আবদুল্লাহ আল মোহন
১.
‘মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়ো’ প্রত্যয়কে গভীরভাবে অন্তরে ধারন করেন বলেই বই পড়ার মাধ্যমে মানুষকে বড়ো করার প্রক্রিয়ার নিরলস পরিব্রাজক হয়ে ওঠা ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। কারণ তার কাছে বই মানে চিন্তা, মনন, আত্মিক-মানসিক উৎকর্ষতা। সেই সৃজনীশক্তি বিাকাশে-প্রকাশে অন্তহীন প্রক্রিয়া চলমান রাখতে সক্রিয় প্রাণ অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। কাজের জন্য নিরন্তর হাঁটায় বিশ্বাসী মানুষটি শিক্ষার্থীদের মনে রুচি, মানবিক মূল্যবোধ জাগাতে চেয়েছেন। জ্ঞানের চেয়ে দক্ষতা অর্জনকেই বড়ো বলে মনে করেন। সংকীর্ণ মানুষে ভরে যাচ্ছে জগতটা। আমাদের ছেলেমেয়েদের বড়ো করতে চাইলে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠত্বের কাছে নিয়ে যেতে হবে। সেক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি কার্যকরী ও উপযোগী ভূমিকা রাখতে পারে- বই। স্যার সুন্দর করে বলেন, ‘জ্ঞানের উৎস হল হৃদয় এবং বইয়ের মধ্যেই বিশ্বের বিখ্যাত মানুষের আত্মার আলো লুকায়িত থাকে।’ অসাধারণ বক্তা সায়ীদ স্যার প্রায়ই বলে থাকেন, ‘চারদিকে শুধু দেয়াল থাকা গুদাম ঘরে মানুষ বসবাস করতে পারে না। মানুষকে বাঁচতে হলে ঘরের দেয়ালে দরজা জানালা থাকতে হয়। তেমনি জীবনে বড় হতে হলে কিছু ফাঁকা জায়গা রাখতে হয়; তা পূরণ করতে হয় জ্ঞান দিয়ে। বই পড়ে। সমাজের জন্য রাষ্ট্রের জন্য আলো ও আলোকিত মানুষ, দুটোই প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদের মধ্যে আলো না থাকলে আলোকিত সমাজ, দেশ হবে না।’
২.
শব্দে-বাক্যে সপ্রতিভ ‘কণ্ঠস্বর’ অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। তিনি হাস্যরসের মাধ্যমে সময়কে উজ্জ্বীবিত করে রাখতে জানেন, শিক্ষার্থীকে জাগিয়ে তুলতে পারেন। বহুমাত্রিক কাজের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ ‘সমুজ্জ্বল’ জীবনের গোলাঘর হয়ে উঠেছে ‘সোনালি শস্যকণা’। ব্যক্তি মানুষ এবং শিক্ষক, উপস্থাপক, সম্পাদক, সমাজ সচেতন কর্মী, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন সামাজিক দায়িত্বশীল কাজের সংগঠকের সমৃদ্ধ জীবনকর্মের অমূ্ল্য ভাবসম্ভার সংকলন গ্রন্থটি। কথকতায়, শব্দ চয়নে সরসতায় ভরা থাকলেও অর্বাচীনতার ছোঁয়া নেই বইটিতে। আপন জীবনীশক্তি ও চেতনার, উপলব্ধি ঘরের সোনালি দরোজা খুলে দিয়েছেন দ্বিধাহীনতায়। ‘সোনালি শস্যকণা’য় অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ- এর বিভিন্ন রচনা থেকে একরাশ উজ্জ্বল উদ্ধৃতির সংগ্রহ, সংক্ষিপ্ত উপস্থাপন এক নজরে বুঝতে, চিনতে দারুণ সহায়ক হবে বলেই ধারণা করি।
৩.
জীবনের অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধমান ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। বইটির পাতায় পাতায় প্রিয় সরস কথককে, চেনা কর্মী মানুষটিকে খুঁজে পাই। রবি ঠাকুরের ভাষায়, ‘আলো পাতার ফাঁকে ফাঁকে’। জীবনে প্রতিটি কাজের চলতি ‘পথে পথে পাথর ছড়ানো’ ছিলো কিন্তু আজন্মের স্বপ্ন ও নিরলস প্রচেষ্টার অমূল্য ‘সরস’ এবং ‘তির্যক’বাক্য-বাণের সংগ্রহশালা, জীবনের জাদুঘর গড়ে তোলা হয়েছে- ‘তাই তো বাণী বাজে ঝর্ণা ঝরানো’। এই সংকলন গ্রন্থটির শুরু হয়েছে ‘সামান্য ও শ্রেয়ের পার্থক্য আমাদের কাছে আছে, মৃত্যুর কাছে নেই’ বক্তব্য দিয়ে। বইয়ের শেষে গিয়ে পাই, ‘সংকলনও এক ধরনের সংজ্ঞা। পার্থক্য : সংজ্ঞা সবকিছুসহ ছোট হয়ে আসে, সংকলন অনেককিছু বাদ দিয়ে ছোট হয়।’ (পৃ:৩৭২)
৪.
৩৭৫ পৃষ্ঠার বইটি ১৬টি বিষয় ভিত্তিক সূচিতে সাজানো হয়েছে। সূচিতে রয়েছে : জীবন ও মৃত্যু, উদ্যম, প্রকৃতি ও সৌন্দর্য, শিল্প-সাহিত্য, স্বদেশ, শৈশব, যৌবন ও বার্ধক্য, মূল্যবোধ, বন্ধুত্ব, প্রেম ও দাম্পত্য, সংগীত, স্বপ্রসঙ্গ, আলোকিত মানুষ, বই, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, শিক্ষা, শিক্ষার্থী ও শিক্ষক, ধার্মিকতা এবং বিচিত্র প্রসঙ্গ। বাঙালির সংগঠন ও স্বাস্থ্য চেতনা নিয়ে ভুক্তি থাকলে সমৃদ্ধতর হতো বইটি। আছেও অনেক উক্তি ছড়িয়ে ছিটিয়ে এই সংকলনে। কাজের সুবাদেই জানি বাঙালির সংগঠন ও স্বাস্থ্য চেতনা নিয়ে সায়ীদ স্যারের রয়েছে আলোকিত উচ্চারণ, গভীর অসুখের অনুধাবন। তারই প্রমাণ রয়েছে স্যারের ‘সংগঠন ও বাঙালি’ বইটিতে।
৫.
আজন্মের শিক্ষক, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের সাথে কাজ করতে গিয়েও জেনেছি ‘গুরু’বাদকে বাদ দেওয়া যায় না, যখন বলেন, ‘প্রকৃত ‘গুরু’ তিনিই, যাঁকে মানার দরকার হয় না।’(পৃ:৩৫৪) আর তাই কাজই হচ্ছে তার কাছে প্রকৃত ধর্ম, ‘কাজ হচ্ছে গঙ্গাজল। সমস্ত অক্ষমতা ভাসিয়ে নিয়ে সে আমাদের শক্তির জগতে মুক্তি দেয়।’(পৃ:৬৩) আমি নিজেও শিক্ষকতা করতে গিয়ে মনে পড়ে সায়ীদ স্যারের অনেক আহ্বান, ‘আশা এবং কাজ দিয়ে তৈরি হয়েছে আজকের বিশ্বচরাচর। আসেন কাজ করি, চারপাশটা ভরিয়ে দেই কাজের বাগানে বসরাই গোলাপ বাগান তৈরি করে।’ স্মরণ করি অমূল্য উপলব্ধি, ‘আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন স্কুলগুলো ছিল কাঁচা, মাস্টাররা ছিল পাকা। আজকে স্কুলগুলো পাকা হয়ে গেছে; মাস্টাররা বিদায় নিয়েছে।’ (পৃ:৩৫৪) ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’ সাধনার সাধকের সাহিত্য ও মানুষের তুলনামূলক ভাবটিও স্মরণযোগ্য, ‘সাহিত্যের মতো মানুষও দু-রকম: সাম্প্রতিক ও চিরায়ত।’ (পৃ:৩৭০) আমরা কোন প্রকারের মানুষটি হতে চাই, সেই চেতনাকেই জাগিয়ে তোলেন তিনি এই উপস্থাপনায়।
৬.
সমাজ-সংসারে, জীবনে যারা কিছু কাজ করতে চান, জীবনকে অর্থময়তায় যাপন করতে আগ্রহী অবশ্যপাঠ্য ‘চারুপাঠ’ হয়ে উঠবে সে প্রত্যাশা করতেই পারি। কারণ সংকলণ গ্রন্থটি হয়ে উঠেছে তার বৈচিত্র্যময় জীবনাদর্শের অনন্য ভাণ্ডার, ভাবনার বীজাগার। ‘সোনালি শস্যকণা’ সম্পাদনা করেছেন আসলাম আহসান। প্রকাশ করেছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ২০২০, মূল্য :৪৫০.০০। প্রচ্ছদ এঁকেছেন মাসুম রহমান। কোন উৎসর্গপত্র নেই, থাকা দরকার ছিলো। সম্পাদনাকারীর পক্ষ থেকে ‘সোনালি শস্যকণা’র অনন্য কথকের ‘বিভিন্ন সময়ে নানান কাজের সহযাত্রীদের প্রতি’ নিবেদিত হলে ‘সোনার হাতে সোনার কাঁকন’ মর্যাদা বৃদ্ধি করতো বলেই বিশ্বাস। ‘সম্পাদকের অনুভুতি’র বক্তব্যের শেষপ্রান্তে ‘অতিভক্ত ও বিশ্বনিন্দুকদের আরোপিত বিশেষণে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের স্বাভাবিক চেহারা ঢেকে যাবার আগেভাগে বইয়ের কাজটি শেষ করতে পেরে স্বস্তি বোধ’ করার সংশয়বাক্যটি বোধগম্য হলো না, কেন সম্পাদকের এই দ্বিধা-ভয়-ভীতি, অনাস্থা-অবিশ্বাস সংকলন গ্রন্থটির কথক-নায়ককে ঘিরে? গ্রন্থে উল্লেখিত অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের অনেক উক্তি-বাণী-বক্তব্যই হয়তবা অবিতর্কিত নয়, কিন্তু তাই বলে তার সারাজীবনের কাজের অভিজ্ঞতার নির্যাস অনুভব বচনকে অস্বীকার করাটাও সুবিবেচনার হবে না বলেই মনে করি। আরেকটি বিষয়ের প্রতিও নজর দেওয়া দরকার। বিস্রস্ত জর্নালের লেখাগুলোর শেষে রচনার তারিখ সংযোজিত ছিলো। এই সংকলনেও তেমনটি রাখা জরুরি ছিলো সময়ের প্রেক্ষিতটা সঠিকভাবে অনুধাবনের প্রয়োজনেই। তা না হলে অনেক উক্তির যথার্থতা নিয়ে ভুল ব্যাখ্যার অবকাশ থেকে যায়, বিশেষত রাজনৈতিক মতামতের দৃষ্টিতে।
৭.
যাদের জন্য বইটি সবচেয়ে বেশি উপকারী, প্রয়োজনীয় হতে পারে বলে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, সেই তাদের বিশেষত শিক্ষার্থী পাঠকের ক্রয় ক্ষমতার কথা বিবেচনায় রেখে ‘সোনালি শস্যকণা’র সাশ্রয়ী মূল্যের সুলভ বা পেপারব্যাক সংস্করণ প্রকাশ জরুরি বলেই মনে করি। ‘ম্যাক্সিম’ বা প্রবাদ-প্রবচন হয়ে ওঠার সম্ভাবনা জাগানো এই প্রজ্ঞান গ্রন্থটির বহুল পাঠ, প্রচার ও আলোচনা কামনা করছি।
আবদুল্লাহ আল মোহন
২৭ এপ্রিল, ২০২০