আবদুল্লাহ আল মোহন
১.
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রখ্যাত কবি, গবেষক এবং বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অমিয় চক্রবর্তী। বিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যের অন্যতম ব্যক্তিত্ব অমিয় চক্রবর্তী ১৯৮৬ সালের ১২ জুন শান্তিনিকেতনে মারা যান। প্রয়াণ দিনে তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, অমিয় চক্রবর্তী জন্মগ্রহণ করেন ১৯০১ সালের ১০ এপ্রিল। অমিয় চক্রবর্তী তাঁর জীবনের প্রথম দিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে এসেছিলেন। তিরিশের পঞ্চকবির মধ্যে স্বকীয়তার মধ্য দিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন অন্যতম একজন। অন্য চারজন ছিলেন জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু ও বিষ্ণু দে। আধুনিক কবিতায় ভাব, দর্শন ও রসের ক্ষেত্রে তিনি বিশেষ সংযোজন ঘটিয়েছেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যসচিব হিসেবে ১৯২৬ থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণাকাজে যোগ দেন। তবে রবীন্দ্র প্রভাব বলয়ের বাইরে থেকে তিনি কবিতা চর্চা করেছেন বলেই সাহিত্য সমালোচকগণ মনে করেন। তাঁকে নিয়ে আজ লিখতে বসে মনে পড়ে, বিখ্যাত ‘দেশ’ পত্রিকাসহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, বইতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রমথ চৌধুরী, শিবনারায়ণ রায়, কবি নরেশ গুহসহ প্রমুখের মধ্যেকার নানা পত্রালাপ পাঠ করে অমিয় চক্রবর্তীর লেখনির প্রতি আমার পাঠ আগ্রহ প্রবল হয়।
২.
বিশ শতকের তিরিশোত্তর আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান কবি অমিয় চক্রবর্তী তিরিশের অন্যান্য কবিদের তুলনায় ভিন্নরূপ ব্যক্তিত্ব নিয়ে গড়ে উঠেছিলেন। বুদ্ধদেব বসু অসংকোচে অমিয় চক্রবর্তীকে ‘কবির কবি’ অভিধায় আখ্যায়িত করেছিলেন। আর আবু সয়ীদ আইয়ুব অমিয় চক্রবর্তীকে তাঁর ‘প্রিয়তম কবি’ বলেছেন। পণ্ডিত শিবনারায়ণ রায় লিখেছেন, “অমিয়-র কোনো নিজস্ব পত্রিকা অথবা গোষ্ঠী ছিল না। ক্ষীণকায় মৃদুভাষী মানুষটির কিছু গভীর প্রত্যয় ছিল, কিন্তু বিতর্কে তিনি অনাগ্রহী অথবা আস্থাহীন। অপরপক্ষে জীবনানন্দের মতো তিনি সঙ্গ-বিমুখ ছিলেন;- বস্তুত নরনারী, পশুপাখি, শহরগ্রাম, বিশ্বের বিচিত্র অধিবাসী এবং বিভিন্ন অঞ্চলের হরেক রকম প্রাকৃতিক রূপ সম্পর্কে তাঁর কৌতূহল ছিল অপরিসীম। সঙ্গ ভালোবাসতেন, কিন্তু সব সময়েই মনে হয় তাঁর অস্তিত্বের কেন্দ্র এক গভীর নিরাসক্তি তাঁকে সচল রাখত। প্যাশন বা আবেগের আতিশয্যকে তিনি সচেতনভাবে এড়িয়ে চলতেন।” রবীন্দ্রনাথের খুব ঘনিষ্ঠ জন হয়েও কবিতায় অমিয় চক্রবর্তী সম্পূর্ণ স্বকীয়তার ও আধুনিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। বলা যায় অক্লেশে তিনি রবীন্দ্র কাব্যবলয়ের বাইরে অবস্থান করেছেন শুরু থেকেই। এ বিষয়ে বুদ্ধদেব বসুর মন্তব্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক, “রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর জগৎ মূলত এক হ’লেও উপাদানে ও বিন্যাসে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। প্রধান কথাটা এই যে রবীন্দ্রনাথের স্থিতিবোধ, অর্থাৎ ব্যক্তিগত জীবনে স্থায়িত্বের ভাব অমিয় চক্রবর্তীতে নেই। কোনো আধুনিক কবিতেই তা সম্ভব নয়। উপাদানের আয়তন ও বৈচিত্র্য তাঁকে বৈশিষ্ট্য দিয়েছে; রবীন্দ্রনাথের কাছে যা পেয়েছেন তার ব্যবহারের ক্ষেত্র আলাদা বলে তাঁর কবিতার রসবস’ স্বতন্ত্র; তাঁর কাছে আমরা যা পাই, রবীন্দ্রনাথ তা দিতে পারেন না।”
৩.
অমিয় চক্রবর্তী জন্মগ্রহণ করেন পশ্চিমবঙ্গের হুগলির শ্রীরামপুরে। তাঁর পিতা দ্বিজেশচন্দ্র চক্রবর্তী ছিলেন আসামের গৌরীপুর রাজ্যের দেওয়ান। তাঁর মা অনিন্দিতা দেবী ছিলেন সাহিত্যিক – তিনি “বঙ্গনারী” ছদ্মনামে প্রবন্ধ-বিন্ধ প্রকাশ করতেন। তিনি সংস্কৃতে পারদর্শী ছিলেন আর চার সন্তানকে সংস্কৃত শিখিয়েছিলেন নিজেই। গৌরীপুরের সংস্কৃত টোল থেকে প্রখ্যাত পণ্ডিতকে তিনি নিযুক্ত করেছিলেন কালিদাস, ভবভূতি, ভারবি প্রমুখের রচনা পাঠের সুবিধার্থে। এভাবেই অমিয় চক্রবর্তী শৈশবেই ব্যাকরণে পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন।
৪.
অমিয় চক্রবর্তী ( জন্ম : ১০ এপ্রিল, ১৯০১ – প্রয়াণ : ১২ জুন, ১৯৮৬) পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পাস (১৯২১) করে শান্তিনিকেতনের গবেষণা বিভাগে যোগদান করেন। পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন ও সাহিত্যে এমএ ডিগ্রি লাভ (১৯২৬) করেন। পরে তিনি রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন (১৯২৬-১৯৩৩)। অমিয় চক্রবর্তী ১৯৩৩ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা কাজে যোগ দেন এবং ১৯৩৭ সালে সে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিফিল ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৪০ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যাপনা করেন।
৫.
অমিয় চক্রবর্তী ১৯৪৮-১৯৭৭ সাল পর্যন্ত সপরিবারে আমেরিকায় বসবাস করেন। এ সময়ের মধ্যে তিনি ১৯৪৮ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত হাওয়ার্ড, বস্টন ইত্যাদি বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক প্রাচ্য ধর্ম ও সাহিত্যে অধ্যাপনা কাজে নিয়োজিত ছিলেন। কবি ইয়েটস, জর্জ বার্নাড’শ, আলবার্ট আইনস্টাইন, রবার্ট ফ্রস্ট, আলবার্ট সোয়ইটজর, বোরিস পান্তেরনাক, পাবলো কাসালস্ প্রমুখ বিশ্ববরেণ্য লেখকদের সঙ্গে তাঁর ছিল অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। প্রায় সব ক’টি মহাদেশের অসংখ্য দেশে নানাবিধ কর্মসূত্রে তিনি ভ্রমণ করেন। বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে বক্তৃতা দিয়েছেন। এ কারণে অমিয় চক্রবর্তীর কবিতায় আন্তর্জাতিক বিশ্বপরিবেশের অনেক ভৌগোলিক স্থানের নাম, বর্ণনা ও চিত্র লক্ষ করার মতো। তার কবিতা বিশ্বময়তাকে ধারণ করেছে; এটি তার কবিতাকে দিয়েছে বিশিষ্টতা। এ ছাড়া তাঁর কবিতায় আছে এ অঞ্চলের চিরায়ত বিষয় মরমী সুর ও আধ্যাত্মিকতা।
৬.
জনা যায়, অমিয় চক্রবর্তীর শৈশবকালেই তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা অরুণ চক্রবর্তী আত্মহত্যা করে। ভাইয়ের মৃত্যুতে তীব্র শোকে আক্রান্ত হন অমিয় চক্রবর্তী। তাঁর স্বভাবে চিরস্থায়ী পরিবর্তন আসে; চঞ্চলতা ও ক্রীড়ানুরাগ তিরোহিত হয়ে আসে অন্তর্মুখীনতা; তিনি স্বল্পবাক ও ভাবুক হয়ে ওঠেন। এরপর কলকাতায় এসে হেয়ার স্কুলে ভর্তি হলেন আর থাকতেন মামার বাড়ীতে। উচ্চ শিক্ষিত মামাদের সংস্পর্শে তরুণ অমিয় চক্রবর্তীর মানস জগৎ আলোকিত হয়ে ওঠে। তাঁর বড় মামা নিখিলনাথ মৈত্র হয়ে ওঠেন তাঁর “চিন্তা-কল্পনার প্রধান অধিনায়ক।” সংগীত ও সাহিত্যে তাঁর বিশেষ অনুপ্রেরণা ছিল। বন্ধুস্থানীয় সেজ মামা সোমনাথ মৈত্রের প্রভাবও ছিল বেশ। তিনিই অমিয় চক্রবর্তীকে বীরবল ও সবুজপত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। তাঁর ভাষায়: “সবুজ পত্রের আসরে এবং পরে বিচিত্রার সভ্যরূপে সাহিত্যে সংগীতের প্রেরণা জীবনে প্রতিষ্ঠিত হল।”
৭.
শৈশবেই দৃঢ় ব্যক্তিত্ব নিয়ে গড়ে উঠেছিলেন অমিয় চক্রবর্তী। ফলে মাত্র পনের বৎসর বয়সেই রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখে যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন। একইভাবে প্রমথ চৌধুরীর সঙ্গেও সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। প্রথমে “ডাকঘর” ও পরে “ফাল্গুনী”-তে অভিনেতা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রথম দর্শন ঘটে। পরে প্রমথ চৌধুরীর বাড়ীতে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ হয়। তারপর কবির আহ্বানে তিনি শান্তিনিকেতনে যান। সেটি ১৯১৮ খিস্টাব্দের কথা। সেখানেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের সূত্রপাত। শান্তিনিকেতনের সঙ্গে যোগাযোগ তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। শান্তিনিকেতনের-এর জীবন প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন : “একান্ত উৎসাহে ভাস্বর সেই অভিজ্ঞতা আজ পর্যন্ত আমার মানসিক অধিকারের বাইরে রয়ে গেছে। শালবীথির তপ্ত ছায়াবৃত মর্মর, ছাতিমতলার শুভ্র স্তব্ধ পাথর এবং উৎকীর্ণ মন, রবীন্দ্রনাথের গভীর বাক্যালাপ এবং অজস্র আতিথ্য, প্রমথবাবুর হাস্যকৌতুকময় প্রখর মননশীল আলোচনা ও বন্ধুত্বের অযাচিত দান একটি অপরিণত, অজ্ঞাত বাঙালি ছেলের সমস আশা-কল্পনাকে ছাপিয়ে অপরূপ হয়ে দেখা দিয়েছিল। আজও বুকে জেগে আছে আকাশমাঠখোয়াইয়ের পাণ্ডুর উজ্জ্বল বলয়-চক্র, দারুণ গ্রীষ্মে উৎফুল্ল আমলকী-সারি এবং বহু দূরে পাড়-বসানো সবুজ তালতড়ি। আশ্রমেরই অভিন্ন অন্তর্গত রূপে সেই দৃষ্টি আমার কৈশোর জীবনে প্রসারিত”।
৮.
১৯২৭ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে স্থায়ীভাবে শান্তিনিকেতনে চলে আসেন অমিয় চক্রবর্তী। পরের বছর রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগেই তাঁর বিয়ে হলো ড্যানিশ কন্যা কোপেনহেগেনবাসী হিয়োর্ডিস সিগার্ড (Hjordis Siggaard)-এর সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ বিদেশিনী নববধুর নাম দিয়েছিলেন হৈমন্তী। এ-বিয়েতে কন্যাসম্প্রদানের দায়িত্ব পালন করেছিলেন রবীন্দ্র-সহচর সি এফ এণ্ড্রুজ। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে বার্মিংহামে থাকাকালীন সময়ে তাদের একটি কন্যা সেমন্তী(ভট্ট্রাচার্য)-এর জন্ম হয়। সেমন্তী স্বামী ড: সুব্রত ভট্টাচার্য ও পুত্রকন্যাসহ শিকাগো-তে বসবাস করছেন।
৯.
১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সচিব হিসেবে কাজ করেছেন। সাহিত্য সচিব হিসেবে যে-কাজ তাঁকে করতে হয়েছে কবি নিজে তার বর্ণনা দিয়েছেন: “কবিতা এবং অন্যান্য সব রচনার পাণ্ডুলিপি রক্ষাভার ছিল আমার উপরে। তা’ ছাড়া নবরচিত গানের দ্রুত কয়েকটি কপি ক’রে দিনুবাবু (দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর) এবং শিক্ষার্থী তরুণ-তরুণীদের হাতে তা’ বিলি করতাম।”
১০.
বারবার পাণ্ডুলিপি সংশোধন করতেন রবীন্দ্রনাথ। এমনকী ছাপা হ’য়ে যাওয়ার পরও চলতো সংস্কার। আর ফলে ফর্মা ছাপা হ’য়ে যাওয়ার পরও বিশ্বভারতীর প্রেসে ছুটে যেতে হয়েছে অমিয় চক্রবর্তীকে। খসড়ার পর বারবার ঘষা-মাজার অভ্যাস দাঁড়িয়ে যায় রবীন্দ্রনাথের সবুজ পত্রের যুগ থেকে। ফলে একই রচনা বারবার কপি করতে হতো। এই কপি করার কাজেও অক্লেশে নিয়মিত অংশ নিতেন অমিয় চক্রবর্তী ও স্ত্রী হৈমন্তী। রবীন্দ্রনাথের জরুরি প্রয়োজনে একবার সারারাত জেগে তাঁকে ”মুক্তধারা” নাটকটির কপি তৈরী করতে হয়েছিল।
১১.
পৃথিবীর নানা মণিষার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যোগাযোগ ছিল তাঁর এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য-সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি শান্তিনিকেতনে থাকতেন। তাঁর কাজ ছিলো, বিদেশী অতিথিদের পরিচর্য করা, ক্লাস নেয়া, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নানা গ্রন্থ-তথ্য সংগ্রহরে দিয়ে সাহায্য করা, তাঁর বিদেশ যাত্রার সঙ্গী হওয়া ইত্যাদি।
১২.
সাহিত্য সচিবের দায়িত্ব ছাড়াও পরে অবশ্য বিশ্বভারতীর সকল প্রকার কাজেই অমিয় চক্রবর্তীকে জড়িয়ে পড়তে হলো ; বিশেষ ক’রে রবীন্দ্রনাথ ও রথীন্দ্রনাথের অনুপস্থিতিতে। বিশ্বভারতীর কাজেকর্মে রথীন্দ্রনাথ, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ, অপূর্বকুমার চন্দ প্রমুখের সঙ্গে অমিয় চক্রবর্তী ধীরে-ধীরে নেতৃস্থানীয় দায়িত্ব পালন করছেন। রবীন্দ্রনাথের উপদেশকদের মধ্যে অল্পদিনের মধ্যেই তিনি ঠাঁই পেয়েছেন। প্রাথমিকভাবে তাঁর কাজ ছিল রবীন্দ্রনাথের পরিকল্পনাগুলোর ওপর প্রতিবেদন তৈরী ক’রে সবাইকে জানিয়ে সে-সব বাস্তবায়নের সূত্রপাত করা।
১৩.
একবার ঠিক হলো ১৩৩৯ বঙ্গাব্দ থেকে ১৩৪৭ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত লিখিত কবিতাগুলো রবীন্দ্রনাথের ১৩৪৭ বঙ্গাব্দের জন্মদিনে একত্রে গ্রন্থনা করে প্রকাশ করা হবে। কিন্তু কবিতা সবগুলো এক মেজাজ বা ধাঁচের ছিল না। অমিয় চক্রবর্তী প্রস্তাব করলেন অন্তত: দু’টি গ্রন্থে ভিন্নধর্মী এই কবিতাগুলো সংকলনের জন্যে। একগুচ্ছ কবিতায় রয়েছে সুরের প্রধান্য, “ভাব-রুচির চেয়ে হৃদয়বৃত্তির আলাপ”; সেগুলো গ্রন্থিত হলো ”সানাই” নামে। আর অন্য গুচ্ছ যাতে কবিগুরুর “জীবনের দর্শন দু:খ-মৃত্যু ছায়াকে অতিক্রম করে গেছে” সেগুলো সংগ্রন্থিত হলো ”নবজাতক” নামে।
১৪.
মানবতাবাদি মনীষী শিবনারায়ণ রায় ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত তাঁর “কবির নির্বাসন ও অন্যান্য ভাবনা” নামক বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থটি অমিয় চক্রবর্তীকে উৎসর্গ করেছেন এই লিখে: “কবি ও মনীষী সহৃদয় বিশ্বনাগরিক অমিয় চক্রবর্তি শ্রদ্ধাভাজনেষু”।, আক্ষরিক অর্থেই কবি অমিয় চক্রবর্তী ছিলেন একজন বিশ্ব নাগরিক। পৃথিবীর নানা দেশে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন। কখনো জীবিকার তাগিদে, কখনো-বা নিছক পরিব্রাজক হিসেবে। ভ্রমণে আমৃত্যু ছিলেন অক্লান্ত।
১৫.
জীবনের শুরুতেই সূচনা হয় বিশ্ব পর্যটনের। অমিয় চক্রবর্তীর বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রবীন্দ্র-ভক্ত এণ্ড্রুজের বন্ধু হরেস আলেকজাণ্ডার। তিনি অমিয় চক্রবর্তীকে বিলেতের বার্মিংহামের উডব্রুক কলেজে আমন্ত্রণ জানালেন। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে সেই কবির প্রথম বিদেশ যাত্রা। সেখানে প্রায় এক বৎসর ধরে ভারতবর্ষ ও আন্তর্জাতিকতা এবং ধর্ম বিষয়ে বক্তৃতা দেয়ার সুযোগ হলো। পরে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি অধ্যয়ন ও গবেষণা করেছেন। অক্সফোর্ডের ব্রেজনোস্ কলেজে সিনিয়র রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করেছেন ১৯৩৭ থেকে ১৯৪০ সাল অবধি। এ-সময় ব্যাপক ভাবে ভারতবর্ষ-ইরান-আফগানিস্থান সফর করেছেন আধুনিক কালে ধর্মআন্দোলন বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের জন্যে।
১৬.
রবীন্দ্রনাথের সহকারীরূপেও অনেক দেশে গিয়েছেন অমিয় চক্রবর্তী। প্রকৃতপক্ষে বিশ্ব-পরিব্রাজক রবীন্দ্রনাথের চেয়েও অনেক বেশি ভ্রমণ করেছেন তিনি। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে জার্মানি, ডেনমার্ক, রাশিয়া এবং আমেরিকা ভ্রমণ করেছেন রবীন্দ্রনাথের সহযাত্রী হিসেবে। পরে আরো দু’বার রাশিয়া ভ্রমণ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পারস্য ও মধ্য-প্রাচ্য ভ্রমণ করেছেন ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে।
১৭.
বিশ্বনাগরিক অমিয় চক্রবর্তী প্রশান্ত এবং আটলাণ্টিক মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ, পূর্ব ও পশ্চিম এশিয়া, দূরপ্রাচ্য, আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা এবং জাপান ও কোরিয়া সহ পৃথিবীর নানা দেশ-মহাদেশ বহুবার পরিভ্রমণ করেছেন। পৃথিবীর নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন যার মধ্যে রয়েছে আমেরিকার হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়, কান্সাস বিশ্ববিদ্যালয়, বস্টন বিশ্ববিদ্যালয়, স্মিথ্ কলেজ, ন্যুইয়র্ক স্টেট ইউনিভার্সিটি এবং ভারতের কলকাতা ও মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি। বিভিন্ন দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছেন বক্তৃতা দেয়ার জন্যে। অ্যালবার্ট আইনস্টাইন এবং রবার্ট ওপেন্হাইমারের আমন্ত্রণে ১৯৫১-তে প্রিন্স্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্ষ্টিট্যুট অব অ্যাডভান্স্ড স্টাডিস্-এর ফেলো হিসেবে ভ্রমণ করেছেন। ঐ ১৯৫১-রই গ্রীষ্মে পূর্ব ও পশ্চিম বার্লিন প্রোটেস্টাণ্ট চার্চ সম্মেলনে আমনিত প্রতিনিধি হিসেবে অংশগ্রহণ করেছেন। এই সময় পশ্চিম ও পর্ব জর্মানির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় ধর্ম এবং প্রাচ্য সাহিত্য বিষয়ে বক্তৃতা দিয়েছেন। একাধিকবার অস্ট্রেলিয়াতে গিয়েছেন শিবনারায়ণ রায়ের আমন্ত্রণে। তাঁর মনোহর, অপ্রতীম বক্তৃতায় মুগ্ধ করেছেন মেলবর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের।
১৮.
এই ভ্রমণের সূত্রে বিশ্বখ্যাত অনেক মণীষীর সঙ্গেই তাঁর ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। জাপানে জেন মণীষী সুজুকি-র সঙ্গে গড়ে ওঠে গভীর বন্ধুত্ব। আফ্রিকায় অ্যালবার্ট শোয়াই্ট্জার এর সঙ্গে তাঁর সেবাকেন্দ্র গাবুন অঞ্চলে লন্বারেনে-তে বাস, ১৯৫৪। ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে কবি বরিস পাস্টেরনাকের সঙ্গে হয় ঘনিষ্ঠ পরিচয়। এছাড়াও কবি ইয়েটস্, জর্জ বাণার্ড শ, কবি রবাট ফ্রষ্ট, পাবলো কাসলস্ প্রমুখের সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে ওঠে তাঁর।
১৯.
১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে থেকে ভারত ছেড়ে স্থায়ীভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হয়েছিলেন অমিয় চক্রবর্তী। মার্কিন প্রবাস থেকে দেশের অমোঘ টানে প্রায় নিয়মিতই তিনি দেশে এসেছেন। মৃত্যুর আগে ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে আবার ঘরের ছেলে ঘরে ফিরেছেন স্ত্রী হৈমন্তী চক্রবর্তীর বিশেষ প্রেরণায়। এ-প্রসঙ্গে শিবনারায়ণ রায় জানিয়েছেন: “তাঁর আশঙ্কা ছিল শান্তিনিকেতন তাকে স্থানু করে রাখবে। যে ভ্রাম্যমাণতা তাঁর চারিত্র্য এবং কবি কল্পনাকে অবসিত হতে দেয় না, শান্তিনিকেতনে এসে তা হারিয়ে ফেলবেন। তিনি চেয়েছিলেন শেষ পর্যন নিউ পলজ্-এই থাকবেন, এবং সেখান থেকে সাধ্যমতো ঘোরাফেরা করবেন। কিন্তু বয়স আশি পেরিয়েছিল, শরীর জীর্ণ হয়ে পড়েছিল, হৈমন্তী চক্রবর্তীর তাঁকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে আসাই সংগত বিবেচনা করলেন।”
২০.
বাংলা কবিতায় আধুনিকতার পথিকৃৎ পঞ্চপাণ্ডবদের অন্যতম একজন অমিয় চক্রবর্তী। তাঁর প্রথমদিককার কবিতা রবীন্দ্রনাথের প্রভাব থাকলেও তিনি অচিরেই স্বকীয়তা অর্জন করেন। প্রথম দুটি কাব্যগ্রন্থ কবিতাবলী এবং উপহার প্রকাশের পর ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ খসড়া, যার মধ্য দিয়ে তিনি জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে প্রমুখের সঙ্গে এক পংক্তিতে স্থান দখল করে নেন। এ সময় কবিতা পত্রিকায় বুদ্ধদেব বসু মন্তব্য করেন যে, “খসড়া প্রকাশের পর অমিয় চক্রবর্তীকে উল্লেখযোগ্য বাঙালি কবিদের অন্যতম বলে মেনে নিতে আমাদের দ্বিধা করা উচিত নয়।” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অমিয় চক্রবর্তীর কবিতার মধ্যে প্রত্যক্ষ করেছিলেন “অনুভূতির বিচিত্র সূক্ষ্ম রহস্য”, বিশ্বসাহিত্যের স্পর্শ।
২১.
সাহিত্যের ছাত্র ও অধ্যাপক, ধর্মতত্ত্ব-রাজনীতি, দশর্ন শাস্ত্রে সুপণ্ডিত, বিশ্বসাহিত্যের তন্নিষ্ঠ পাঠক অমিয় চক্রবর্তী ছিলেন মননঋদ্ধ মানুষ। তাঁর কবিতায় আবেগের সঙ্গে মিশে গেছে মননশীলতা। তাঁর কবিতায় প্রগাঢ় দার্শনিকতার মধ্যে অন্তর্লীন হয়ে আছে প্রবল সময় ও সমাজ-সচেতনতা। একটি কবিতায় তিনি লিখেছেন:
‘বাঙলার মেয়ে, এসে ছিল তার জীবনের দাবি নিয়ে,
দুদিনের দাবি ফলন্ত মাঠে, চলন্ত সংসারে;
কতটুকু ঘেরে কত দান ফিরে দিতে।
সামান্য কাজে আশ্চর্য খুশি ভরা।
আজ শহরের পথপাশে তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েকোথা
সভ্যতা ছোটে তেরোশো পঞ্চাশিকে।’
ছন্দ, শব্দ চয়ন, শব্দ ব্যবহারের ধাঁচ, পংক্তি গঠনের কায়দা সবকিছু মিলিয়ে তিনি ছিলেন বাঙালী কবিদের মধ্যে অনন্যসাধারণ। কঠিন সংস্কৃত শব্দও তাঁর কবিতায় প্রবেশ করেছে অনায়াস অধিকারে। তাঁর কবিতায় জাগ্রত চৈতন্যের সঙ্গে সঙ্গে অবচেতনার প্রক্ষেপ পরিলক্ষিত হয়।
২২.
ছেলেবেলা থেকেই সঙ্গীতে ছিল তাঁর বিশেষ আকর্ষণ। তাঁর শৈশব কেটেছে আসাম-গৌরীপুরে। গৌরীপুরে যাত্রা-নাটক আর জারি-সারি, বাউল-কীর্তনের আসরে তাঁর নিয়মিত যাতায়াত ছিল। অন্যদিকে মামার বাড়ীতে ইয়োরোপীয় সঙ্গীতের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। ইয়োরোপীয় ধ্রূপদী সঙ্গীতের সঙ্গে তাঁর এই পরিচয় ছিল অসামান্য। রাশিয়ার ববোডিন, জার্মানির প্রাতিভ, এবং পিয়ানো, ভায়োলিন ও অর্কেষ্ট্রার শ্রেষ্ঠ কম্পোজারদের সঙ্গীতের সঙ্গে-সঙ্গে ভারতীয় মার্গসংগীতের নিত্য শ্রোতা ছিলেন তিনি। তারপর এক সময় গান লিখতে শুরু করেন। আর তাতে কখনো কখনো তিনি নিজেই সুরারোপ করেছেন।
২৩.
অমিয় চক্রবর্র্তী যে সব পত্র-পত্রিকায় কম-বেশী নিয়মিত লিখেছেন তার মধ্যে রয়েছে কবিতা, বিচিত্রা, উত্তরসূরী, কবি ও কবিতা, পরিচয়, প্রবাসী প্রভৃতি। এর মধ্যে এক “কবিতা” পত্রিকাতেই অমিয় চক্রবর্তীর বেশ ক’টি গদ্য রচনা প্রকাশিত হয়েছিল: ‘এজরা পাউণ্ড: কবিতা’র দরবারে পত্রাঘাত’ (পৌষ ১৩৫৫), ‘এলিয়টের নতুন কবিতা’ (পৌষ ১৩৫০), ‘জয়েস প্রাসঙ্গিকী’ (কার্তিক, ১৩৪৮), ‘মার্কিন প্রবাসীর পত্র’ (পৌষ, ১৩৬০), ‘রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি’ (আশ্বিন, ১৩৪৮), ‘শেষের কবিতা’র লাবণ্য’ (আশ্বিন, ১৩৫৩) এবং ‘সমালোচকের জল্পনা’ (আশ্বিন, ১৩৫০)।, এছাড়া বুদ্ধদেব বসুর “নতুন পাতা” এবং সমর সেনের “গ্রহণ ও অন্যান্য কবিতা” গ্রন্থদ্বয়ের সমালোচনাও প্রকাশিত হয়েছিল (যথাক্রমে পৌষ ১৩৪৭ এবং কার্তিক ১৩৪৭ সংখ্যায়)। “কবিতা” পত্রিকায় চৈত্র ১৩৬২ সংখ্যায় বুদ্ধদেব বসুকে লেখা একটি খোলা চিঠি মুদ্রিত হয়েছিল ‘ছন্দ ও কবিতা’ এই শিরোনামে ।
২৪.
‘কাব্যাদর্শ’ শীর্ষক প্রবন্ধটি মুদ্রিত হয়েছিল ত্রিকালী পত্রিকায় ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে। ‘দুটি ইংরেজী কবিতা’ প্রকাশিত হয়েছিল পরিচয় পত্রিকায়, বৈশাখ ১৩৪২ সংখ্যায়। ‘প্রমথ চৌধুরী – ক্ষুদ্র অর্ঘ্য’ প্রকাশিত হয়েছিল “বিশ্বভারতী পত্রিকা”-এর শ্রাবণ-আশ্বিন ১৩৭৫ সংখ্যায়। “পারাপার”-এর অন্তর্ভুক্ত ‘বৃষ্টি’ কবিতাটি নিয়ে কবি নরেশ গুহ একটি আলোচনা লেখেন কবিতা-পরিচয় পত্রিকায়, আষাঢ় ১৩৭৩ সংখ্যায়। এই আলোচনার সূত্রে, মনুজেশ মিত্র, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত এবং সুতপা ভট্টাচার্য সমালোচনা করেন। অমিয় চক্রবর্তী নিজেও এ ব্যাপারে তাঁর বক্তব্য প্রকাশ করেন। একই পত্রিকায় পরবর্তীতে প্রকাশিত ঐ লেখাটিতে তিনি লেখেন, “ ‘বৃষ্টি’র আলোচনায় দু-একটি প্রশ্ন আছে, তার উত্তরে কিছু বলতে চাই।”
২৫.
দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকার জন্য অমিয় চক্রবর্তীর অনেক প্রবন্ধ-নিবন্ধ পত্রাকারে রচিত। এ-প্রকৃতির রচনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘মার্কিন প্রবাসীর পত্র’ এবং ‘ছন্দ ও কবিতা’। “কবিতা” পত্রিকায় বরিস পাস্টেরনাক ও তাঁর ডঃ জিভাগো নিয়ে দু’টি চিঠি লিখেছিলেন অমিয় চক্রবর্তী। এ-ছাড়া পত্রাকারে রচিত প্রবন্ধ-নিবন্ধের মধ্যে রয়েছে ‘ইয়োরোপে রবীন্দ্রনাথ’। শ্রীযুক্ত সোমনাথ মিত্রকে লেখা এ প্রবন্ধলিপিটি “প্রবাসী” পত্রিকার কার্তিক ১৩৩৭ সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল। “মস্কৌ-এর চিঠি’’ নামে দু’টি প্রবন্ধ ছাপা হয়েছিল বিচিত্রা পত্রিকার বাংলা ১৩৩৮ সনের যথাক্রমে মাঘ ও ফাল্গুন সংখ্যায়। “প্রবাসী” পত্রিকায় আরো তিনটি পত্রাকার প্রবন্ধ-নিবন্ধ ছাপা হয়েছিল; যথা (ক) ‘ফিনল্যান্ডের চিঠি’, কার্তিক, ১৩৪৩ সংখ্যায, (খ) ‘প্যালেষ্টাইন প্রাসঙ্গিক’ কার্তিক, ১৩৪৪ সংখ্যায এবং (গ)‘প্যালেষ্টাইনে হেরফের’, অগ্রহায়ণ, ১৩৪৪ সংখ্যা। এই ধাঁচের লেখাগুলো সম্পর্কে সুমিতা চক্রবর্তীর মন্তব্য এরকম: “ … ভ্রমণমূলক প্রবন্ধগুলিতে অমিয় চক্রবর্তীর মানসিক গঠনের একটা মৌলিক প্রাথমিক সূত্র পাওয়া যায়।”
২৬.
এ-ছাড়া “বিচিত্রা” পত্রিকার শ্রাবণ, ১৩৩৫ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘সাহিত্য ব্যবসায়’।, একই পত্রিকার শ্রাবণ, ১৩৩৮ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘সংকলন’। স্টেলা ক্রামরিশের লেখা একটি প্রবন্ধ তিনি ইংরেজী থেকে বাংলায় অনুবাদও করেছিলেন। এটি ‘ভারতীয় শিল্প প্রতিভা’ নামে “প্রবাসী”-এর আশ্বিন, ১৩২৯ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। এ-ছাড়াও তিনি ইংরেজীতে বেশ কিছু সংখ্যক সংখ্যক প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা করেছেন। এ-সকল প্রবন্ধ আন্তর্জাতিক মানের একাডেমিক জার্নালসহ বিভিন্ন সংকলন-গ্রন্থে প্রকাশিত হয়।
২৭.
সাহিত্য সমালোচকদের মতে, অমিয় চক্রবর্তীর কবিতার মূল্যায়ন প্রসঙ্গে সমকালীন সাহিত্য আবহাওয়া সর্ম্পকেও ধারণা থাকা প্রয়োজন। এ সম্পর্কে শিবরারায়ণ রায় লিখেছেন: “তিরিশ এবং চল্লিশের দশকে বাংলা সাহিত্যে বহুজনিক প্রতিভার সেই একই সঙ্গে প্রস্ফুটন আজও অপ্রতিম। বঙ্কিমের পরে প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে রবীন্দ্রনাথ এই সাহিত্যের বস্তুত: একচ্ছত্র সম্রাট; তাঁর অনিঃশেষ প্রতিভা তাকে নানা ভাবে পরিপুষ্ট এবং চালিত করে এসেছে; শরৎচন্দ্র, প্রমথ চৌধুরী এবং নজরুল ইসলাম তাঁর সমকালের শক্তিশালী এবং প্রভাবশালী লেখক হওয়া সত্ত্বেও সাহিত্যে পর্বান্তর ঘটান নি। রবীন্দ্র প্রতিভার বর্ণাঢ্যকালে সাময়িকভাবে হলেও নতুন পর্ব সূচিত হয়; গদ্যে-পদ্যে যুগপৎ দেখা দেয় অনেকগুলি প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব। বিষয় নির্বাচনে, প্রতিন্যাসে, রীতিসংক্রান্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষায় যাঁদের মৌলিকতা আজ প্রশ্নাতীত। কবিতায় জসীমউদ্দিন, জীবনানন্দ, সুধীন্দ্র, অমিয়, বুদ্ধদেব, বিষ্ণু, সমর সেন; কথাসাহিত্যে প্রেমেন্দ্র, বিভূতিভূষণ, তারাশংকর, অন্নদাশঙ্কর, মানিক, ধূর্জটিপ্রসাদ- প্রত্যেকের সাহিত্যসৃষ্টি নিজস্বতার দ্বারা চিহ্নিত এবং সমবেতভাবে নতুন পর্বের স্বাক্ষরবাহী।” কবি আল মাহমুদ লিখেছেন, সুধীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ দাশ ও বুদ্ধদেব বসুর কাছে তাঁর “ঋণ এমন অপরিশোধ্য যে, তা উচ্চারণ করাও বাহুল্য বলে গণ্য হতে পারে”।, অন্যদিকে কবি অমিয় চক্রবর্তী তাঁকে “ঋণগ্রস্ত না করে করেছিলেন বিস্মিত ও অভিভূত”। আল মাহমুদের আরো স্বীকারোক্তি, “…তার মিল ও পঙক্তি বিন্যাসের অনভ্যস্ত প্রয়োগ আমার কাছে কিছু দিন অত্যনন্ত লোভনীয় মনে হলেও এর দুরূহতা শেষ পর্যন্ত আমাকে নিশ্চেষ্ট না করে ছাড়ে নি। এমন কি পয়ারের কারুকাজেও। আবদুল মান্নান সৈয়দও অমিয় চক্রবর্তীর অনন্যতা সম্পর্কে সমরূপ ধারণাই পোষণ করেছেন। তিনি লিখেছেন, “… অমিয় চক্রবর্তীর কবিতা একেবারেই অন্যরকম। কোন পোগান বা চীৎকৃত বাক্যের থেকে অনেক দূরে: মননাশ্রিত, এ্যাবস্ট্রাক্ট অথচ মমতার ঘন নিবিড়।”
২৮.
১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলা একাডেমী কর্তৃক প্রকাশিত চরিতাভিধানে তাঁকে “সৃজনশীল গদ্য শিল্পী” হিসেবে আখ্যায়িত করে বলা হয়েছে যে, ত্রিশোত্তর বাংলা গদ্য সাহিত্যে তিনি একটি বিশিষ্ট রীতির প্রবর্তন করেন। অমিয় চক্রবর্তী মূলত: কবি। কবিতাতেই তাঁর শিল্পী মন ও মননশীলতার অকৃত্রিম ও বিশিষ্টতাপূর্ণ প্রকাশ। তাঁর প্রবন্ধকসমূহ কোনোক্রমেই অনুল্লেখ্য যদিও নয়, তবু শেষ বিচারে তিনি বিশেষ ভাবে প্রাবন্ধিক সত্তার অধিকারী ছিলেন বলে মনে হয় না। এ গ্রন্থের প্রবন্ধগুলি তার প্রমাণ। এ-ছাড়া উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রবন্ধ পত্রাকারে লিখিত যা এই ধারণাকে সমর্থন করে। প্রবন্ধের নিরেট কাঠামোর পরিবর্তে একটি ঢিলে-ঢালা ঘরোয়াভাব অধিকাংশ প্রবন্ধে পরিলক্ষিত হয়। কাঠামোর এই দুর্বলতা সত্বেও তাঁর প্রবন্ধসমূহ সাহিত্য-শিল্প বিষয়ে তাঁর মৌলিক চিন্তা-চেতনায় অভিজ্ঞান হ’য়ে আছে। ব্যাপক পঠন-পাঠন, অভিজ্ঞতা আর মননশীলতার সংমিশ্রণে এই প্রবন্ধগুলি অনন্যসাধারণ অপ্রথাসিদ্ধ মাত্রা পেয়েছে। প্রাবন্ধিক অমিয় চক্রবর্তীকে এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করাই যথোপযুক্ত হ’বে।
২৯.
তাঁর প্রথম প্রকাশিত বই কবিতাবলী (১৯২৪-২৫)ছাড়াও তাঁর অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে উপহার (১৯২৭), এক মুঠো (১৯৩৯), মাটির দেয়াল (১৯৪২), অভিজ্ঞান বসন্ত (১৯৪৩), পারাপার (১৯৫৩), পালাবদল (১৯৫৫), ঘরে ফেরার দিন (১৯৬১), হারানো অর্কিড (১৯৬৬), পুষ্পিত ইমেজ (১৯৬৭), অমরাবতী (১৯৭২), অনিঃশেষ (১৯৭৬), নতুন কবিতা (১৯৮০), চলো যাই (১৯৬২), সাম্প্রতিক (১৯৬৩)উল্লেখযোগ্য। গদ্যের মধ্যে চলো যাই, সাম্প্রতিক, পুরবাসী, পথ অন্তহীন, অমিয় চক্রবর্তীর প্রবন্ধ সংগ্রহ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ইংরেজি ভাষায় রচিত তাঁর ৯টি বই রয়েছে, The Dynasts and the Post-War Age in Poetry (অক্সফোর্ড ১৯৩৮); Modern Tendencies in English Literature (কলকাতা ১৯৪২); Amiya Chakrabarty in Enghlish Translation(Santiniketan 1990) ও অন্যান্য।
৩০.
কবিতার জন্য তিনি বহু পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। উল্লেখযোগ্য পুরস্কার: ইউনেস্কো পুরস্কার (১৯৬০), ভারতীয় ন্যাশনাল একাডেমী পুরস্কার। বিশ্ব ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ‘দেশিকোত্তম’ (১৯৬৩) এবং ভারত সরকার ‘পদ্মভূষণ’ (১৯৭০) উপাধিতে ভূষিত করেন। অমিয় চক্রবর্তী জীবনের শেষ দিনগুলি শান্তিনিকেতনেই কাটিয়েছেন। ১৯৮৩ সালে তিনি আমেরিকা থেকে ফেরেন। সেখানেই ১৯৮৬ সালের ১২ জুন তিনি প্রয়াত হন।
৩১.
বিশ্বপথিক ছিলেন অমিয় চক্রবর্তী। ছিলেন মানবতাবাদী। সর্বার্থে আধুনিক একজন মানুষের মধ্যেও যে সন্ত মন বিরাজ করতে পারে, দার্শনিক কবি অমিয় চক্রবর্তী তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সাধু-সন্তদের আধ্যাত্মিক মনোজগতে দ্বন্দ্বহীন পৃথিবীর একটা অমল ছবি আঁকা থাকে। কিন্তু কবি অমিয়র সঙ্গতির প্রার্থনা অফুরন্ত দ্বন্দ্ব-সংশয়ের ভেতর দিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছাতে চায়। এখানেই ধরা পড়ে তার আধুনিকতা; তার ভাবুকবৃত্তির নিজত্ব। সেই আন্তর্জাতিকতাবাদী মানবতাবাদী কবির জীবনদর্শন এই ক’টি চরণে বিধৃত :
‘জানি ধর্ম তাই। কোন্ ধর্ম?
ধর্ম কি খ্রীস্টান? প্রাণে-বাঁচা সে কি হিন্দু? আয়ু বৌদ্ধ?
নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস মুসলমানী? রক্ত শিন্টো? জৈন? চৈন?
যে ধর্ম আমরা মানি সে তো উৎস, তারি লোকায়ত
কত ধারা উৎকর্ষের কালে-কালে প্রবাহ কল্যাণী
নেমে এল জনচিত্তে যেখানেই করুণা আধার;
মানুষের কোনো ধর্ম সৃষ্টি তো করেনি সৃষ্টিকে,’
(‘প্রাণের ভৎর্সনা’, অনিঃশেষ, ১৯৭৬)
৩২.
অমিয় চক্রবর্তী লিখেছেন, ‘ফুলকে ছোঁবো। দেখবো। এক হবো মাধুরীর ডুবে/ধ্যানে নয়, টবে নয় মালায়, বোতলে গন্ধ-ফোঁটায়/ফুলকে পাবো বোঁটায়।/সেই ফুলকে, দিনের অলৌকিক/বনের, আমার মনের, মিলিত যৌবনের’ (বাস্তবিক/কাব্যগ্রন্থ : একমুঠো)। আমার প্রিয় অমিয় চক্রবর্তীর আরেকটি কবিতা ‘রাত্রি’ পাঠ করে মূলতবি টানছি।
‘অতন্দ্রিলা,
ঘুমোওনি জানি
তাই চুপি চুপি গাঢ় রাত্রে শুয়ে
বলি, শোনো,
সৌরতারা-ছাওয়া এই বিছানায়
—সূক্ষ্মজাল রাত্রির মশারি—
কত দীর্ঘ দুজনার গেলো সারাদিন,
আলাদা নিশ্বাসে—
এতক্ষণে ছায়া-ছায়া পাশে ছুঁই
কী আশ্চর্য দু-জনে দু-জনা—
অতন্দ্রিলা,
হঠাত্ কখন শুভ্র বিছানায় পড়ে জ্যোত্স্না,
দেখি তুমি নেই ||’
(তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া, বাংলাপিডিয়া, কালি ও কলম, দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা, দৈনিক যুগান্তর, ইন্টারনেট)
আবদুল্লাহ আল মোহন
১২ জুন, ২০১৬/ ১২ জুন, ২০১৮