আবদুল্লাহ আল মোহন
১.
লোকজনকে কী করে বোঝাই বলুনতো, আমাদের ভাসানটেক সরকারি কলেজটি আসলেই একটি বাস্তবের কাশবনের ফুলেল দ্বীপ? ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র হোসেন মিয়ার ‘ময়না দ্বীপ’ নয় মোটেই, এটি ‘পাবনার পুলা’ মোহন মিয়ার আজন্মের জীবনান্দের নিত্য উৎসস্থল ভাসানটেকের বস্তির মাঝখানে ঠিক যেন যমুনার চরের অবিকল প্রস্ফুটিত কাশবনের ‘কাশদ্বীপ’? প্রিয় কবি নির্মলেন্দু গুণ তাঁর গ্রামের আদি নাম বদলে ‘কাশবন’ রাখতে পারলে, আমি রাজনীতির ছাত্র হয়ে আমার লেখার কল্পরাজ্য তথা ‘ইউটোপিয়া’য় কেন চিত্তানন্দ মত্ততায় ‘আমার ভুবন’কে ‘কাশ দ্বীপ’ নামে ডাকতে পারব না ? আমি তো আর ‘মোহন দ্বীপ’ নাম রাখিনি, রাখতে চাইছিও না। তাহলে না হয় আমার বিরুদ্ধে পরিবারতন্ত্রের, চরম স্বজনপ্রীতির অভিযোগ আনতে পারতেন অভাজন কেউ ? তবে জীবন বাবাজী বাজী রেখে, আরেকটু বাড়তি উন্মাদনায় ‘আকাশ মোহন দ্বীপ’ রাখলে কী সন্দীপ মন খারাপ করে মানহানির মামলা করবে এই ‘হুজ্জুতে বাঙাল’-এর দেশে? গায়কগুরু জটিলেশ্বরকে ভুলিনি বলেই সবেধন নীলমনি মত একটিমাত্র ‘কল্লা’ হারানোর ভয়ে বলতে সাহস পাই না, ‘কইতে কথা বাধে’, ‘আমার স্বপন কিনতে পারে এমন স্বজন কই’ ? ধান ভানতে শীবের গীতে ইতি টানি। ইদানিং, এই শরতে, মন মোর মেঘের সঙ্গী হয়ে গাইছে, যেমন করে গাইছে আকাশ, ‘নীলাকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা..! ’ হ্যাঁ, নীলাকাশে সাদা মেঘের ভেলা ভাসিয়ে মোহন মন ছেড়ে প্রকৃতিতে এসেছে শরৎ। রৌদ্র-মেঘের ছায়ার খেলা, ছড়িয়ে পড়া শিউলি ফুল, দুলতে থাকা কাশবন, দুর্গাপুজোর আয়োজনের হাঁকডাক জানিয়ে দিলো শরৎ এসেছে। প্রকৃতিতে ছড়িয়ে পড়েছে শরৎ আবহ। বর্ষার বিষন্নতা পরিহার করে শরৎ এসেছে শান্ত স্নিগ্ধ কোমল রূপ নিয়ে হেমন্তের ঘরে পিঠে-পুলি খেতে যাওয়ার জন্যে। শরৎ এসেছে বলেই বাংলা মায়ের ঘরে, প্রকৃতিতে নেই কোনো মলিনতা, আছে কেবল নির্মল আনন্দ আর অনাবিল উচ্ছ্বাস। কি অপূর্ব রঙের খেলা, কি অপূর্ব মায়াবী রঙিন ভুবন সাজায় প্রকৃতি শরৎ এর বুকে তা মনোদৃষ্টি না দিয়ে দেখলে বোঝা যায় না। প্রাণবন্ত শরতের শান্ত ও স্নিগ্ধ রূপ মনে এক প্রশান্তি এনে দেয়। দিনের সোনালী রোদ্দুরের ঝিলমিলি আর রাতের ধবধবে জ্যোৎস্নার টানে মন হয়ে উঠে মাতোয়ারা। শরৎকে বলা হয় শুভ্রতার প্রতীক! সাদা কাশফুল, শিউলি, স্নিগ্ধ জ্যোৎস্না, আলোছায়ার খেলা দিনভর এইসব মিলেই তো শরৎ। শরতের স্নিগ্ধতা এক কথায় অসাধারণ! জলহারা শুভ্র মেঘের দল যখন নীল, নির্জন, নির্মল আকাশে পদসঞ্চার করে তখন আমরা বুঝতে পারি শরৎ এসেছে। শরতের আগমন সত্যিই মধুর। জয় বাবা শরৎ, সেই সাথে জাতক চন্দ্রবাবুরও জয় ঘোষণা করছি!
২.
খেয়ালী ঋতু শরতের দিন আমার কেটে যায় নানা খেয়ালীপনায়, আমার একা এবং কখনো কখনো ‘পাগলপরা’ কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রীকে সাথে নিয়ে। এ যেন ‘আজি শরত তপনে প্রভাত স্বপনে…’ উদাসী শরতেরই মেঘ বৃষ্টি রোদের খেলার সমারোহের মত। আমার দেবশিশু মহুয়ার মতোন নাকি কোন অজানা প্রেয়সীর মতোন লুকোচুরি খেলতেই ভালোবাসে খেয়ালী ঋতু শরত বুঝে ওঠা হয় না কখনোই আর আমার- যে শরৎ আলোছায়ার খেলায় দিনের মাঝে কয়েকবারই রং বদলায় তাকেও। কখনও রোদ ঝরঝরে, কখনও ছায়ামাখা দিন নিয়েই সহবাস করে শরৎ। সেই সাথে স্বাভাবিক প্রস্রবণ বৃষ্টির আলতো পরশ। এ বৃষ্টি ঘরের বউ নয়, প্রেয়সীর মতোন খুবই নম্র, অনেকটা মিষ্টি মিষ্টি হাস্য লাস্যময় কিন্ত শব্দহীন। রবীন্দ্রনাথ যেমনটি লিখেছিলেন, ‘শরতের রং কি প্রাণের রং। অর্থাৎ তাহা কাঁচা, বড় নরম, রৌদ্রটি কাঁচা সোনা, সবুজটি কচি, নীলটি তাজা।’ সেই কঁচি-কাঁচা চির সবুজের জীবনানন্দ নিত্য অনুসন্ধান করি আমি আমার আপন ভুবনে, ভবনের চারপাশে, ভাসানটেকের বস্তিতে, তবে চরম (অ)স্বস্তিতে। আমার দুষ্টু প্রকৃতির ছেলেমেয়েরা রসিকতা করে বলে, ‘আমাদের ভবনটা (ভুবন !) নাকি ফাঁকিবাজির, ছদ্মবেশের, মিথ্যাচারের অত্যাচারের ছোটখাট একটি কারখানা ! ’ কী জানি ! বড় সংশয় জাগে মনে! এটাও বোধহয় শরতেরই কাশফুলের মতোন বড় শুভ্র পবিত্র চরিত্র !
৩.
ক্লাসের ফাঁকে (ফাঁকি দিয়ে নই মোটেই কিন্তু-করজোরে মিনতি করে) আমাদের ভবন, ইট-কাঠ সব ভুলে চারপাশে তাকালেই আমার মনটা সদানন্দে নেচে ওঠে, ঠিক আমার নিত্য সহচর প্রজাপতিটির মতন, ফরিঙের মতন, যেন সজীব সতেজ হয়ে মাখামাখি করে মিশে আছে- দেহের সনে, মনের আকাশেও ভেসে। মাঝে মাঝে বড় বিভ্রম জাগে, সংশয়ী মন বোঝে না, কেবল ভবনটা নাকি ভবনের- ভুবনের প্রাণিগুলো কেন যেন ইট-কাঠ-বালির জমজমাট শক্তির মাঝেই এখানে বন্দি হয়ে পড়ে আছে, কখনোবা ঘুমিয়ে আছে। তবে এ সব ‘অস্থির ভাব-ভাবনা’ ভুলে আমার কেবল তাজা নীল খুঁজতে নজর, দৃষ্টি ছুটে যায় কাশবনে, রঙধনু মেঘ আকাশে।গোপন চাহনি দিয়ে সদা দেখি নীলের মাঝে সাদা মেঘের ভেসে বেড়ানো। কবির কথাই মনে পড়ে- ‘আকাশের কোণে কোণে সাদা মেঘের আলস্য দেখে মন লাগে না কাজে’ (ছুটির আয়োজন)। সত্যিই মন লাগে না কাজে, টানে কেবলই টানে কাশবন। সদলবলে ছুটে যাই তাই তাদের মাঝে। আবার ফিরে এসে ক্লাসে ‘আমার কলেজ ও কাশবন’ নিয়ে উপস্থিত বক্তৃতার আয়োজন করি, সুর সুরা পান করি, করি কাব্যকলার চাষাবাদ সন্তানসম ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে। বিতরণ করি অকাতরে চিরকালের প্রিয় উপহার বই-পত্র-পত্রিকা।
৪.
আমি আমার স্বপ্নময় শৈশবে পাবনার নগরবাড়ী ঘাটের যমুনার চরে গজিয়ে উঠা কাশের বিশাল সমারোহ দেখে দেখে বেড়ে উঠেছি বটে, কিন্তু শিল্পী জয়নুলের মতোন মনের চোখ ছিলো না বলে, তুলি আর ক্যানভাসও তাই আমার হাতে, আঙ্গুলে ঠাই নিয়ে মনের ভাব প্রকাশে রঙধনু সুখ মেটাতে কোন চেষ্টাই করেনি। আমাকে তাই ভীষণই স্মৃতিকাতর করে, আমার ভাসানটেক সরবারি কলেজ এলাকার প্রায় চারপাশের এলোমেলো, বিচ্ছিন্ন কাশবনের সাদা ফুলের দুলে ওঠা, চলমান রঙধনু, মেঘেদের সাথে ঘাসফরিঙ আর প্রজাপতিদের মিতালীর খেলা। যে কারণে তথাকথিত তিলোত্তমা কিন্তু বসবাসের জন্য চরম অসুস্থ রাজধানী ঢাকা মহানগরীর নানান জটিল জীবন যন্ত্রণার মাঝেও তাই শরৎ ঋতু এবং কাশবন আমার সকল চেতনায়, আমার অস্তিত্বে, জীবনে প্রবলভাবে মিশে আছে আমার সেই অতীত স্মৃতি, আমার যমুনার জলের মাঝে জেগে ওঠা চরের কাশবন। প্রবল স্মৃতিকাতর কাশবনের আরেকটি চর হয়ে জেগে ওঠে আমার ভাসানটেক সরকারি কলেজ ক্যাম্পাস, আর সে কারণেই শরতের মনোহর মোহন অপরূপ শোভা দর্শন থেকে আমি পুরোপুরি বঞ্চিত নই মোটেই। রবীন্দ্রনাথ ঠিক অমনি রূপ দেখেই গেয়ে উঠেছেন : ‘অমল ধবল পালে লেগেছে/ মন্দ-মধুর হাওয়া, দেখি নাই কভু দেখি নাই এমন তরণী বাওয়া।’ সেই একই রবীন্দ্রনাথ হয়তো শরতে এতটাই পরিতৃপ্তি বোধ করেছিলেন যে শারদ রাতের প্রভাতে তিনি তাঁর জীবনকাল শেষ হলেও হয়তো দুঃখবোধ করতেন না। উত্তরমুখী তেমন কারও হাতে তাঁর বাঁশির সুর আর মোহন বাঁশিটি অমন করে দিয়ে যেতে চেয়েছিলেন তিনি। তাই তো গেয়েছেন, ‘আমার রাত পোহালো শারদ-বুকে/ বাঁশি-বাঁশি, তোমার দিয়ে যাবো/ কাহার হাতে।’
৫.
আমার যমুনা নদী তীরে, চরের ঘন কাশবনের প্রান্তে কাশফুলের দৃষ্টিনন্দন ভাসমান মেঘদল আজো অপরূপ শোভা ছড়ায়। সেই কাশফুলের অপরূপ সৌন্দর্য পুলকিত করেনি, করে না এমন মানুষ খুঁজে মেলা ভার। নদী চরে প্রবল বাতাসে কাশের দোলের যে মহোৎসব চলত শরৎ কালের পুরোটা সময় জুড়ে, তা দেখে কার না চোখ জুড়াত ? যতদূর চোখ যায় শুধু কাশফুল আর কাশফুল এর কোন শেষ নেই। নীল আকাশে শরতের সেই শুভ্রতার কথা ভুলি কী করে আমি? মমতাময় শুভ্র হাসি দিয়ে সে যেন পথিককে ডাকে, নদীর মাঝিকে কাছে টানে, ভাটিয়ালী গানের সুরও যেন ভুলিয়ে দেয়। চরের পর চর জুড়ে সগৌরবে মাথা উঁচু করে থাকা কাশফুল আজও আমার গোপন আপন স্বপ্নকন্যাই হয়ে মনের বনে চিরস্থায়ী আসন দখল করে আছে। এই কাশবন, কাশের চর দখল করে এমন সাধ্যি আছে কার ? আমার সেই যমুনার চরের শরতের অমৃত হাসি উল্লাস, প্রকৃত রূপ যে দেখেনি কোনদিন, কভু, সে বুঝবে কী তার নয়ন ভুলানো রূপ, ভুবন মোহন রূপ লাবণ্য ঐশ্বয? যমুনার মাঝে জেগে ওঠা চরে খোলা হাওয়ায় নিত্য দুলছে নৃত্যপাগল তন্বী তরুণীর মত, সাদা পেখম মেলে উড়ছে কাশের রেণু, সে এক অদ্ভুত অনুভূতি, স্নিগ্ধতার পরম আবেশ। সে যে আমার শরতেরই অতিথি নারায়ণ, পরমাত্মীয়। সেইসাথে মনটা মেঘের মতোই ছুটে বেড়ায় আলস্য জড়তায়। মনে আসে, ভাসে ছন্দ,সুর-এই শরৎ আলোর কমল বনে / বাহির হয়ে বিহার করে যে ছিল মোর মনে মনে। / তারি সোনার কাঁকন বাজে আজি প্রভাত কিরণ -মাঝে, / হাওয়ায় কাঁপে আচলখানি-ছড়ায় ছায়া ক্ষণে ক্ষণে। ভাবি, এই আকাশ পানে চেয়েই বুঝি কবির মনে হয়েছিল, ‘আজি ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ায় লুকোচুরি খেলা’। সত্যিই শরৎ ‘হৃদয় মাঝে হৃদয় দুলায়, বাহিরে সে ভুবন ভুলায়’ আজি সে তার চোখের চাওয়া ছড়িয়ে দিল নীল গগনে।
৬.
বাংলার ঋতু পরিক্রমার তৃতীয় ঋতু শরৎ। বাংলা ভাদ্র ও আশ্বিন মাস নিয়ে শরৎকাল। ইংরেজি মধ্য আগস্ট থেকে মধ্য অক্টোবর পর্যন্ত শরৎ ঋতুর পথচলা। শরৎকে বলা হয় শুভ্রতার প্রতীক। সাদা কাশফুল, শিউলি, স্নিগ্ধ জ্যোৎস্না, আলো-ছায়ার খেলা দিনভর-এসব মিলেই তো শরৎ। শরৎকালের দ্বিতীয় মাস, অর্থাৎ আশ্বিনের শুরুর দিকেই শরতের আবির্ভাবটা বেশি লক্ষণীয়। শরতের স্নিগ্ধতা এক কথায় অসাধারণ। জলহারা শুভ্র মেঘের দল যখন নীল, নির্জন, নির্মল আকাশে পদসঞ্চার করে তখন আমরা বুঝতে পারি শরৎ এসেছে। শরতের আগমন সত্যিই মধুর। গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদ আর বর্ষায় অঝোর ধারায় শ্রাবণঢলের পর আসে শরতের আলো-ছায়ার খেলা; এই মেঘ, এই বৃষ্টি, আবার এই রোদ। গাছে গাছে শিউলির মনভোলানো সুবাসে অনুভূত হয় শরতের ছোঁয়া। শরতের মেঘহীন নীল আকাশে গুচ্ছ গুচ্ছ কাশফুলের মতো সাদা মেঘের ভেলা কেড়ে নেয় মন। শরতের আকস্মিক বৃষ্টিও মনে আনন্দের বার্তা বয়ে আনে। চারপাশের শুভ্রতার মাঝে বৃষ্টির ফোঁটা যেন আনন্দবারি! বৃষ্টি শেষে আবারও রোদ। দিগন্তজুড়ে সাতরঙা হাসি দিয়ে ফুটে ওঠে রংধনু। প্রকৃতির এ অপরূপ যেন প্রিয় মানুষের সান্নিধ্য চায়। হয়তো ইচ্ছা হয় গোধূলির ওপারে হারিয়ে যেতে প্রিয়জনের হাতটি ধরে। আর তাই প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ এ ঋতুর চরিত্রের সাথে বর্ণনা করেছেন প্রিয়তমাকে। তিনি তার ‘এখানে আকাশ নীল’ কবিতায় লিখেছিলেন, ‘এখানে আকাশ নীল-নীলাভ আকাশজুড়ে সজিনার ফুল/ ফুটে থাকে হিম শাদা-রং তার আশ্বিনের আলোর মতন’।
৭.
শরতের শুভ্রতার কাছে হেরে গেছেন বাংলার প্রত্যেক কবি। শরতের বর্ণনা দিতে গিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘শরৎ, তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি/ ছড়িয়ে গেল ছাপিয়ে মোহন অঙুলি/ শরৎ, তোমার শিশির-ধোয়া কুন্তলে/ বনের-পথে-লুটিয়ে পড়া অঞ্চলে/ আজ প্রভাতের হৃদয় ওঠে চঞ্চলি’। শুভ্রতার ঋতু শরতের বর্ণনা দিয়ে কবিগুরু লিখেছেন, ‘আজি কি তোমার মধুর, মুরতি/ হেরিনু শরৎ প্রভাতে। হে মাতা বঙ্গ-শ্যামল অঙ্গ ঝরিছে অনল শোভাতে’-ঝকঝকে কাচের মতো স্বচ্ছ নীল আকাশ আর তার মধ্যে পেঁজা তুলার মতো সাদা মেঘমালা-এসব নিয়েই প্রকৃতি বরণ করে নেয় শরৎকালকে। শরতে আকর্ষিত কবিগুরু আরো লেখেন, ‘শরতে আজ কোন অতিথি এলো প্রাণের দ্বারে।/ আনন্দগান গা রে হৃদয়, আনন্দগান গা রে…।’ কিন্তু, শরতের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের এক অপরূপ বর্ণনা আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে শরৎকালের সেই মাধুর্য এখন তেমন একটা খুঁজে পায় না মানুষ। তবু বছর ঘুরে ষড়ঋতুর বৈচিত্র্য ছড়াতে আসে শরৎকাল।
৮.
এই শরতের মোহন রূপে ভুলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। শিউলি বনের উদাস বায়ূকে পড়ে থাকতে দেখেছিলেন তরুতলে। দেখেছিলেন শিউলি বনের আন্দোলিত হতে। আর তখনি পথিকের কাছে তাঁর আরতি ছিল- জানি, হল যাবার আয়োজন / তবু, পথিক, থামো কিছুক্ষণ। / যেয়ো- যখন বাদল শেষের পাখি / পথে পথে উঠবে ডাকি। / শিউলি বনের মধুর স্তবে জাগবে শরৎ লক্ষ্মী যাবে / শুভ্র আলোর শঙ্খরবে / পরবে ভালে মঙ্গল চন্দন। প্রভাতের শুকতারাকে শরতের শিউলির সাথে তুলনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ। এই শিউলিই যেন শরতের রাণী। শিউলির গন্ধমাখা বাতাসই জানায় শরতের আগমন। শরতে আজ কোনো অতিথি এল প্রাণের দ্বারে, আনন্দ গান গারে হৃদয় আনন্দ গান গারে….। ‘আজি শরত তপনে প্রভাত স্বপনে/ কী জানি পরান কী যে চায়!…/ আজি মধুর বাতাসে হূদয় উদাসে, রহে না আবাসে মন হায়…!’ শরতের আগমনে এভাবেই উতলা হয়েছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সত্যিই তো শরৎ এসেছে, আকাশে-বাতাসে তারই সৌরভ, প্রীতিগন্ধময় আবেশ ছড়ানো দিন আজ। শুধু রবীন্দ্রনাথই নন শরৎ নিয়ে কাব্য রচনা করেছেন জনপ্রিয় বাংলা গানও রয়েছে শরৎ বন্দনার। কবিগুরুর ভাষায়, ‘তুলি মেঘভার আকাশ তোমার করেছ সুনীল বরণী/শিশির ছিটায়ে করেছ শীতল/ তোমার শ্যামল ধরণী।’সোনা ঝরানো এই ঋতু অবিরল আনন্দের ফল্গুধারা বইয়ে দেয় হূদয়ে-মনে। প্রাণে প্রাণে বাজে মধ্যযুগের বৈষ্ণব কবির বিরহকণ্ঠ, ‘ই ভরা বাদর মাহ ভাদর/শূন্য মন্দির মোর…..।’ শরৎ মানেই যেন জুঁই-শেফালি-শিউলি-বেলির ম’ ম’ সুবাসে ভরে ওঠা মন। বনতল, গৃহ আঙিনায় কেবল গন্ধে মাতাল ফুলের বাহার। আর আকাশে শুভ্র মেঘের ভেলা। জলহারা মেঘমালা পেঁজা তুলোর মতো নীল নভোতলে ভেসে বেড়ায় পথহারা উদাসী পথিকের মতো। শরতের প্রকৃতির বর্ণনা দিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘আজি ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা রে ভাই, লুকোচুরি খেলা-/ নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা রে ভাই– লুকোচুরি খেলা…।’
৯.
রবীন্দ্রনাথ শরৎকে স্বল্পায়ু বলেছেন। শরৎকে চেনা যায় প্রকৃতির মাঝে তার স্বল্প আয়োজনের জন্য। শরতের সম্ভার ওই শিশিরাশ্রু শেফালিকা, কাশমেঘ; আর আগমনী উত্সবে তার সমাপ্তি। শরত্ হচ্ছে আকাশ ও মাটির মিলন। একদিকে নীলাকাশ, আরেকদিকে কচি ফসলের দুরন্তপনা; একদিকে সোনা রোদ, আরেকদিকে সবুজের কচি মুখ; সঙ্গে আকাশ ও মৃত্তিকার যে হূদয়াবেগ, তা আমাদের হূদয়কে নাড়া দিয়ে যায়। ভাদ্র মনকে উদ্বেলিত করে। প্রকৃতির সবুজ ছড়িয়ে পড়ে মাঠে-ঘাটে। এই স্নিগ্ধরূপ তারুণ্যকে উচ্ছ্বসিত আনন্দে ভাসতে উদ্বেল করে তোলে। প্রকৃতি তার ভালোবাসা দিয়ে আপন করে নিতে চায় সকল মনকে। শরত্ সেই ভালোবাসার মনে দোলা দিয়ে যায়। তাই বুঝি মহাকবি কালিদাস শরতের বন্দনা করেছেন: ‘প্রিয়তম আমার! ঐ চেয়ে দেখো, নববধূর ন্যায় সুসজ্জিত শরৎকাল সমাগত।’
১০.
কাশফুলের পাশাপাশি শরতের প্রিয় ফুল শিউলি বা শেফালিকেও কবিরা কাব্যে তুলে এনেছেন নানা ভাবরসে। বাংলা কাব্যে-উপন্যাসে শরতের শিউলির বিশেষ অবস্থান রয়েছে। শিউলি ছাড়া শরতের মাধুর্য সৌন্দর্য যেন অলংকৃত হয় না। শিউলিই যেন আবেদনময়ী করেছে কবির কবিতাকে। প্রেম-দ্রোহের কবি নজরুলকেও আলোড়িত করেছিল শরতের প্রকৃতি। বিশেষ করে শরতের শিউলি তাকে মুগ্ধ করেছিল। ‘এসো শারদ প্রাতের পথিক এসো শিউলি-বিছানো পথে।/ এসো ধুইয়া চরণ শিশিরে এসো অরুণ-কিরণ-রথে…।’ শিশির সিক্ত শেফালি ফুলের ঘন সৌরভে মাতি শারদ প্রভাতে সখিগণ সাথে আনিয়াছি মালা গাঁথি (কবি বেগম সুফিয়া কামাল), স্বচ্ছ হাসি শরৎ আসে পূর্ণিমা মালিকা সকল বন আকুল করে শুভ্র শেফালিকা (রবীন্দ্রনাথ), ম্লানমুখী শেফালিকা পড়িতেছে ঝরি, বিধবার হাসি সম স্নিগ্ধ গন্ধে ভরি। (নজরুল), কুমারীর ভীরু বেদনা বিধুর প্রণয় অশ্রুসম- ঝরিছে শিশির সিক্ত শেফালি নিশি ভোরে অনুপম। (নজরুল) এমন কত কথা কত শ্লোক শেফালিকে নিয়ে পড়া…. পাতায় পাতায় কী সুন্দর হয়ে ফুটেছে শেফালি কলি উঠিলে ফুটিয়া ঝরিয়া ঝরিয়া ভূমিতে পড়িবে ঢলি সকলে তখন পুলকিত মনে ফুল কুড়াইবে যতনে……। ক্ষীণ আয়ু নিয়েই ফুটে শেফালি। রাত না ফুরাতেই সে ঝরে। তার সাথে যেন কবির বিরহ বেদনা যুক্ত হয়ে গেছে। তোমারই অশ্রুজলে শিউলি তলে সিক্ত শরতে হিমানীর পরশ বুলাও ঘুম ভেঙে দাও দ্বার যদি রোধি।। শিউলিকে দুঃখের উপমা হিসেবেই ব্যবহার করেছেন নজরুল ।
১১.
ঋতু পরিক্রমায় ‘বুকের মধ্যে আগুন’ নিয়ে শ্রাবণ বিদায় নেয়। বর্ষার খেয়ালী প্রকৃতিও প্রসন্নতায় আর বসে থাকে না। ফলে ঋতুচক্র নানা বর্ণে-গন্ধের সমারোহে নিত্য আবর্তিত হয়ে চলে। কিন্তু ‘ইটের প’রে ইট, তার মাঝে মানুষ কীট’— এই শহরের বাসিন্দাদের অন্তর আজ আর শরতের নিমন্ত্রণ অনুভব করে না। প্রতিবারই শরৎ আসে। সাজে অপরূপ সাজে। কিন্তু শহুরে যান্ত্রিক জীবনে এর রূপ দেখার সময় কই? শরতের মন ভোলানো প্রকৃতিতে মন যে কী চায় তা বোঝা বড়ই মুশকিল! রোদ আর বৃষ্টির লুকোচুরি খেলায় মনেও যেন জমে মেঘ, আবার কখনো হয়ে ওঠে রৌদ্রকোজ্জ্বল। কিন্তু ব্যস্ত এ নগরীতে, শত ব্যস্ততার মাঝে আমরা পারি না মনের আকাঙ্ক্ষায় শরতের রঙে সাজাতে। তবুও মন আমার আমাকে নিয়ে হারিয়ে যায়, শরতের কাশফুল, গোধূলি, শিউলি আর জ্যোৎস্নার মাঝে। প্রিয়জনের হাত ধরে অনুভব করি স্নিগ্ধতা, মনে জেগে ওঠে বাণী ‘আজি শরতের আকাশে মেঘে মেঘে স্বপ্ন ভাসে’।
আবদুল্লাহ আল মোহন
১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৫ / ৯ অক্টোবর, ২০১৬