়। সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত পরিবেশনার মধ্য দিয়ে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান শুরু হয়। অনুষ্ঠানের শেষপর্বে মহান বিজয় দিবস-২০২০ উপলক্ষে আয়োজিত বিভিন্ন বিষয়ের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থৃীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করা হয়। অনুষ্ঠানে মুজিববর্ষে জাতির পিতার স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ প্রতিষ্ঠা করার গভীর প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মাহমুদা খাতুন, বিশেষ অতিথি ছিলেন শিক্ষক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ড. বজলুর রহমান রফিক, সভাপতিত্ত্ব করেন বিজয় দিবস পালন কমিটির আহ্বায়ক হাবিবুর রহমান ভূঞা। আলোচনা অনুষ্ঠানে ‘খুঁজে দেখা : বাংলাদেশের হৃদয় হতে’ শীর্ষক গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ভাসানটেক সরকারি কলেজের মুজিব জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক, এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আবদুল্লাহ আল মোহন। উল্লেখ্য, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ‘মুজিববর্ষ’ উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর জীবন দর্শন ও কর্ম নিয়ে কলেজ কর্তৃক ‘মুজিববর্ষ’ পালন আয়োজনমালার অংশ হিসেবে গবেষণা প্রবন্ধটি রচিত হয়। শিক্ষার্থীরা ছাড়াও আলোচনায় অংশ নেন কলেজের শিক্ষক আসমা আহসান, ড. সমীরণ সরকার, নুপূর দত্ত, আতিয়া খন্দকার প্রমুখ।
অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথির বক্তৃতায় কলেজের শিক্ষক পরিষদের সম্পাদক এবং দর্শন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. বজলুর রহমান রফিক বলেন, বাংলাদেশের অভ্যুদয় বিশ্ব ইতিহাসে গৌরব দীপ্ত অধ্যায়। একাত্তরে সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধ বাঙালীর আত্মত্যাগ, প্রাণ বিসর্জন, মা-বোনের সম্ভ্রম হারানোর মর্মন্তুদ বেদনায় ভরপুর। দীর্ঘ নয় মাস বাঙালি স্বদেশে, রণাঙ্গনে ও প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে জীবনযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। বহুজনের বিবিধ বিসর্জন শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় পতাকা ওড়ে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পাকিস্তানি দখলদারদের হাত থেকে মুক্ত হয়ে বাঙালির জাতির বিজয় অর্জনের মহিমান্বিত দিন ১৬ ডিসেম্বর। বাঙালির হাজার বছরের জীবন কাঁপানো ইতিহাস মহান স্বাধীনতা। যা আমাদের বাঙালির জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। বাঙালি জাতির লালিত স্বপ্ন স্বাধীনতা। দীর্ঘ ২৩ বছর রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রাম ও ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় অর্জন এ বিজয়। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ এবং স্বাধীনতার ৫০ বছর- তাই এবারের বিজয় দিবস ভিন্নমাত্রা নিয়ে বাঙালির জীবনে এসেছে।
প্রধান অতিথির ভাষণে কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মাহমুদা খাতুন বলেন, স্বাধীনতার নির্মোহ ইতিহাস যারা বিশ্বাস করেন না, তারা প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না। এই স্বাধীনতা বিরোধীদের স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতি করার কোনো সাংবিধানিক অধিকার থাকতে পারে না। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীদের নিয়ে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অক্ষুন্ন রেখে বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে সম্মুখপানে, অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে, সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে। শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, মেধা-মনন, সাহস ও সত্যনিষ্ঠায় নিজেকে সোনার মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তাহলেই বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে তোলা সম্ভব হবে। সেই সঙ্গে সার্থক হবে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের আত্মদান আর অগণিত মানুষের অবর্ণনীয় ত্যাগ-তিতিক্ষা। মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের আনুষ্ঠানিকতার মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংগ্রাম, অর্জন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে। তাহলেই সার্থক হবে মহান বিজয় দিবসের সব আনুষ্ঠানিকতা।
অনুষ্ঠানে সম্প্রতি কলেজে স্থাপিত ‘বাংলাদেশের হৃদয় হতে’ ম্যুরালচিত্রকে কেন্দ্র করে গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে গবেষক আবদুল্লাহ আল মোহন জানান, ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গরদ আন্দোলন শুরু হলে ১৯০৬ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি রচনা ও সুরারোপ করেন। এছাড়া ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি’ গানটিও একই সময়ে রচিত হয়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাউল সুরের স্বদেশপর্বের ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে’ গানগুলো রূপক অর্থে লেখা। প্রতীকী অর্থে দেশের প্রতি মমতা প্রদর্শন। এসবের সাথে কোন ধর্মীয় আবেগ জড়িয়ে নেই। আছে শুধু দেশের প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধাঞ্জলি, পরম ভালোবাসা। বাঙালি শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রাণের যোগ। ১৯৭১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলা একাডেমির সাতদিনের অনুষ্ঠানের প্রথমদিনের প্রধান অতিথি হিসেবে এসেছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। ‘ভাষা ও ভাষাবোধ’ প্রবন্ধে সৈয়দ শামসুল হক উল্লেখ করেছেন অনুষ্ঠান চলাকালীন সময়ে জুলফিকার আলী ভুট্টোর আসন্ন সংসদ অধিবেশন বর্জন করার সিদ্ধান্তটি তাঁকে জানানো হলে বঙ্গবন্ধু তাৎক্ষণিকভাবে কণ্ঠশিল্পী হুসনা বানু খানমকে কণ্ঠে ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি / তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী’ গানটি পরিবেশন করতে বলেন। এছাড়াও একাত্তরের ফেব্রুয়ারিতে হোটেল পূর্বাণীতে নবনির্বাচিত গণপরিষদের সদস্যদের সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর প্রিয় কণ্ঠশিল্পী হুসনা বানু খানমের কণ্ঠে ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে’ গানটি পরিবেশনার মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু করতে বলেন।
বিজয় দিবসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে নতুন প্রজন্মের কাছে ইতিহাস থেকে বিভিন্ন তথ্য উপস্থাপন করে গবেষক আবদুল্লাহ আল মোহন বলেন, আমাদের দুর্ভাগ্য মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে আমরা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম যখন গৌরব ছড়িয়ে দেব, তখন রাজনৈতিক লাভালাভের জন্য আমাদেরই কোনো কোনো পক্ষ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বারবার কুয়াশার চাদরে ঢাকতে চেয়েছে। কিন্তু সূর্যকে তো আটকে রাখা যায় না। তাই সত্য সামনে চলে আসেই। এ কারণেই নতুন প্রজন্মকে বারবার ফিরিয়ে আনতে হয় ইতিহাসের কাছে। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যৃন্ত আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং এর পূর্বাপরকে উল্লেখ করেন জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা তুলে ধরে গবেষক আবদুল্লাহ আল মোহন বলেন, বাঙালির মহাজাগরণের পথিকৃৎ, স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা ও মহান স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজীবন বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছেন। বারবার কারাবরণ করেছেন। জেল-জুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন, মামলা-হামলা সবকিছু উপেক্ষা করে নিজ আদর্শে অবিচল থেকেছেন। অন্যায়ের সঙ্গে তিনি কখনও আপস করেননি। কখনও মাথা নত করেননি। ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি বাঙালির অধিকারের কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন- ‘আমি বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলা আমার দেশ।’ দেশপ্রেম যে বঙ্গবন্ধুর সত্তা ও চেতনার গভীরে প্রোথিত ছিল, তার পরিচয় আমরা পাই যখন ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকীতে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় পূর্ববাংলার নামকরণ করেন ‘বাংলাদেশ’। উল্লেখ্য যে, ১৯৪৮ সালের ২১ নভেম্বরে নারায়ণগঞ্জের বায়তুল আমানে ছাত্রলীগের মহকুমা সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান সভাপতিত্ব করেন। সেখানেই তিনি প্রথম উচ্চারণ করেন ‘বাংলাদেশ’ কথাটা।
গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে গবেষক আবদুল্লাহ আল মোহন আরো বলেন, একটি উজ্জ্বল ও সমৃদ্ধ অতীত ধারণ করে আছে বাংলার ইতিহাস। এ গৌরবের ঝুলিতে অন্যতম হীরন্ময় পালক মহান মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীনতা-প্রিয় বাঙালি হাজার বছর ধরে মুক্তির লড়াই করে আসছে। ১৯৭১ ছিল এ জাতির এ যাবৎকালের শেষ লড়াই। তবে এ লড়াইয়ের সমাপ্তি টানার উপায় নেই। তাই বাঙালির মুক্তিযুদ্ধকে উপলব্ধি করতে হলে ফিরে যেতে হবে হাজার বছরের ইতিহাসে। পাকিস্তানি শাসকচক্র বাঙালির ভাষার অধিকার কেড়ে নেয়ার জন্য সচেষ্ট হয় ১৯৪৭ সাল থেকেই। আর শুরু থেকে পরাভব না মানা বাঙালির অভ্যুত্থান ঘটে এমনি করে। ১৯৪৮ এবং ১৯৫২ সালে বাঙালি ভাষা আন্দোলন নিয়ে রাজপথ প্রকম্পিত করে। রক্তমূল্যে অর্জন করে ভাষার দাবি। আর এ পথ ধরেই হাজার বছরের ঐতিহ্য নিয়ে বাঙালি অধিকার আদায়ের আন্দোলন শানাতে থাকে। অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার কোনো আপস চিন্তায় আসতে পারেনি পাকিস্তানি শাসকচক্র। তাই অধিকার আদায়ের আন্দোলন অচিরেই স্বায়ত্তশাসন- অতঃপর স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। অবশেষে ইতিহাসের স্বাভাবিক পরিণতি হিসেবেই বাঙালি অর্জন করে তার প্রত্যাশিত স্বাধীনতা।
গবেষক আবদুল্লাহ আল মোহন উল্লেখ করেন, প্রাচীনতমকাল থেকে পথপরিক্রমণ করে যদি স্বাধীন সার্বভৌম আজকের বাংলাদেশে প্রবেশ করি, তো দেখব এই ভূখণ্ডের মানচিত্রের রেখায় বহুবার রূপান্তর ঘটেছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তিত হয়েছে অনেকভাবে। রাজদণ্ডের হাত বদল হয়েছে নানা জাতির রাজন্যবর্গের কাছে। এবার পেছনে ফিরে দেখা যাক। প্রায় দু’শ বছর ঔপনিবেশিক বিট্রিশ শাসন শোষণের অবসান হলো ১৯৪৭ সালে। অখণ্ড ভারত হলো দ্বিখণ্ডিত সৃষ্টি হলো ভারত ও পাকিস্তান। ধর্মকেন্দ্রিক দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্টি হলো পাকিস্তান। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বাঙালি বুঝতে পারে, পাকিস্তান সৃষ্টির মাধ্যমে তারা প্রকৃত স্বাধীনতা পায়নি। ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর আক্রমণ, অর্থনৈতিক বৈষম্যসহ কয়েকটি সমস্যা প্রকটভাবে অনুভূত হয় বাঙালির মনে। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি মুসলিম মানসে আশার সঞ্চার করলেও পরবর্তীতে দুই অঞ্চলের বৈষম্য ও শোষণ বিশেষ করে পূর্বাঞ্চলে বসবাসরত সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালীদের দমনপীড়ন, বঞ্চনা, স্বায়ত্ত শাসন থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামে যুক্ত করে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন বাংলাভাষার স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে এক নতুন মাইলফলক। ধারাবাহিক সংগ্রামে যুক্ত বাঙালী দীপ্ত পথভারে মুখরিত হয়। পাকিস্তানের জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ জনের মুখের ভাষা বাংলা ভাষাকে অস্বীকার করে পাকিস্তানের মুসলিম লীগ সরকার উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চালায়। বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার দাবিতে শুরু হয় ভাষা আন্দোলন। এই ভাষা আন্দোলনই বাঙালির স্বাধীনতার আন্দোলন ও সংগ্রামের সূচনা পর্বের গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। ভাষা আন্দোলনের রেশ ধরেই এই দেশের রাজনীতির মোড় ঘুরে যায় স্বাধিকার আন্দোলনের দিকে। ১৯৫৪ সালে পূর্ববাংলা আইন পরিষদ নির্বাচনে মুসলিম লীগ পরাজিত হয়। যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি আসনে বিজয়ী হয়। অন্যদিকে মুসলিম লীগ ১০টি আসন লাভ করে। বাঙালী জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে। ১৯৫৪ সালের ৩ এপ্রিল এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। পাকিস্তান সরকার ৫৬ দিন মন্ত্রিসভার কার্যক্রম সচল রাখে। ১৯৫৬ সালে পূর্ব বাংলার নাম পরিবর্তিত হয়ে পূর্ব পাকিস্তান করা হয়। যুক্তফ্রন্টের অন্তর্ভুক্ত আওয়ামী লীগ ১৯৫৬-৫৮ পর্যন্ত রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৫৮ সালের ২৭ অক্টোবর আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক শাসন চালু করে। এ সময় রাজনৈতিক কার্যক্রম বন্ধ করে মৌলিক গণতন্ত্রের নামে বিশেষ বিধান বলবৎ করা হয়। ব্যাপক গ্রেফতার চলে। বাঙালি প্রতিরোধে ফুঁসে ওঠে। ১৯৬২-৬৪ পর্যন্ত ছাত্র আন্দোলন মূল ধারার রাজনীতিতে গতিবেগ সঞ্চার করে। পাকিস্তানী শাসকবর্গের দমনপীড়নের বিরুদ্ধে একাট্টা হয়ে ছাত্ররা ‘শরীফ কমিশন রিপোর্ট’ প্রত্যাহরে আন্দোলন তীব্র করে তোলে। আওয়ামী লীগের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে ৬ দফা উত্থাপন করেন। ছয় দফার মাধ্যমে স্বায়ত্তশাসনের সংগ্রাম তীব্রতর হয়। ১৯৬৮ সালে শেখ মুজিবুর রহমানকে এক নম্বর আসামি করে আগরতলা মামলা দায়ের করা হয়। ঢাকা সেনানিবাসে বিচার শুরু হয়। ৩৫ জন সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন। এ সময় আন্দোলন চলাকালে সার্জেন্ট জহরুল হক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহা, ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামন ও মতিউর রহমানকে পাকিস্তানী সামরিক সরকারের ঘাতকবাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে। সারাদেশ আন্দোলন সংগ্রাম ছড়িয়ে পড়ে। সরকার বাধ্য হয়ে অবশেষে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহর করে। ১৯৬৮ থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত ছাত্র সমাজ পাকিস্তান সরকারবিরোধী আন্দোলনের এক নতুন মাইলফলক সূচনা করে। ছাত্র সংগ্রাম কমিটির ব্যানারে ১১ দফা ঘোষিত হয়। ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিুবর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ খেতাবে ভূষিত করেন ছাত্র নেতা তোফায়েল আহমদ। ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ আইয়ুব খান ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে।
গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে গবেষক আবদুল্লাহ আল মোহন বলেন, ১৯৭০ সালে নির্বাচনে ১৬৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৬৭ টি আসনে বিজয়ী হয়। ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন নির্ধারণ করা হয়। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিল করা হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের রায়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সংসদে বসতে না পারায় জনরোষ বৃদ্ধি পায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ডাকে পাঁচদিন হরতাল পালিত হয়। ১৯৭১সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। এই ভাষণে সামরিক আইন প্রত্যাহার, সামরিক বাহিনীর সেনানিবাসে প্রত্যাবর্তন, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয় গুরুত্ব পায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। এ অঞ্চলের জনগণ স্বাধীনতার সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ ও বিভিন্ন কর্মসূচীতে অংশ নেয়। ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসে সরকার গঠন ও ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে আলোচনার নামে সময় ক্ষেপণ করতে থাকে। ইতোমধ্যে বেলুচিস্তানের জেনারেল টিক্কা খানকে পাকিস্তানের গবর্নর হিসেবে নিয়োগ দিয়ে ঢাকায় পাঠানো হয়। একদিকে আলোচনার নামে প্রহসন চলে, অন্যদিকে সামরিক বাহিনীর সদস্য ও অস্ত্রশস্ত্র আনা হয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামক গণহত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। বিদেশী গণমাধ্যমে যাতে গণহত্যা সম্পর্কে কোন সংবাদ প্রচার না পায় সেজন্য বিদেশী সাংবাদিকদের ঢাকা ত্যাগে বাধ্য করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীদের ওপর অতর্কিত হামলা করা হয়। বিভিন্ন স্থাপনা গুড়িয়ে দেয়া হয়। মেজর জেনারেলরাও ফরমান আলী ঢাকায় গণহত্যা পরিচালনা করে। পাকিস্তানী বাহিনীকে সহযোগিতা করে আলবদর, আলশামস ও রাজাকার বাহিনীর বাঙালী সদস্যরা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ঢাকার ধানমণ্ডি বত্রিশ নম্বর বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক বেতার বার্তার মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণায় বলেন ‘এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের মানুষ যে যেখানে আছেন আপনাদের যা কিছু আছে তা নিয়ে দখলদার বাহিনীর মোকাবেলা করার জন্য আমি আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎখাত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।’ প্রতিরোধ গড়ে ওঠে সর্বত্র। সেনাবাহিনী, ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীর বাঙালী সদস্যরা প্রতিরোধে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করে। দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিসেনারা প্রতিরোধ সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। ভারতে আশ্রয় নেয় শরণার্থীরা। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয় মুক্তিযুদ্ধকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য। মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথ তলায় ১৭ এপ্রিল মুজিব নগর সরকার শপথ গ্রহণ করে। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর পরাজয়ের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞ শুরু হয় পঁচিশে মার্চের মতো। রায়ের বাজার ও মিরপুর বধ্যভূমিসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বধ্যভূমিতে বুদ্ধিজীবীদের গলিত লাশের স্তূপ পড়ে থাকতে দেখা যায়। স্বজনরা ভিড় করেছে। অনেক প্রিয়মুখ খুঁজে পাওয়া যায়নি। বহির্বিশ্বে জনমত গঠনে মুজিবনগর সরকার নিরন্তর কাজ করে। দীর্ঘ নয় মাস মুক্তি সংগ্রামে অংশ নেয়া যোদ্ধা ও বীরের আত্মত্যাগে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ‘বাংলাদেশ’ পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান অধিকার করে।
গবেষক আবদুল্লাহ আল মোহন প্রবন্ধ শেষে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, একাত্তরে এ দেশের ওপর দিয়ে প্রচণ্ড এক ঝড় বয়ে গিয়েছিল। মার্চ থেকে ডিসেম্বর- এ কয়টি মাস বারুদের গন্ধে বাতাস হয়েছিল ভারী। চারদিকে অগুনতি লাশ, আর্তনাদ আর স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ গণহত্যা। বেঁচে থাকার প্রবল আকুতি নিয়ে এক কোটি মানুষ চৌদ্দপুরুষের ভিটে ছেড়ে সীমান্তের ওপারে আশ্রয় নিয়েছিল। এর মধ্যেই চলেছিল সাধারণ মানুষের প্রতিরোধ সংগ্রাম, সশস্ত্র লড়াই, মুক্তিযুদ্ধ। একটি মানবশিশু জন্ম নিতে যে কয়েক মাস সময় লাগে, প্রায় ততটুকু সময় নিয়ে আমাদের এই দেশ চোখ মেলে তাকিয়েছিল, জেগে উঠেছিল ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে। এ বছর সেই মহান বিজয় দিবসের ৫০ বছর পূর্ণ হচ্ছে। দীর্ঘদিনের বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলন, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ, নয়মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধা ও বিজয়ের ৫০ বছর সম্পর্কে দেশপ্রেম ও মূল্যবোধের স্বার্থে বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মকে সঠিকভাবে জানানোর দাায়িত্ব নিতে হবে আমাদের সকলকে। জানানোর দায়িত্ব নিয়ে বলতে হবে: একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির ইতিহাসে এক অমর গৌরবগাথা আর একাত্তরের বিজয়- মহত্তম অর্জন। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী হয়ে এবং অনুপ্রাণিত হয়ে দারিদ্র্যমুক্ত, নিরক্ষরমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক, আলোকিত ও ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার সংগ্রামে আমরা দৃঢ় থাকব। কেননা অনেক রক্ত দিয়ে এদেশের স্বাধীনতাকে অর্জন করেছি।