রেজাউল করিম শেখ
প্রতিকূল পরিস্থিতিতে টিকে থাকার নাম অভিযোজন। ভাল্লুকের অভিযোজন ক্ষমতা প্রবল। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়েছিলাম- বিজ্ঞান বইয়ে। করোনাকালে আমাদের টিকে থাকার সংগ্রাম চলছে, চলবে। বিশেষত বাংলাদেশের মতো জ্ঞান-বিজ্ঞানে পিছিয়ে থাকা একটা দেশের জনগণ, চিন্তা-দর্শনে নাবালক একটি জনপদ আর প্রাত্যহিক জীবনে যথেষ্ট উন্নাসিকতা নিয়ে বেড়ে ওঠা মানুষ, এই মারাত্মক সংকটে তেমন কোনো শৃঙ্খলার নিদর্শন রাখতে পারবে না বা পারছে না- এটা স্বাভাবিক। তবে একেবারে যে, হেরে যাবে তা নিশ্চয়ই নয়। প্রকৃতির এক অলঙ্ঘনীয় সূত্র হয়তো হবে- কেউ না কেউ এমনিতেই বেঁচে যাবে, বাঁচাতে হবে। তা না হলে তারই বা অস্তিত্ব কোথায়? সবাইকে ধ্বংস করতে চাইলেও, ধ্বংস করলেও নূহের (আ) নৌকায় ঠিকই কিছু সংখ্যক মানুষ উঠে পড়েছিলো- আবাদ করেছে এই পৃথিবী এবং আবারো করবে। এখানে জরা, মৃত্যু থাকবে, থাকতেই হবে। না হলে তো এই সবুজ ভূ-খণ্ড একটা আস্ত ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হবে!
যাদের বয়স বেড়েছে খুব- তাদের সম্মান জানিয়ে শেষকৃত্য করবো, নতুনের জন্য থাকবে লাল গোলাপের শুভেচ্ছা! কীর্তিমানের কীর্তি ওরা। ওদের কিছু রেখাচিহ্ন দেখাতে হয়, শেখানো যায় খুব কম। প্রবাহমান স্রোতের মতো ওদের প্রয়োজনে ওরা এগিয়ে যাবে। যেতে তো হবেই। আর এখানে আমরা বাধ দিতে যাবো কেন? আমরা আপাতত তীরের সংস্কার করে যাই।
শিক্ষা আমার কাছে গল্পের মতো মনে হয়। আমরা অতীতবেলার গল্প বলবো, আমাদের স্বপ্নের গল্প করবো- ওরা শুনে শুনে ওদের মতো করে অতীত কল্পনা করবে, ভবিষ্যৎ রচনা করবে। একজন শিশুর ভেতর এই স্বপ্নের সংযোগটাই আমরা ঘটাতে পারি- ঘটাতে চাই। একারণে ওদের কাছে হেরে গেলে আমরা মজাই পাবো।
করোনাকালে ওরা ঘরে বসে আছে। আড্ডা, খুনসুটি, খাওয়া-দাওয়া চলছে। কেউ কেউ এক-আধটু পাঠ্যপুস্তক খুলছে। পৃষ্ঠা ওল্টাচ্ছে। তবে গ্রামীণ বাস্তবতায় আমাদের জরিপ অনুযায়ী অনেক শিশুর বই কোথায় আছে, সেটাই তারা জানে না। কেউ কেউ তো বইয়ের রঙিন পৃষ্ঠা ঘুড়ি করে আকাশে ওড়াচ্ছে! তবুও কি ওরা শিখছে না? তবুও কি ওরা কিছুই জানছে না? কিছুই বুঝতে পারছে না? পারছে- টিভি দেখছে, মোবাইলে ফেসবুক দেখছে, ইউটিউবে মজার ভিডিয়ো দেখছে। আর বড় কথা প্রতিদিন দুপুর বেলায় করোনার বৃত্তান্ত নিচ্ছে। জানতে পারছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনাকে দীর্ঘ মেয়াদী সংকট হিসেবে ঘোষণা করেছে। ওরা জেনে গেছে রাস্তায় বের হওয়া ঝুঁকিপূর্ণ, সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে, মুখোশ ব্যবহার করতে হবে, গরম পানি খেতে হবে ইত্যাদি। ওদের জানার শেষ নেই।
এই জানার পথেই, এই স্রোতের গতির ভেতরেই আমরা আরেকটু জল ঢেলে দিই। আরেকটু গতি বাড়িয়ে দিই।
আমার ঘর, আমার ইস্কুল তেমনই একটা কার্যক্রম নপম-এর। শিখা একাডেমির ২২৫ জন শিক্ষার্থীর জন্য নিজের ঘরকে ইস্কুলে পরিণত করার এক আনন্দ- ঘরবন্দি দিনে। আদতে নিজের ঘরই তো সেরা ইস্কুল! একটা ভালো লাগা কাজ করছে ভেতরে ভেতরে। দীর্ঘদিনের দীর্ঘ অভ্যাসের জেঁকে বসা মুখস্ত ধারা কী ক্ষতিই না করছে আমাদের দেশের, এটার কিছুটা পরিবর্তন আনতে পেরে। কেবল পরীক্ষায় বেশি নম্বর পাওয়ার জন্য জানার ও বোঝার সীমাহীন প্রশ্ন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ৫টি প্রশ্নের গদবাধা উত্তর মুখস্ত করা, প্রশ্ন কিনে নেওয়া- কী ভয়াবহ কাণ্ড ঘটে চলেছে! এর ফলটা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি সকলে। কোনো বিভাগই দাঁড় করাতে পারিনি। প্রতিবছর এতো এতো জিপিএ-৫ তাদের দ্বারা দেশের কোন মঙ্গল হচ্ছে? কোনটাকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে পেরেছে? এতো এতো রাজনৈতিক কর্মী- দুটো বড় দলের যেখানে প্রায় দুই কোটি কর্মী, দেশের সত্যিকার কোন কাজটা হচ্ছে? একেবারে যে হচ্ছে না, তা বলছি না। আমাদের মাতামাতির তুলনায় হওয়াটুকু নিতান্ত তুচ্ছ। খুব বেশি না বাড়িয়ে বলা যায়, শিক্ষায় ব্যাপক গলদ রয়েছে, এর সংস্কার করতে হবে। পাঠদান ও পরীক্ষায় সংস্কার আনতে হবে। পরীক্ষা নির্ভর পড়াকে ছুড়ে ফেলতে হবে। নৈতিক শিক্ষা, বুদ্ধির বিকাশ, চিন্তার উন্নতি ঘটিয়ে সৃজনের বন্যা বওয়াতে হবে। তা হলে দুর্যোগে-দুর্বিপাকে টিকে থাকার প্রবল সামর্থ্য তৈরী হবে।
আমার ঘর, আমার ইস্কুল- আপাতত এই মুখস্ত বিদ্যার বিপরীতে চিন্তা উস্কে দেওয়ার কাজ করবে, বই দেখে উত্তর লিখতে গিয়ে বইয়ের পৃষ্ঠায় প্রকৃত কর্মিষ্ঠ কৃষকের লাঙলের মতো চাষাবাদ করবে। উত্তরের জন্য অন্যকে জিজ্ঞাসা করবে।
আর শিক্ষার জন্য ওরাই কেবল ছুটে আসবে আমাদের কাছে- মহাজনের কাছে তা নয়। আমরাও পৌঁছে যাবো ওদের দোড়গোরায়, ওদের মনের কাছে।
রেজাউল করিম শেখ : প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি, নপম