Sunday, মে ১৯, ২০২৪
শিরোনাম

বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম স্মরণগ্রন্থ : আলোকিত জীবনের উদ্দীপ্ত রেখাচিত্র

শেয়ার করতে এখানে চাপ দিন

আবদুল্লাহ আল মোহন


১.
সোনালি আঁশের সোনালি মানুষ, পাটের জীবন রহস্যের উদ্ভাবক, জিন বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম। ২০১০ সালে বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম-এর নেতৃত্বে “স্বপ্নযাত্রা” প্রকল্পের একটি টিম পাটের জীবন রহস্য উন্মোচন করে দেশে-বিদেশে দারুণ সাড়া ফেলেন। এতবড় একটি কাজ তিনি করেছিলেন সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাশ্রমে, এরজন্য একটি টাকাও নেননি বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে। বাংলাদেশের হয়ে পাট ও ছত্রাকের জীবনরহস্যের উন্মোচক বিজ্ঞানের স্বপ্নপুরুষ মাকসুদুল আলম ২০১৪ সালের ২০ ডিসেম্বর চলে যান না ফেরার দেশে। স্বদেশের প্রতি তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য ২০১৬ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা “স্বাধীনতা পদক” প্রদান করে। তাঁর জন্ম ঢাকায়, ১৪ ডিসেম্বর ১৯৫৪ সালে। তাঁর বেড়ে ওঠা, স্কুল-কলেজের পড়াশুনাও ঢাকায়। পরবর্তীতে তিনি রাশিয়া ও জার্মানিতে উচ্চশিক্ষা শেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই-এ স্থায়ী হন। তিনি হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক এবং চেয়ারম্যান ছিলেন। মহান এই মানুষ, অনন্য বিজ্ঞানীর জীবনীকর্মের স্মৃতিময় “বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম স্মরণগ্রন্থ” অবশেষে একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়।
২.
ড. মাকসুদুল আলম, বাংলাদেশের ইতিহাসে গর্বের এক নাম। জীববিজ্ঞানের জগতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। যিনি তাঁর গবেষণা ও আবিষ্কার দিয়ে কৃষিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে গেছেন। তিনটি উদ্ভিদ ও ছত্রাকের জিনোম সিকুয়েন্সিং করে যিনি স্থান নিয়েছেন সেরা সেরা কিছু বিজ্ঞানীর তালিকায়! বাংলাদেশে অনেক হতাশার মধ্যে আশার আলো জাগিয়ে সফল হয়েছিলেন বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম ও তাঁর বিজ্ঞানী দল। মৃতপ্রায় পাটশিল্প আর হাল ছেড়ে দেওয়া পাটচাষি। এই ছিল ২০১০ এর আগের এক দশকজুড়ে বাংলাদেশের পাট নিয়ে পরিচিতি। ২০১০ সালে ১৬ জুনে বাংলাদেশের পাট নিয়ে কীর্তির এক নতুন অধ্যায়ের কথা জানল বিশ্ব। বাংলাদেশের বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম ও তাঁর দল পাটের জীবনরহস্য উন্মোচন করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিল। এরপর ২০১২ সালে পাটসহ বিশ্বের ৫০০টি উদ্ভিদের প্রধান শত্রু ছত্রাকের জীবনরহস্য উন্মোচন করেন মাকসুদুলের দল। আর সর্বশেষ ২০১৩ সালের আগস্টে সাদা দেশি পাটের জীবনরহস্য উন্মোচনের মধ্য দিয়ে পাট বললেই বিশ্ব যে এখন বাংলাদেশকে বোঝে, তার ষোলকলা পূর্ণ হয়। এসব কৃতিত্বের প্রধান কারিগর ছিলেন বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম। অজানালোকে চলে যাওয়ার আগে আরেকটি বড় সম্পদ দেশের জন্য রেখে গেছেন মাকসুদুল আলম। পাটের দুটি জাত ও ছত্রাকের জীবনরহস্য উন্মোচনের ফলাফলের স্বীকৃতি ও জ্ঞানতাত্ত্বিক স্বত্বাধিকার নিশ্চিত করার পথেও দেশকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যান তিনি। এভাবেই বিজ্ঞান গবেষণার মাঝে প্রাণ উদ্দীপনা জাগিয়েছেন আমৃত্যু এই মহান মানুষটি।
৩.
এই অনন্য ব্যক্তিত্বকে নিয়ে আলোচিত “বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম স্মরণগ্রন্থ”। বাংলা ও ইংরেজি- দ্বিভাষিক এই স্মরণগ্রন্থটিতে উঠে এসেছে বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলমের জীবনের নানান অনালোচিত অধ্যায়, বিষয়। তাঁর দেশপ্রেম, নিরলস সাধনার গবেষণায় একাগ্রতার পরিচয় যেমন মেলে তেমনি জানতে পেরে প্রাণিত হই দেশ-দেশান্তরে বিজ্ঞান গবেষণায় নিবেদিত থাকলেও স্বদেশের উন্নয়ন ভাবনার অকৃত্রিম প্রচেষ্টাকে। স্মৃতিকাতর করে তোলে, আগ্রহ জাগায় জানতে দেশের জন্য নিবেদিত বিজ্ঞান সাধকের স্বপ্নময় গবেষণাগারের অগ্রগতি কতটা হয়েছে। আমাদের সরকার ও সংশ্লিষ্টজনদের আন্তরিক উদ্যোগের খবর জানতেও দারুণ উৎসাহ জাগে। বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলমের জীবন ও নানাবিধ কর্মকাণ্ড নিয়ে রচিত বিভিন্ন প্রবন্ধ, নিবন্ধ, সাক্ষাৎকারসহ রয়েছে সংশ্লিষ্ট প্রকাশিত সংবাদ, প্রতিবেদন। শোকাঞ্জলি, স্মরণ, শ্রদ্ধা নিবেদন, স্মৃদিপদ্যের পাশাপাশি স্থান পেয়েছে সরকারের গেজেট, মন্ত্রী পরিষদের শোক প্রস্তাব।বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলমের নিজের কথার সাথে রাফিয়া হাসিনা আলম-এর স্মৃতিতে মাকসুদ রচনাও মনে দাগ কাটে। পারিবারিক চিঠি পাঠও আবেগতাড়িত করে। সংযোজিত বাছাইকৃত ছবিগুলোও বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলমের জীবনকে জানার আগ্রহকে তীব্র করে, তাঁর অনন্য জীবনের চলার পথকে অনুসরণ করতে উদ্দীপনা জাগায়।
৪.
স্মরণগ্রন্থটি প্রকাশ করছে প্রকাশনা সংস্থা ‘ঐতিহ্য’। শাহেদ কায়েস সম্পাদিত গ্রন্থের প্রচ্ছদ শিল্পী এ আর নাইম, মূল্য: বারোশত টাকা। মনে রাখবার মতোন স্মরণীয় মানুষের প্রতি যাদের আগ্রহ, উৎসাহ রয়েছে, তাদের জন্য এই স্মরণগ্রন্থটি একটি মহামূল্যবান সংগ্রহ হবে বলেই বিশ্বাস করি। আর বিজ্ঞান গবেষণায় নিবিড়ভাবে পথ চলতে, স্বপ্নকে সদর্থক করতে শিক্ষার্থী, নবীন গবেষকদের জন্য স্মরণগ্রন্থটি হতে পারে একটি আকরগ্রন্থ, স্বর্ণ খনি। অনন্য বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলমের পরিবারের সদস্যবৃন্দ বিশেষত স্ত্রী রাফিয়া হাসিনা আলমসহ গ্রন্থ সম্পাদক, সম্পাদনা পরিষদ, বিজ্ঞানীর সহকর্মী ও লেখক, প্রকাশককে জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ, অশেষ কৃতজ্ঞতা একটি প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ উপহার প্রদানের জন্য। গ্রন্থটির বহুল পাঠ, প্রচার ও আলোচনা প্রত্যাশা করছি।
৫.
পাটের কৃষিক্ষেত্রে গবেষণার কাজ পরিচালনায় বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় অবদান রেখে গেছেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ে উঠেছে সেই সোনার দেশের সোনার ছেলে বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম। তিনি পাট ও ছত্রাকের জীবনরহস্য উন্মোচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় গৌরব বয়ে এনেছেন। বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলমের ইচ্ছে ছিল বাংলাদেশে একেবারে চলে আসার, সেটা তিনি বলেছেনও তাঁর কাছের অনেককে। দেশে ফিরে এসে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের জন্য কাজ করতে চেয়েছিলেন তিনি। খুব অল্প সময়ে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন তিনি, দীর্ঘ জীবন পেলে মানুষ ও প্রাণ-প্রকৃতির কল্যাণে আরও কাজ করার সুযোগ পেতেন। বাংলাদেশের মানুষ তাঁকে আজীবন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে।

আবদুল্লাহ আল মোহন
১৯.৪.২০২০

শেয়ার করতে এখানে চাপ দিন

সর্বশেষ খবর