Monday, ডিসেম্বর ১১, ২০২৩
শিরোনাম
ডলি সায়ন্তনীকে নির্বাচনে চান পাবনার সংস্কৃতিকর্মীরাওনার্স পরিচয় দেন ডাক্তার, দিচ্ছেন সর্ব রোগের চিকিৎসাডলি সায়ন্তনীর প্রার্থীতা ফেরার অপেক্ষায় সুজানগর, আমিনপুরের মানুষঅবহেলা অব্যবস্থাপনায় অকার্যকর পাবনার সেচ উন্নয়ন প্রকল্প, বিপাকে কৃষকসাঁথিয়ায় ভোটার হালনাগাদকারীদের পাওনা দিতে গরিমসি করছেন নির্বাচন অফিসারআটঘরিয়ায় গলায় ফাঁস দিয়ে গৃহবধূর আত্মহত্যা, স্বামী আটকসাঁথিয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রবেশ পথে মন্দির নির্মাণ করার চেষ্টা ॥ জনমনে অসন্তোষসাঁথিয়ায় চলাচলের রাস্তায় বেড়া,অবরুদ্ধ ১৬ পরিবারআটঘরিয়ায় বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট উদ্বোধনবেড়ায় পাট ক্ষেত থেকে ভ্যান চালকের লাশ উদ্ধার

রবি বাউলের খোঁজে : জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

শেয়ার করতে এখানে চাপ দিন

আবদুল্লাহ আল মোহন


১.
বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য স্রষ্টার নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার মত করে এমনভাবে দু’হাত উজাড় করে বাংলা সাহিত্যকে বহুবিধ অমূল্য রত্নভাণ্ডার আর কেউ উপহার দিতে পারেন নি। রবি ঠাকুর প্রায় একক প্রচেষ্টাতেই সমৃদ্ধবান করে তুলেছেন, বিশ্বসভায় বাংলাসাহিত্যকে সগৌরবে উচ্চ আসনে বসিয়েছেন। নিরন্তর সৃষ্টি করেছেন তিনি। তার মত এরকম ঐকান্তিক একাগ্রতায় সারা জীবনব্যাপী শুধুমাত্র সাহিত্য সৃষ্টি আর কোনো সাহিত্যিকের দ্বারা সম্ভবপর হয়নি। না এই অঞ্চলে, না সারা বিশ্বে। সচ্ছল পরিবারে জন্ম হওয়ার কারণে জীবিকা নিয়ে তাকে তেমন খুব বেশি ভাবতে হয়নি কখনো। ফলে, আমৃত্যু তিনি সার্বক্ষণিক সাহিত্য সৃষ্টির জন্য, আপন কাজটি করার জন্য অফুরান সময় পেয়েছেন। আর সেই সুযোগকে পূর্ণভাবে তিনি কাজে লাগিয়েছেন তার অবিরাম আগ্রহ, নিরলস প্রচেষ্টা এবং ক্লান্তিহীন লেখালেখির মাধ্যমে। সেই কৈশোর বয়স থেকে যে তরী তিনি ভাসিয়েছেন সাহিত্যের স্রোতস্বিনীতে, তার সফল সমাপন ঘটেছে মরণ সাগরের তীরে এসে। একজন মানুষের জীবন ও কর্ম-পরিধির আলোকে রবীন্দ্রনাথ বাঙালি সংস্কৃতির সর্বোচ্চ ও সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত। তার ভেতর সর্বাধিক পরিমানে প্রকাশ ঘটেছে বাঙালির সৌন্দর্যবোধ ও মননশীলতার উপাদানসমূহ। আর তাই রবীন্দ্রনাথ নিজেই রবির ন্যায় উজ্জ্বলতম। তাকে বাংলা ভাষা-ভাষীদের মাঝে পরিচয় করে দেওয়ার প্রচেষ্টা মূর্খতা বা ধৃষ্টতার সামীল। তবুও পরিচয় তুলে ধরতে গিয়ে সবকিছু ছাপিয়ে বিশেষভাবে উল্লেখ্য একটি বিশেষণকেই আমরা বেশি ব্যবহার করি, ‘কবিগুরু’। কবিগুরু রবি ঠাকুরের জন্ম ১৮৬১ সালের ৭ মে(১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ) আর মৃত্যু ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট (২২ শ্রাবণ ১৩৪৮)। এই প্রায় আশি বছরের জীবনের সময়কালে বাংলাদেশ, বাঙালি সমাজ, বাংলা সাহিত্য তার অবদান এতো ব্যাপকতম বিস্তৃত, তা পরিমাপ অদ্যাবধি করে চলেছেন অনুসন্ধিৎসু গবেষকগণ।বাংলা সাহিত্যের এমন কোন ক্ষেত্র নেই- কবিতা, গল্প, উপন্যাস, গান, নাটক ইত্যাদি যেখানে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সফল পদচারণা পরিলক্ষিত হয়নি। গুণগত ও পরিমানগত উভয়দিকে তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও অনতিক্রম্য। বাংলা সাহিত্যের সূচনা লগ্ন হতে আজ পর্যন্ত তাঁর কর্ম পরিধিকে স্পর্শ করতে পারেনি অন্য কেউ। রবীন্দ্রোত্তর কবি সাহিত্যিকবৃন্দ কমবেশি সকলেই রবীন্দ্রনাথের আলোকচ্ছটায় প্রভাবিত। বাংলা সাহিত্যকে তিনি বিশ্ব সাহিত্যের মর্যাদা এনে দিয়েছেন। জন্মদিনে তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
২.
রবি ঠাকুরের বাউল মন খুঁজতে ও বুঝতে গিয়ে ভীষণই বিপাকে পড়েছি আমি। ‘বাউল বেশে রবি ঠাকুর’আমার মনে গোপনে গেয়ে ওঠেন আর আমি ভবের ঘরে নিরবতায় ব্যস্ত রাখি শুনতে, ‘আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে’, ‘কোন ফুলে পূজিব রাঙা চরণ তোমার’, ‘এবার তোর মরা গাঙ্গে বান ডেকেছে’, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’, ‘যে তোরে পাগল বলে’ ও ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি’। আর এসব গান শুনতে শুনতে আমার কেন যেন গভীর আস্থার সাথেই মনে হয়- বাঙালি মাত্রই বাউল, অন্তত: মনে-মননে আজীবন বাউল ভাবধারা বহন করে অধিকাংশ বাঙালিই।এই বাংলার মাটি-জল-হাওয়াই হয়ত দায়ি এজন্য। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত যেমনটি লিখেছিলেন, ‘কীর্তনে আর বাউলের গানে আমরা দিয়েছি খুলি,/ মনের গোপনে নিভৃত ভুবনে দ্বার ছিল যতগুলি।’ (‘আমরা’) হ্যাঁ, বাউল গান নিভৃত মনের ও গোপন সাধনার গান। মনের মানুষকে খুঁজে নেওয়ার গান। সেই মধ্যযুগে যার সূচনা, এই একুশ শতকে এসেও তার ধারা থেমে যায়নি। বাংলায় বাউল গান-চর্চার ঐতিহ্য দীর্ঘকালের। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের উৎসাহ ও চেষ্টা কারোর অজানা নয়। ইংরেজিতেও অনুবাদ করে বাংলার বাউল গানকে তিনি বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিতে চেয়েছেন। নিজেও লিখেছেন অনেকগুলো বাউল সুরের গান। যেগুলো আমাদের ভাবের হাটে ‘খাঁটি সোনা’র মূল্যমানের পাশাপাশি জনপ্রিয়তাও লাভ করে।আর তাই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাউল অঙ্গের গানগুলো তন্ময় হয়ে শুনি আমরা কারণ প্রতিটি গানে যেন রয়েছে মাটির গন্ধ। ফলে রবীন্দ্রনাথের বাউল গানের সুরের মোহে মগ্ম না থেকে উপায় নাই। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গীতের বিচিত্র ভান্ডারে বাউল গান একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। শিলাইদহ অঞ্চলে রবীন্দ্রনাথকে সবচেয়ে বেশি মথিত করেছিলেন বাউল সম্রাট লালন সাঁই। বাউল পদাবলির পদাবলির প্রতি নিজের অনুরাগের কথা রবি ঠাকুর নিজেই স্বীকার করেছেন। কারণ বাউলের গান,বাণী,সুর বিশেষত: লালনের বাউল গান রবীন্দ্রনাথের কাব্য সাধনা, সঙ্গীত রচনা ও আধ্যাত্ম ভাবনাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। বাউল গানে রবীন্দ্রনাথ লোকজ সুরের পাশাপাশি রাগ-রাগিনীর সফল প্রয়োগও ঘটিয়েছেন নিবিষ্টভাবে। আমরা জানি যে, আধ্যাত্মিকতা অর্জনের মাঝে মুক্তির সন্ধান করে বাউল গান। এ গান জীবন দর্শনে সম্পৃক্ত এবং সুরেও সমৃদ্ধ। বাউল দর্শন ও জীবনবোধ প্রভাবিত করেছে বাংলা সাহিত্যকে, অনুপ্রাণিত করেছে রবীন্দ্র সাহিত্যকে। আর এ কারণেই ‘লালন কি জাত এ সংসারে’, জাতের এই প্রশ্নকে রবীন্দ্রনাথও লালনের মতোই অবান্তর বলেই মনে করতেন। কারণ বাউল দর্শনে সবাই সমান। সেখানে কৃষ্ণাঙ্গ-শ্বেতাঙ্গ, ইরোপয়েড-মঙ্গোলয়েড, নরডিক-অস্ট্রিক, বাঙালি-জার্মানি, আফ্রিকান-ইউরোপিয়ান, হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-জৈন-শিখ এবং ধনী-দরিদ্রের কোনো ভেদাভেদ নেই। বাউল দর্শনের মতো তার কাছে তাই ‘মানুষ সত্য’। যেমনটি রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ’। তিনি জীবনব্যাপী মানুষের প্রতি বিশ্বাস রাখার বিষয়ে ছিলেন অঙ্গীকারবদ্ধ। মানবকল্যাণই ছিল তার জীবনব্রত। তার জীবন দর্শন ছিল লোকায়ত। তিনি ছিলেন জীবনমুখী চিন্তা-আদর্শের প্রতিভূ। রবীন্দ্রনাথে তাই বার বার বাউলদের মানবপ্রেমের ও ঈশ্বরপ্রেমের প্রভাব বিস্তার লাভ করেছে। হয়ে উঠেছেন বিশ্বমানবতাবাদী, বিশ্বের কবি, বিশ্বকবি ও বিশ্ব নাগরিক। বিশাল রবীন্দ্র রচনাবলী এবং সমগ্র রবীন্দ্র জীবন সাধনার দিকে তাকালে আমরা বার বার তারই প্রমাণ পাই।
৩.
বলা হয়ে থাকে, রবীন্দ্রনাথ উপনিষদের কবি। তার সাহিত্যের ঐশী-চেতনা ও মৃত্যু-চেতনার সব স্তরে উপনিষদের শাশ্বত বাণী ও সুর প্রতিফলিত। রবীন্দ্রনাথ ও তার পরিবার ছিল ব্রহ্মবাদী ও নিরাকার উপাসনাকারী। রাজা রামমোহন রায় প্রবর্তিত ব্রাহ্মধর্মের প্রবর্তক পুরুষের মধ্যে অন্যতম ছিলেন রবিঠাকুরের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরও।কিন্তু তাই বলে তিনি সেখানে স্থির থাকেননি। সব মতবাদের ঊর্ধে জীবন পতাকায় মানবতাবাদের তিলক এঁকেছেন পরতে পরতে। বৈষ্ণব কবি চণ্ডীদাসের মতো তিনিও মনে করতেন, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’। আর তাই রবীন্দ্র সাহিত্যে বিশেষত গানে উপনিষদের প্রভাব যেমন লক্ষণীয়, তেমনি বাউল প্রভাবও ব্যাপক। তার সাহিত্যে বহু অঙ্গ। কিন্তু গানে অন্য মাত্রা বাউল অঙ্গ। রবিঠাকুর বাউল অঙ্গে অন্য বিভঙ্গে বিরাজিত। তার প্রেম-পূজা-প্রকৃতি পর্বের গানের চেয়ে বাউল পর্বের গানে সুষমা অন্য মাত্রিকতায় মণ্ডিত। রবীন্দ্রনাথ বাউলকুলমণি লালন ফকিরের খোঁজ পেয়েছিলেন তার যৌবনে। মুগ্ধ-আবেশে আকর্ষিত হয়েছিলেন লালনের গানের কথায় ও সুরে। আপ্লুত হয়েছিলেন তার বাউল ভাবাদর্শে। কৃষক পরিবারের সন্তান এই দরিদ্র সন্ন্যাসী বাউলটি রবীন্দ্রনাথের ভাব-মানসে দেহতত্ত্বের পাপড়ি ছিটিয়ে দিয়েছেন নির্বিকারে। ‘বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে আমার নয়’-এর মতো তার গানের কথায় রেখে গিয়েছিলেন দেহতত্ত্ববাদ। প্রতিভাসিত করেছিলেন আত্মার মুক্তি। তাই রবীন্দ্রনাথ অকপটে স্বীকার করেছিলেন সমগ্র বাউল সম্প্রদায়ের কাছে তার অপরিশোধিত ঋণের কথা। আমরা ধন্য হয়েছি তার বাউল অঙ্গের গান শুনে। রবীন্দ্রনাথের বাউলচারী মানসিকতা নিয়ে কোনো তর্ক নেই, বরং স্বীকৃতি আছে নানা জনের আলোচনায়, সর্বোপরি রবীন্দ্রনাথের রচনাসমূহে। অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী অভিহিত করেছিলেন ‘খ্যাপা বাউল কবি’বলে। ‘কবি পরিক্রমা’য় তিনি জানিয়েছিলেন, ‘জোড়াসাঁকোর অভিজাত পরিবারে না জন্মে….কুষ্টিয়া কি পাবনায় জন্মগ্রহণ করলে তিনিও হয়তো অমনি একতারা হাতে গান গেয়ে গেয়ে খ্যাপার মত ঘুরে বেড়াতেন। কেননা বাউলদের অন্তরের প্রেরণা এবং রবীন্দ্রনাথের প্রেরণা যে একই।’এটি অতিশয়োক্তি মনে হলেও এর অন্তঃসার যে অনস্বীকার্য তা রবীন্দ্রকথিত ভাষ্যে পাওয়া যায়, ‘বাউলের সুর ও বাণী কোন্ এক সময়ে আমার মনের মধ্যে সহজ হয়ে মিশে গেছে।’ মুহম্মদ মনসুর উদ্দীনের সূত্রে, হারামণি (২য় খন্ড) প্রসঙ্গে, আশীর্বাদ অংশে এই রাবীন্দ্রিক স্বীকারোক্তি তার সারা জীবনের ক্ষেত্রেই সত্য হয়ে উঠেছিল। ‘বাউল চেতনার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের একাত্মতার পরিচয়’ রবীন্দ্রজীবন সাধনায় স্পষ্ট হয়েছে বারে বারে; আমাদের মনে পড়বে, ‘শেষ শপ্তক’ কাব্যের সেই সরল-সুস্পষ্ট উচ্চারণ, ‘তরুণ যৌবনের বাউল / সুর বেঁধে নিল আপন / একতারাতে / ডেকে বেড়ালো / নিরুদ্দেশ মনের মানুষকে / অনির্দেশ্য বেদনার খেপা সুরে।’(পঁচিশে বৈশাখ)। রবীন্দ্রনাথের ভেতরেই এক বাউলিয়া সত্তা ছিল, তাঁর জীবনসাধনা, জীবনদেবতা সাধনা; তাঁর বিশ্ববিস্তারী পথ চলা-সব কিছুতেই তিনি ‘বাউল জীবনের মরমী অন্তরপুরুষ’- এর সংস্পর্শ, সংশ্লেষ, সন্নিধ্য প্রয়াসী হয়েছেন। আবুল আহসান চৌধুরী তাঁকে বলছেন, ‘রবীন্দ্রবাউল’। মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী যেমন তাঁকে যে অর্থে খ্যাপা বাউল কবি বলেছেন, আবুল আহসান চৌধুরী অন্য পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথকে বুঝে নেবার চেষ্টা করেছেন এই ভাবে- ‘বাউলের গানের সুর, বাণী ও তত্ত্বকথা যেমন তাঁকে আকৃষ্ট করেছে তেমনি বাউলের বেশ ভূষায় তিনি প্রভাবিত হয়েছেন-বাউলের আলখাল্লা তাঁর পোশাকের প্রতীক হয়ে উঠছিল। রবীন্দ্রমানসে এই বাউল প্রভাবের মূলে ছিলো লালনের গান এবং তাঁর শিষ্যবৃন্দ ও শিলাইদহের বাউল সম্প্রদায়ের সাহচর্য।’ (রবীন্দ্রনাথ ও শিলাইদহের বাউল সম্প্রদায়)।
৪.
এবার একটু ‘বাউল’ বিষয়ে জানার চেষ্টা করা যাক। খুঁজতে গিয়ে দেখি ‘বাউল’ নামের উৎপত্তি সম্পর্কে নানা মতপার্থক্য রয়েছে।বাংলায় বাউল মতের প্রকাশ মধ্যযুগে। গবেষক উপেন্দ্রনাথের মতে, ‘আনুমানিক ১৬২৫ খৃস্টাব্দ হতে ১৬৭৫ খৃস্টাব্দের মধ্যে বাউলধর্ম তার পূর্ণতা নিয়ে আবির্ভূত হয়।’ আবার ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের ধারণা ‘বাউলের জন্ম ১৪শ’ শতাব্দীর শেষ ভাগে কি ১৫শ’ শতাব্দীর প্রথম ভাগে। বাউল জন্মগ্রহণ করিয়াছে সিদ্ধা ও মুসলমান ফকীর হইতে।’ অধ্যাপক আহমদ শরীফের অভিমত, ‘মোটামুটি ভাবে সতেরো শতকের দ্বিতীয় পাদ থেকেই বাউলমতের জন্ম।’ তবে গবেষকদের মতে, বাউলমতের জন্ম ক্ষেত্রে অধিক সমর্থনযোগ্য যুক্তি- শ্রীচৈতন্যের (১৪৮৬-১৫৩৩) মৃত্যুর পর ভারতবর্ষ ও বাঙলায় বিভিন্নভাবে বেড়ে ওঠা ভিন্নভিন্ন ধর্মের নির্যাস ও সাধনার প্রয়োজনীয় অংশগ্রহণ এবং বিশেষভাবে বৈষ্ণব সহজিয়া মতের ভাববাদী প্রভাবেই বাউল ধর্ম তার বিশেষ রূপ পায়। তবে বাউলধর্ম গড়ে ওঠার পিছনে বৌদ্ধ সহজিয়া মত, ইসলামী সুফীবাদ ও বৈষ্ণব সহজিয়া মূল হিসেবে কাজ করে এবং এ সকল মতবাদের সংমিশ্রণই বাউল ধর্মের প্রাণ রসায়ন। অন্যদিকে আমরা দেখতে পাই, পনের শতকের শেষ দিকে ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়ে’ এবং ষোল শতকের শেষদিকে ‘চৈতন্যচরিতামৃতে’ ‘ক্ষেপা’ ও বাহ্যজ্ঞানহীন অর্থে ‘বাউল’ শব্দের আদি প্রয়োগ লক্ষণীয়। রাঢ় অঞ্চলে এখনো বাউলকে ‘ক্ষেপা’ বলে। কেউ কেউ বলেন, ‘বাউল’ শব্দটি ‘বাউর’ অর্থাৎ এলোমেলো, বিশৃঙ্খল বা পাগল থেকেই উৎপত্তি হয়েছে। ‘আকুল’ থেকে ‘আউল’ বা ‘ব্যাকুল’ থেকে ‘বাউল’ শব্দের উৎপত্তিও হতে পারে। আবার, কেউ কেউ বলেন, এ মতের উদ্ভব যুগে দীন-দুঃখী, উল্ঝুল একতারা বাজিয়েদের জনসাধারণ ‘বাতুল’ বলে উপহাস করতো। এ ‘বাতুল’ শব্দ থেকে ‘বাউল’ নামেরও উদ্ভব হতে পারে। কারো মতে- ‘বায়ু’ শব্দের সাথে ‘ল’ যুক্ত হয়ে বাউল অর্থাৎ বায়ুভোজী উন্মাদ অথবা শ্বাস-প্রশ্বাসের দ্বারা সাধনাকারী অর্থে ‘বাউল’ শব্দের সৃষ্টি হয়েছে। দার্শনিক ড. ব্রজেন্দ্রনাথশীল ‘বাউল’ শব্দটি ‘আউল’ বা আরবি ‘আউলিয়া’ শব্দজ বলে মনে করতেন। তবে সম্ভবত স্রষ্টার জন্য ‘ব্যাকুল’ বা ‘বাতুল’ থেকেই ‘বাউল’ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে বলে মনে হয়। বাউলরা জীবন, সমাজ ও পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন। ভেদবুদ্ধিহীন মানবতার উদার পরিসরে সাম্য ও প্রীতির সুউচ্চ মিনারে বসেই বাউলেরা সাধনা করে। তাঁরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দার্শনিক ও সাধকদের কণ্ঠের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে সাম্য ও প্রেমের বাণী শোনায়। আজকের পৃথিবীতে মানুষ যে মানস-সম্পদের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে; সেই সহিষ্ণুতা ও পারস্পরিক সম্প্রীতির বাণী কত কাল ধরে তাঁরা পথে-প্রান্তরে পরম নিষ্ঠার সঙ্গে উচ্চারণ করে আসছেন। বাউলদের মতে, ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে মানবদেহের মাঝেই স্রষ্টা বিরাজমান। কারণ, জীবাত্মা পরমাত্মারই অংশ। জীবাত্মার মধ্যেই পরমাত্মার স্থিতি। কাজেই, আপনার আত্মার পরিশুদ্ধি ও পরিচয়ই খোদাপ্রাপ্তির উপায়। তাই আত্মার স্বরূপ উপলব্ধির সাধনাই বাউলদের ব্রত। বাউলদের কাছে সকল মানুষই সমান ও মূল্যবান। কেননা, জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সকল মানুষের অন্তরেই স্রষ্টা বিরাজমান। সেজন্য মানুষের জাত-পাত বিচার নয়, মানুষের প্রধান ধর্ম- মানব ধর্ম। বাউলদের মতো এত উদার অসাম্প্রদায়িক-দৃষ্টি ভঙ্গি ও মানবতাবাদ আর কোথাও লক্ষ করা যায় না। আর তাই লালনসহ অন্য বাউলরা হিন্দু ছিলেন না, মুসলমান ছিলেন না, ছিলেন বাউল। মানবধর্মের উৎকৃষ্ট নজির এই বাউলরা। অন্নদাশঙ্কর রায় বলছেন, বাউল ধর্ম নয়, এর প্রচার সাধনা। এই সাধনার মূল কথাই হয়ে হয়ে ওঠে যেন রবীন্দ্রনাথের জীবন সাধনা। ফলে বাউলের জীবন দর্শনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সাদৃশ্য খুঁজে পেতে খুব বেশি অসুবিধা হয় না।
৫.
রবীন্দ্র জীবনী থেকে আমরা জানি, বিলেত ফেরত রবীন্দ্রনাথের ওপর দায়িত্ব পড়েছিল পূর্ব বাংলার (বাংলাদেশ) জমিদারি দেখার। ১৮৯২ সালে রবীন্দ্রনাথ চলে এলেন শিলাইদহে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিলাইদহকে তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায় বলে মনে করতেন। তিনি শিলাইদহে প্রায় নিয়মিত এসেছিলেন ১৯২২ সাল পর্যন্ত। এই সুদীর্ঘ সময়ে সৃষ্টি করেছেন সাহিত্যের বিভিন্ন শাখার অসাধারণ সব সম্পদ। অনেক অনেক গান। বিশেষভাবে বাউল অঙ্গের গান। রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে এসেই বাউল-আত্মার সন্ধান পান। বাউলসম্রাট লালন সাঁইয়ের ভাবাদর্শে নিজেকে মিলিয়ে নেন। বাউল সম্প্রদায়ের সংস্পর্শে আসেন। শিলাইদহে বসে বাউল পরম্পরার সঙ্গে সংলাপ চালিয়েছেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ নিজেই বাউলদের কাছ থেকে অনেক কিছু নিয়েছেন যেমন- বাউল দর্শন, বাউল গান, বাউল সুর। বাউলদের জীবন ও ভাব দর্শনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ নিজেকে মেলাতে পেরেছেন, আবার বাউলরা তাদের দর্শনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথকে মেলাতে পেরেছেন; যে কারণে যাদের মধ্যে প্রকৃত বাউলের দর্শন রয়েছে, যারা প্রকৃত বাউল, বাউলধর্মে বিশ্বাসী, তাদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের গান মরমে মরমে পৌঁছে যায়।মনের গহন-গহিনে প্রবেশ করে। শিলাইদহে জমিদারি পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে বাউল জীবনের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটলেও ছেঁউড়িয়ার লালনের সঙ্গে তাঁর দেখা সাক্ষাৎ হয় নি। লালন ফকিরের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের চেনাজানা হওয়া সম্ভব ছিল না। জলধর সেন, বসন্তকুমার পাল প্রকাশক অজিত কুমার স্মৃতিরত্ন, গোঁসাই গোপাল, সুকুমার সেন, বিনয় ঘোষ দাবি করলেও প্রমাণিত হয় নি, লালনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথও তার কোনো লেখায় লালনের সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়টি স্বীকার করেননি। বালক বেলায় বা কিশোর কালে শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ গেলেও লালনের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল কিনা, তার প্রামাণ্য নথিপত্র নেই। কিন্তু লালনের গান যে তাঁকে আকৃষ্ট করেছে, তার পরিচয় আমরা বারে বারে পেয়েছি। ড. সনৎ কুমার মিত্র সূত্রে জানা যায়, লালনের গানের সংগৃহীত দুটো পুরনো খাতা বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রভবনে সংরক্ষিত আছে। শিলাইদহে,এই কালে, সর্বযোগী বোষ্টমী; গগন হরকরা, কাঙাল হরিনাথ লালন শিষ্য পাঁচু শাহ, শীবন শাহ, মলম শাহ, ভোলাই শাহ, মানিক শাহ, মনিরুদ্দিন শাহ প্রমুখজনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘লালন ফকির (১৭৭৪-১৮৯০) নামে একজন বাউল সাধক হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-জৈন ধর্মের সমন্বয় করে কী যেন একটা করতে চেয়েছিলেন আমাদের সবারই সেদিকে মনোযোগ দেয়া উচিত।’ যদিও তিনি একবার লালন ‘ফকির’ বলেছেন, এরপরই তাকে আবার ‘বাউল’ বলেছেন, যেখানে বাউল এবং ফকিরের অর্থ পারস্পরিক সাংঘর্ষিক।
৬.
বাউলধর্মের মূল অবলম্বনই হচ্ছে মানবজীবন, মানবদেহ। তাদের কোনো ধর্মাধর্মী নেই। জাত-কুল নেই। মানবসত্তায় বিরাজমান সর্বজনীন। লালন তাই আকুল স্বরে বলেছেন, ‘লালন কি জাত সংসারে!’ জীবনের গভীর বোধ, দেহাত্ম-চেতনা- নানা আঙ্গিকে ও সুরবৈচিত্র্যে লালনসঙ্গীতেই পরিপূর্ণতা পেয়েছে। বাউল গান মূলত দেহতত্ত্বের গান। কখনো সাধারণের পক্ষে বোধ্য আবার কখনো সাংকেতিক শব্দ দিয়ে তারা ভরে তুলেছেন গানের কথাকে। মানুষ গুরুনিষ্ঠা যার, সে-ই কেবল সৃষ্টির সত্য অনুসন্ধান করতে পারে। গানের মধ্য দিয়েই বাউলরা খুঁজেছেন জগৎ সৃষ্টির রহস্যময়তা। আত্মমুক্তির নিগূঢ় তত্ত্বের পথ। এসব কারণে রবীন্দ্রনাথ বাউলতত্ত্ব, বাউল দর্শন ও বাউল গানে আকৃষ্ট হয়েছেন বার বার। আর রবীন্দ্রনাথ এই পরিপূর্ণতার স্বাদেই বার বার আকৃষ্ট হয়েছেন লালনের প্রতি। তার দর্শন বাউলতত্ত্বের প্রতি। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “শিলাইদহে যখন ছিলাম, বাউল দলের সঙ্গে আমার সর্বদাই দেখা সাক্ষাৎ ও আলাপ-আলোচনা হ’তো। আমার অনেক গানেই আমি বাউলের সুর গ্রহণ করেছি এবং অনেক গান অন্য রাগরাগিণীর সঙ্গে আমার জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে বাউল সুরের মিলন ঘটেছে। এ থেকে বোঝা যাবে, বাউলের সুর ও বাণী কেন এক সময়ে আমার মনের মধ্যে সহজ হয়ে মিশে গেছে। আমার মনে আছে, তখন আমার নবীন বয়স, শিলাইদহ অঞ্চলেরই এক বাউল কোলকাতায় একতারা বাজিয়ে গেয়েছিলো- ‘আমি কোথায় পাবো তারে/আমার মনের মানুষ যেরে’। কী অপূর্ব সে সুর ও বাণী।” রবীন্দ্র নাটকে পাওয়া যায় সেই বাউল চরিত্রটি, যে শুদ্ধ-নির্মল চিত্তে উপলব্ধি করেছেন তার মানবসত্তাকে। তাই কবি গেয়ে উঠেছেন, ‘এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’।
৭.
শিলাইদহে থাকতে বাউল গগন হরকরার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। গগন হরকরা রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়িতেও গিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের মনে তখন থেকেই বাউলের প্রভাব এবং বাউলের মনে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব পড়তে থাকে। রবীন্দ্রনাথের বাউল অঙ্গের গানে লালনের পাশাপাশি গগন হরকরার প্রভাব অনস্বীকার্য। শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে গগন হরকরা ছাড়াও গোঁসাই গোপাল, সরক্ষেপী বোষ্টমী, গোঁসাই রামলাল এবং লালনের অজস্র শিষ্য ও গুরু ভাইয়ের সাক্ষাৎ হয়েছিল। তিনি এসব বাউল ফকিরের গান শুনে আপ্লুত হয়ে যেতেন। তিনি নিজে শিলাইদহ এবং ছেঁউড়িয়া অঞ্চল থেকে অনেক বাউল গান সংগ্রহ করে প্রচার করেছেন। কলকাতার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তা ছাপানোর ব্যবস্থা করেছেন। গগন হরকরা প্রচুর বাউলসঙ্গীত রচনা ও সুর করেছেন। গগন হরকরার আসল নাম গগন দাস। গগন সামান্য শিক্ষা-দীক্ষায় পারদর্শী ছিলেন। এর ফলেই তৎকালীন শিলাইদহের ডাকঘরে ডাক হরকরার চাকরি পেয়েছিলেন। সে কারণেই তার নাম হয় গগন হরকরা। তিনি গাঁয়ে গাঁয়ে চিঠি বিলি করে বেড়াতেন। তিনি শিলাইদহে ‘সখী সংবাদ’-এর গানে এমন করুণ সুর লাগিয়ে গাইতেন যে শ্রোতারা মুগ্ধ হয়ে সে গান শুনত। গগন সম্পর্কে পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন সেন শাস্ত্রী বলেছেন, লালনের শীর্ষ ধারার একজন ছিলেন রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহের ডাক হরকরা, যার নাম গগন। রবীন্দ্রনাথ গগনকে সবার মাঝে বিভিন্নভাবে পরিচিত ও বিখ্যাত করে যথাযথ মূল্যায়ন করেছেন। রবীন্দ্রনাথ গগন হরকরার ‘কোথায় পাবো তারে/আমার মনের মানুষ যেরে’ গানটি সম্পর্কে আরো বলেছেন, “কথা নিতান্ত সহজ কিন্তু সুরের যোগে এর অর্থ অপূর্ব জ্যোতিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিলো। গানটির যে কথা, এই কথাটিই উপনিষদের ভাষায়ও শোনা গেছে, ‘ত্বং বেদ্যং পুরুষং বেদমারো মৃত্যুং পরিব্যথঃ’- যাকে জানবার সেই পুরুষকেই জানো, নইলে যে মরণ বেদনা। অপণ্ডিতের মুখে এ কথাটিই শুনলুম তার গেয়ো সুরে সহজ কথায়। ‘অন্তরতর যদয়মাত্মা’- উপনিষদের এ বাণী এদের মুখে যখন ‘মনের মানুষ’ বলে শুনলুম, আমার মনে বড় বিস্ময় লেগেছিল।” রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন সময়ে তার বক্তৃতায়-প্রবন্ধে গগনের গানের কথা ও গগনের নাম উল্লেখ করেছেন একাধিকবার। বলা হয়ে থাকে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা আমাদের জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ এই গানটির সুরে গগন হরকরার ‘আমি কোথায় পাবো তারে/আমার মনের মানুষ যেরে’, গানের সুরের ভাবধারার প্রভাব রয়েছে।
৮.
রবি ঠাকুর বলছেন, “এমন বাউলের গান শুনেছি, ভাষার সরলতায়, ভাবের গভীরতায়, সুরের দরদে যার তুলনা মেলে না। তাতে যেমন জ্ঞানের তত্ব, তেমনি কাব্য রচনা, তেমনি ভক্তি রস মিশেছে। লোকসাহিত্যে এমন অপূর্বতা আর কোথাও পাওয়া যায় বলে বিশ্বাস করিনে।” রবীন্দ্র উক্তিতে ‘আমার জ্ঞাত বা জ্ঞাতসারে বাউল সুর মিশেছে’ এই অংশ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীত রচনায় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি জ্ঞাতসারে যেসব গানে হুবহু কোন বাউল গানের রূপরেখায় গান লিখেছেন, সে সব গানও আমাদের সকলের মন মাতিয়েছে। উদাহরণ যেমন, মূলগান: হরিনাম দিয়ে জগত; ভাঙাগান: যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে। মূলগান: আমি কোথায় পাব তারে; ভাঙা গান: আমার সোনার বাঙলা। মূলগান: মন-মাঝি সামাল সামাল; ভাঙাগান: এবার তোর মরা গাঙে। এরকমভাবে রবীন্দ্রনাথ অনেক গান বাউল, ভাটিয়ালি ও সারি গানের সুরের মাধুর্য মিশিয়ে আপন অসাধারণ কবিত্বপূর্ণ বাণীযুক্ত করে যেভাবে রচনা করেছেন, তাতে গানগুলি সর্বকালের স্থায়ী সম্পদ হয়ে আছে। এইরকম বিরাট সংখ্যক গানের তালিকা এখানে লেখা সম্ভব নয়। যারা রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চা করেন তাঁরা সযত্নে সে গানগুলি পোষণ করেন এবং তাঁদের ঐ তালিকা চেনা আছে। তবে কয়েকটি মাত্র নমুনাস্বরূপ উল্লেখ করা যায় – ‘আমার মন জাগলি নারে’, ‘এবার দুঃখ আমার অসীম পাথার’, ‘আমি তারেই জানি’, ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি’, ‘যা ছিল কালো ধলো’, ‘ওরে ওরে ওরে আমার মন মেতেছে’। রবীন্দ্রনাথের বাউল গানের অবদান খুবই মূল্যবান এবং বিশাল, সংক্ষিপ্ত পরিসরে তার সম্পূর্ণটা উল্লেখ সম্ভব নয়। কারণ রবি ঠাকুরের বাউল সুরের প্রতিটি গান আপন মাধুর্য ও স্বকীয়তায় অনন্যসাধারণ। আরো কয়েকটি গানের কথা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, ‘এই যে ভালো লেগেছিল’, ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে’, ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি’ ‘বসন্তে কি শুধু কেবল, ফোটা ফুলের মালা’, ‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে, বাদল গেছে টুটি’, ‘বাদল-বাউল বাজায় বাজায় বাজায় রে’, ‘পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে আয় রে চলে আয় আয় আয়’, ‘পাগলা হাওয়ার বদল দিনে’ । আবার, বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকালে যে গানগুলি তিনি পূর্ব-বাংলার বাউল সুরে রচনা করেছেন, সেই গানগুলির মূল্যবোধ এখনও কমে নি। কয়েকটি গান উল্লেখ করা যেতে পারে – ‘ও আমার দেশের মাটি’, ‘ওরে তোরা নেই বা কথা বলছি’, ‘ছি ছি চোখের জলে ভেজাস নে’, ‘যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক’, ‘তোর আপন জনে ছাড়বে তোরে’ ইত্যাদি। এভাবেই বাউলে আর রবি ঠাকুরের মাঝে মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
৯.
রবীন্দ্রসঙ্গীতের বাউল প্রকৃতি সত্যিই অনবদ্য। রবি ঠাকুর বাউল সংস্কৃতির আসল অন্তঃসারকে আত্মস্ত করেছিলেন তার জীবন বীক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত করে দেখার সাধনায়। তেমনটিরই যথার্থ চিত্র পাই আমরা অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত ছবিটিতে, যে ছবিতে বাউলের আলখাল্লা পরিয়ে হাতে বাউলের একতারা দিয়ে রবি-বাউল সাজিয়ে এঁকেছিলেন। এই ছবিতেই রবীন্দ্রসঙ্গীতের বাউল প্রকৃতি সুন্দরভাবে পরিস্ফুটিত হয়েছে। এই ছবির ফলাফল খুঁজলে আমরা দেখতে পাই, রবি ঠাকুরের জীবন ও মননে বাউল দর্শন এতটাই প্রভাব ফেলেছিল যে তার বন্ধনের রেশ থেকে গেছে শান্তিনিকেতনেও। সেখানকার পৌষমেলা প্রাঙ্গণে আজো উড়তে দেখা যায় বাউলের গৈরিক উত্তরীয়। বাউলের একতারায় বাজতে থাকে বাউল গানের পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ। শান্তিনিকেতনের পৌষমেলার পাশাপাশি বীরভূমের কেঁদুলিতে ভক্ত-কবি জয়দেবের জন্মস্থান। কেঁদুলির মেলায়ও বাউলের আড্ডা, বাউল গান মাতিয়ে রাখে মেলার অঙ্গন। কোথায় যেন রবীন্দ্রসঙ্গীত আর বাউল গান মিলেমিশে এক হয়ে যায়। আবার কোনো এক কালের স্রোতে ভেসে যাওয়া নথিহীন বাউলের গান, ‘দেখেছি রূপ সাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা/তারে ধরি ধরি মনে করি, ধরতে গিয়ে আর পেলেম না’-এর অনুকরণে অতি অনায়াসেই সৃষ্টির সাবলীলতায় রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছিলেন সেই গান, ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে, ও বন্ধু আমার’। আরো একটি রবীন্দ্রসঙ্গীতে আমরা পাই লালনের দেহতত্ত্ববাদের স্পষ্ট ইশারা। বোধ করি লালন ফকিরের দেহ-সাধনা এবং মন-সাধনায় কবি লিখেছিলেন এই গান, ‘আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে, তাই হেরি তায় সকল খানে’। রবীন্দ্রনাথ উপনিষদের একাত্মবাদ ও আত্মমুক্তির মহাবাণী এবং বাউলদের দেহতত্ত্ববাদ ও সিদ্ধির পথকে ভাব-জগতের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তাই তার সাহিত্যে-সঙ্গীতে এ দুই অনুষঙ্গ ছায়া ফেলেছে বার বার অনিবার্যরূপে। আর এভাবেই রবি ঠাকুর ‘রবি বাউল’ হয়ে ওঠেন, আমাদের মাঝে তার গানের চরণ ছুঁয়ে গেলে সত্যিকারভাবেই আমরা পাই তাকে।ভুল মনে হয় রবি ঠাকুরকেই, ‘আমার সুরগুলি পায় চরণ, আমি পাইনে তাহারে।’

(তথ্যসূত্র : রবীন্দ্র রচনাবলী, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধ, রবি বাউল ও তার বিচিত্র ভাবনা- আহমদ রফিক, রবীন্দ্র সঙ্গীতে বাউল গানের প্রভাব – ফারুক ওয়াহিদ, বাউলতত্ত্ব: লালন ও রবীন্দ্রনাথ : বিজন গোলদার, ইন্টারনেট)

(বিশেষ কৃতজ্ঞতা : বন্ধুবর হিটো Jahedul Alam Hitto)

আবদুল্লাহ আল মোহন
৬ এপ্রিল, ২০১৫ / ৬ আগস্ট, ২০১৬ / ৮ মে, ২০১৭

শেয়ার করতে এখানে চাপ দিন

সর্বশেষ খবর