আবদুল্লাহ আল মোহন
১.
আবেদ খান, স্বনামধন্য সাংবাদিক, কলাম-লেখক, উপস্থাপক এবং একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। নিজ পরিচয়ের নানা গুণেই তিনি আজ দেশবরেণ্য ব্যক্তিত্ব, মনে রাখবার মতোন আলোকিত মানুষ। সম্প্রতি প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি) এর চেয়ারম্যান হয়েছেন খ্যাতিমান সাংবাদিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা, দৈনিক জাগরণ-এর সম্পাদক ও প্রকাশক আবেদ খান। উদার মানবতাবাদী, বিদগ্ধ সাংবাদিক, সমাজ বিশ্লেষক আবেদ খান ১৯৪৫ সালের ১৬ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন। প্রিয় আবেদ ভাইয়ের জন্মদিনে তাঁকে জানাই ফুলেল শুভেচ্ছা। শুভ জন্মদিন আবেদ ভাই। প্রথম জীবনে তিনি হতে চেয়েছিলেন কবি, লিখেছেন গল্পও, তবে আজীবন যাপন করেছেন সাংবাদিকতার জীবন। পারিবারিকভাবে আলোকিত উত্তরাধিকার বহন করছেন আবেদ খান। আমরা জানি, সাতক্ষীরার খাঁ পরিবার শুধু বাংলাদেশেই নয়, এই উপমহাদেশের শিক্ষিত ও সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে বিশেষভাবেই সুপরিচিত। এই সাতক্ষীরার রসুলপুর গ্রামেই আবেদ খানের জন্ম কিন্তু বেড়ে উঠেছেন ঢাকায়। অবিভক্ত ভারতের দৈনিক আজাদ-এর সম্পাদক মাওলানা আকরম খাঁ সম্পর্কে তাঁর নানা (মাতামহ) ছিলেন। তাঁর নানা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতাদের একজন কমরেড আবদুর রাজ্জাক খান, মেঝভাই মন্টু খানের নামও উল্লেখ করতেই হয়। আবেদ খানের পিতার নাম আব্দুল হাকিম খান এবং মায়ের নাম আজরা খানম। তাঁর স্ত্রী স্বনামধন্য অধ্যাপক, উপস্থাপক ড. সানজিদা আখতার এবং তাদের একমাত্র সন্তান ড. আসাদ করিম খান প্রিয়। আবেদ খান নানা সামাজিক আন্দোলনের সাথেও গভীরভাবে জড়িত ছিলেন, আছেনও। ‘সচেতন মানুষের ঘরে বসে থাকার কোন উপায় নেই’ বলেই বিশ্বাস করেন দৈনিক জাগরণের সম্পাদক ও প্রকাশক আবেদ খান।।ফলে তিনি আজো সক্রিয় বিভিন্ন ভুমিকায়।
২.
স্বপ্নবান মানুষ আবেদ খান বাংলাদেশের গণমাধ্যমের তথা সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার ভুবনে এক গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় নাম। আজকের ইলেকট্রনিক মিডিয়ার জনপ্রিয় ‘টক শো’ ধারণাটিরও প্রথম প্রচলন করেন তিনি। শুধু সাংবাদিকতা নয় সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও রয়েছে তার সফল পদচারণা। ১৯৮৪, ১৯৮৬ এবং ১৯৯১ সালে মোট তিনবার বিটিভির ঈদ আনন্দ মেলার উপস্থাপনা করেছেন আবেদ খান ও ড. সানজিদা আখতার। কিছু কিছু মানুষ আছেন যাঁরা স্বপ্ন দেখতে জানেন, স্বপ্ন দেখাতে জানেন। কিছু মানুষ নিজেদের স্বপ্ন সঞ্চারিত করতে পারেন অন্যদের ভেতর। আবেদ খান সেই বিরল প্রতিভার স্বাপ্নিক মানুষ, যাঁর চোখে স্বপ্ন দেখে আজকের তারুণ্য। আর আবেদ খান দেখেন এক সেক্যুলার ও সাম্যের বাংলাদেশের স্বপ্ন। মুক্তিযোদ্ধা আবেদ খানের সেই স্বপ্নযাত্রার সহযাত্রী আমরাও।কারণ অসম্ভব অসাম্প্রদায়িক, যুক্তিবাদি মানুষ আবেদ খান। নানা ভুমিকা পালনসহ এই বীর মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধকালীন ৮ নম্বর সেক্টরে সম্মুখ যুদ্ধও করেছেন। চেতনায় মুক্তিযুক্ত প্রবলভাবে উপস্থিত, মুক্তচিন্তারও ধারক-বাহক তিনি। তিনি আপাদমস্তক বাঙালি, জীবন যাপনে, মন-মননে, বাঙালিত্বের চিরায়ত মানবতাবাদি সংস্কৃতির সচেতন মানুষ আবেদ খান।মানুষের প্রতি দারুণ আস্থাবান যেমন, তেমনই অন্যের প্রতি আপন দায়িত্ব পালনে সদা জাগ্রতও মানুষ তিনি। তিনি স্বদেশকে ভালোবাসেন অকৃত্রিমভাবেই তবে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটকে ভুলে গিয়ে নয়। তরুণ সমাজের প্রতি বিশেষভাবে আস্থাশীল এই ‘চির তরুণ’ আবেদ খান সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশ ও ধারনের মাধ্যমেই আগামি দিনের বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী। ইতিবাচক মনোভাবের এই কলম সৈনিক বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসেন বলেই দেশে সুস্থ ও সুশিক্ষিত এবং মানবিক সমাজ গড়ে তুলতে ধর্মৃনিরপেক্ষ, ইহজাগতিক শিক্ষা সমৃদ্ধ সচেতন মানুষের সংখ্যাবৃদ্ধি ও সংঘবব্ধতার প্রয়োজনকে স্বীকার করেন। রাজনীতির বিশ্লেষক, সমাজ সচেতন লেখক হিসেবে মানব মনস্তত্বকে বুঝতে তিনি সদা সচেষ্ট এবং মানুষের আপন বোধের জাগরণের প্রতিও গভীর আস্থাবান।
৩.
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা এবং সভাপতি অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের একান্ত সহকারি হিসেবে কাজ করার সুবাদে আবেদ খানের সাথে আমার পরিচয় ঘটে এবং ঘনিষ্ঠতা বাড়ে।তিনি হয়ে ওঠেন আমার আবেদ ভাই। আবার আমার সাংবাদিকতারও গুরু হয়ে ওঠেন তিনি।জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগে ভর্তি হয়ে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের কাজের প্রকৃতি বা ধরণের সাথে সময় মেলাতে পারছিলাম না বলে বিকল্প কিছু কাজ করার সুযোগ খুঁজছিলাম। ঠিক সে সময়ই পাশে পেলাম কিংবা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলেন আবেদ ভাই। তিনি তখন জনপ্রিয় দৈনিক ইত্তেফাকের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর কথামতো বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ শুরু করলাম কিন্তু তৎকালিন বার্তা সম্পাদকের বিশেষ পক্ষপাতের কারণে আরেকজনকে নিয়োগ দেওয়া হলো। আবেদ ভাই তখন আমাকে সে সময়কার সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সর্বাধিক প্রচারিত জাতীয় দৈনিক ভোরের কাগজে আমাকে কাজ করার ব্যবস্থা করে দিলেন। আর সে সময় যিনি ভোরের কাগজের জা.বি প্রতিনিধি ছিলেন সেই ইউরেকা ভাইও আমাকে অসম্ভব সহযোগিতা করলেন। ফলে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় জীবনই, প্রায় ৬ বছর দৈনিক ভোরের কাগজের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিসহ প্রতিবেদক, সহসম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সুযোগ পাই। তাই আমার সাংবাদিকতা জীবনের সাথে গভীরভাবে যে নামটি জড়িত হয়ে আছেন, তিনিই আবেদ খান।
৪.
নিবিড় পাঠক এবং প্রবল আড্ডাবাজ আবেদ খান যেমন যুক্তিবাদি, তেমনই ভীষণ মানবিক মানুষও। তাঁর মানবিকতার দিকটি আমাকে সবসময় আলোড়িত করতো।নানা সময়ে তার প্রমাণও পেয়েছি। একটি ঘটনার কথা না বললেই নয়।আমি লেখাপড়া, সাংবাদিকতার পাশাপাশি বিশ্ববরেণ্য জাদুশিল্পী জুয়েল আইচের জাদুদলের সাথেও কা্জ করতাম।ফলে বিভিন্ন সময়ে জাদু প্রদর্শনীতে অংশ নিতে দেশে-বিদেশে যেতে হতো। তেমনই এক শোতে অংশ নিতে ১৯৯৪ সালে চুয়াডাঙ্গা গেলে মুজিবনগর পরিদর্শনের লোভ আমরা সামলাতে পারি না। যাবার পথে ঐতিহাসিক আমঝুপিতেও যাই আমরা। সেখানেই হামিদ ভাই ( কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক) এবং কাজি হাফিজের (বর্তমানে দৈনিক কালের কণ্ঠের স্বনামধন্য সাংবাদিক) কাছে আমরা জানতে পারি স্বাতী বোস নামের এক মহিলার শিশু সন্তানসহ জেলখানার আটক অমানবিক জীবনের কথা। পরে ঢাকায় ফিরে বিষয়টি জুয়েল ভাইয়া (জুয়েল আইচ) আবেদ ভাইয়ের নজরে আনলে তিনি আমাকে পাঠালেন মেহেরপুর কারাগারে।আমি জেলখানায় গিয়ে দেখা করে, কথা বলে সকল তথ্য এনে আবেদ ভাইকে দেই। এর আগেই অবশ্য জুয়েল ভাইয়া প্রয়াত আইনজীবী সুধাংশুখের হালদারের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় সহযোগিতার জন্য করণীয় শুরু করে দেন। আমার প্রদত্ত অনুসন্ধানের তথ্যাদি দিয়ে আবেদ ভাই দৈনিক জনকণ্ঠের প্রথম পাতায় লিড নিউজ হিসেবে প্রকাশ করলেন। সারাদেশে সারা পড়ে গেলো।উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেলেন স্বাতী বোস। এভাবেই প্রতিষ্ঠিত হলো অসহায় শিশু ও নারীর মানবিক অধিকার। এ রকম আরো কিছু ঘটনার সাক্ষী আমি। আবেদ ভাইয়ের প্রবল মানবিক বোধের কারণেই মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অনেকবার।
৫.
আজ মনে পড়ছে নানা স্মৃতি, সেটা কখনো কেন্দ্রের, কখনোবা আবেদ ভাইয়ের কলাবাগানের (বসিরউদ্দিন রোড) বাসার আবার কখনো বা জুয়েল আইচের কলাবাগানের বাসার। স্মরণে আসছে ২০১২ সালের ২৩ নভেম্বর সেগুনবাগিচার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে আবেদ খানের ‘সাংবাদিকতায় ৫০ বছর’ পুর্তির আনন্দ আয়োজনের দিনটি। তাঁর প্রিয়জনেরা সেদিন সেখানে হাজির হয়েছিলেন, ফুলেল শুভেচ্ছায় সিক্ত হয়েছিলেন আবেদ ভাই। এখনো কখনো দেখা হলে স্নেহভরে কাছে টানেন, কখনোই ভালোবাসার কমতি আছে বলে মনে হয় না।তাঁর মতোন সানজিদা ভাবিও সমান স্নেহ করেন আমাকে। একবার আবেদ ভাই চোখের অসুখের চিকিৎসা নিতে দিল্লি গেছেন, ঠিক সেই সময়ে আমরা সাংস্কৃতিক দলের প্রতিনিধি হয়ে জাদু দেখাতে ভারতের রাজধানীতেই অবস্থান করছিলাম। তিনি এবং ভাবি এলেন, শো শেষে সেখানেও জম্পেশ আড্ডা হয়ে গেলো এক পশলা। এমনই প্রাণের মানুষ, প্রিয় মানুষ আমার আবেদ ভাই। ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের কেবিনে শুয়েও তাঁর সজীবতার অফুরন্ত প্রাণশক্তি আমাকে সবসময় আশাবাদের ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা জোগায়।
৬.
আমরা জানি, সমাজে কিছু কিছু মানুষ থাকেন, যাঁরা সারা জীবন সামাজিকভাবে দায়বদ্ধ। তাঁদের এই দায়বদ্ধতা তাঁদের জীবনাচারকে যেন এক ব্রত সাধনায় পরিণত করে। কোন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে না থেকেও তাঁরা প্রতিষ্ঠান। তাঁদের দৈহিক উচ্চতা ছাড়িয়ে যায় মানবিক উচ্চতা। সমাজের প্রতি, দেশের প্রতি ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই ক্যলাণমন্ত্রে দীক্ষা তাঁদের। এসব মানুষের চিন্তা ও চেতনার জগৎজুড়ে কেবলই মানুষের কল্যাণের চিন্তা। মানব কল্যাণের বাইরে কোন চিন্তা কখনও তাঁদের স্পর্শ করে না। সস্তা বাণিজ্যিক জনপ্রিয়তা নয়, সমষ্টির মঙ্গলচিন্তায় যিনি নিজেকে নিমজ্জিত রাখতে পারেন, তিনি আবেদ খান। আমার ও অনেকেরই প্রিয় আবেদ খান। সাংবাদিক-এই পরিচয়টিই যথেষ্ট তাঁর জন্য। সৃজনশীল, সৃষ্টিশীল তথা আলোকিত মানুষ আবেদ খানের নিরন্তর সুস্থ ও সুন্দর আগামি দিনের প্রত্যাশা করি।
৭.
আবেদ খানের স্বনামখ্যাত ‘আবেদ খান’ হয়ে ওঠার পেছনের, অন্তরালের কিছু কথা জানা জরুরি।নানা আলাপনে তিনি তাঁর জীবনে বন্ধু লেখক, অনুবাদক শেখ আবদুর রহমান এবং ‘বিচিত্রা’খ্যাত সম্পাদক, বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহাদত চৌধুরীর ইতিবাচক ভুমিকার কথাও বলে থাকেন। জগন্নাথ কলেজে তাঁর জীবনে শিক্ষক অধ্যাপক অজিতকুমার গুহ’র কথা কৃতজ্ঞতার সাথে স্বীকার করেন। অপরদিকে, তাঁর মায়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু কবি বেগম সুফিয়া কামাল এবং তাঁর স্বামী কামালউদ্দীন খানের প্রভাবও কম নন বলেই জানিয়েছেন। সৃজনী লেখক ও শিল্পী গোষ্ঠীর সাথে জড়িয়ে পড়ে সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি প্রীতি বাড়ে।সৈয়দ হাসান ইমাম, খান আতা, রওশন জামিলদের মতোন আরো অনেক সাংস্কৃতিক সাধকদের সংষ্পর্শে এসে মানসিক সমৃদ্ধি ঘটে। প্রখ্যাত লেখক, সাহিত্যিক রণেশ দাশগুপ্ত, সত্যেন সেন, তোয়াব খানদের নিবিড় সান্নিধ্য, প্রেরণা তাঁর শিল্প চেতনা সৃষ্টিতে ও বৃদ্ধিতে সহায়ক ভুমিকা পালন করে। আবার পারিবারিকভাবেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের ঘনিষ্ঠ ছিলেন বলেই নানা সময়ে যেমন সমৃদ্ধ হয়েছেন, তেমনি দেশের জন্য নিরবে কাজও করেছেন। ফলে রাজনীতির নানা ঘটনা প্রবাহ দেখেছেন, নিবিড় ঘনিষ্ঠতাও ছিলো সবসময়। শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেনের নামও কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করে থাকেন তিনি। দৈনিক ইত্তেফাকের স্মৃতির সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে অতি আপনজন শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেন। হাতে-কলমে শিখেছেন, জেনেছেন সাংবাদিকতার অনেককিছুই। অভিজ্ঞতাজাত সেই সব টিপস, পরামর্শ, অনুপ্রেরণা আজো আলোকিত স্মৃতি হিসেবে শ্রদ্ধার সাথে স্বীকার করে থাকেন আবেদ খান।
৮.
এবার আবেদ খানের জীবন ও কর্মের দিকে একটু নজর দেওয়া যাক। মাত্র ১৭ বছর বয়সে ১৯৬২ সালে আবেদ খানের সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি ঘটে দৈনিক ‘জেহাদ’-এ। ১৯৬৩ সালে তিনি দৈনিক ‘সংবাদ’-এ যোগদান করেন। পরের বছরই দৈনিক ইত্তেফাকে যোগ দেওয়ার মাধ্যমে তিনি শুরু করেন এক দীর্ঘ কর্মসাধনাময় অধ্যায়। এই পত্রিকায় আবেদ খান পর্যায়ক্রমে শিফট-ইনচার্জ, প্রধান প্রতিবেদক, সহকারী সম্পাদক ও কলামিস্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৯ সাল থেকে তিনি দৈনিক কালের কণ্ঠের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১১ সালের ৩০ জুন দৈনিক কালের কণ্ঠ থেকে পদত্যাগের পর তিনি ২০১২ সালের জুন মাসে এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী কর্মকতা ও প্রধান সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেন। ২০১৩ সালের এপ্রিলে তিনি এটিএন নিউজ থেকে পদত্যাগ করেন। বর্তমানে তিনি দৈনিক ‘জাগরণ’ নামের প্রকাশিতব্য একটি সংবাদপত্রের সম্পাদক ও প্রকাশক। কলকাতার বহুল জনপ্রিয় দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকাতেও নিয়মিত লিখেছেন তিনি, বাংলাদেশের প্রতিনিধিও ছিলেন।
৯.
আবেদ খান শুধু সাংবাদিকই নন আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালের পয়লা মার্চ তিনি পুরনো ঢাকার নারিন্দা-ওয়ারী অঞ্চলে স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদ কমিটির কনভেনর হিসেবে নিজেদের মাঝে স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রস্তুতি-পর্বের দৃঢ় সূচনা করেন। ২৫ মার্চের কাল-রাতে ট্যাংকার নিয়ে পাকিস্তানি-হানাদার বাহিনী ইত্তেফাক ভবনে আগুন জ্বালিয়ে সর্বতোভাবে ধ্বংসের তাণ্ডবলীলায় মেতে উঠেছিল। ২৯ মার্চ তিনি ঢাকা ত্যাগ করেন। জুন মাসে সংবাদ, ডেইলি পিপল, ইত্তেফাক ভবন এবং সারা ঢাকার ওপর বয়ে চলা বিশ্ব-ইতিহাসের এই অতি-ভয়াল ধ্বংসলীলার চাক্ষুষ সাক্ষী হিসেবে প্রথম তিনি কলকাতার আকাশবাণী বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেন। এরই মাঝে তিনি ৮ নম্বর সেক্টরে তাঁর নাম অন্তর্ভুক্ত করান। মেজর ওসমান তখন সেক্টর আটের ভারপ্রাপ্ত দায়িত্বে ছিলেন। পরবর্তী সময়ে মেজর মঞ্জুর এ সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আবেদ খানের সাব-সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন সফিকউল্লাহ। এ ছাড়াও জুন মাসে ১২ টি বাম দলের সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় পরিষদ-এর পশ্চিমাঞ্চলের অন্যতম আহ্বায়ক ছিলেন আবেদ খান। সাতক্ষীরা মুক্তকরণে তাঁর ভুমিকাও ছিলো উল্লেখযাগ্য।
১০.
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের আগস্টে ইত্তেফাকে তাঁর ধারাবাহিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ‘ওপেন সিক্রেট’ প্রকাশিত হতে থাকে। তৎকালীন সরকারের যেকোনো কর্মকাণ্ড বা ভূমিকার ওপর এ সংক্রান্ত সিরিজ যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে। ‘ওপেন সিক্রেট’কে বলা যেতে পারে বাংলাদেশের তদন্তমূলক সাংবাদিকতার এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এ সংক্রান্ত পড়াশোনায় ‘রেফারেন্স’ হিসেবে ‘ওপেন সিক্রেট’-এর বিশেষ খ্যাতি রয়েছে। এরপর সম্পাদকীয় বিভাগে সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের সময় তিনি অভাজন ছদ্মনামে ‘নিবেদন ইতি’ শিরোনামে কলাম লেখায় হাত দেন। এই ‘নিবেদন ইতি’ও সে সময় অভাবিত জনপ্রিয়তা পায়।
১১.
১৯৯৫ সালে আবেদ খান ইত্তেফাক থেকে অব্যাহতি নেন। ইত্তেফাক থেকে অব্যাহতি নিয়ে কলামিস্ট হিসেবে সমসাময়িক সময়ে দেশের শীর্ষ দৈনিক জনকণ্ঠ, ভোরের কাগজ ও সংবাদ পত্রিকায় লিখতে থাকেন। ১৯৯৫ সাল থেকে জনকণ্ঠে সম্পাদকীয় পাতায় তাঁর ‘অভাজনের নিবেদন’ প্রকাশের পাশাপাশি প্রথম পাতায় ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ শিরোনামের মন্তব্য প্রতিবেদন প্রকাশ হতে থাকে। ‘গৌড়ানন্দ কবি ভনে শুনে পুণ্যবান’ কলামটি জনকণ্ঠে প্রকাশিত তাঁর স্যাটায়ারধর্মী পাঠকপ্রিয় কলাম। দৈনিক ভোরের কাগজের প্রথম পাতায় তাঁর ‘টক অব দ্য টাউন’ শিরোনামের মন্তব্য প্রতিবেদনটি সে সময় তুমুল জনপ্রিয়তায় দেশবাসীর কাছে হয়ে উঠেছিল যেন ‘টক অব দ্যা কান্ট্রি’। একই কাগজে এ সময় তাঁর উপসম্পাদকীয় কলাম ‘প্রাঙ্গণে বহিরাঙ্গনে’ প্রকাশ হতে থাকে। দৈনিক সংবাদে তিনি ‘তৃতীয় নয়ন’ নামে একটি অন্তর্দৃষ্টি-বিশ্লেষণাত্মক কলাম ধারাবাহিকভাবে লিখতে থাকেন। এ সময় ভারতের জনপ্রিয় বাংলা দৈনিক ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র প্রবাসী সংস্করণ ‘প্রবাসী আনন্দবাজার’-এও নিয়মিতভাবে তাঁর লেখা প্রকাশ হতে থাকে। প্রতিষ্ঠান ছেড়ে এ সময় আবেদ খান নিজেই ক্রমশ একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়ে উঠতে থাকেন। ১৯৯৮ সালে নতুন দৈনিক প্রথম আলোতে ‘কালের কণ্ঠ’ শিরোনামে তাঁর উপসম্পাদকীয় কলাম প্রকাশ শুরু হয়। পরে ২০০৯ সালে আবেদ খানের নেতৃত্বে কালের কণ্ঠ নামের একটি দৈনিক পত্রিকা বাজারে আসে।
১২.
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ বেতারে একটি স্যাটায়ারধর্মী টক-শো’র পাণ্ডুলিপি লিখতেন তিনি। তাঁর সেই হিউমার-সমৃদ্ধ টক-শো শ্রোতাদের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলে। প্রিন্ট মিডিয়ার পাশাপাশি আবেদ খান এ সময় থেকে ইলেকট্রনিক-মিডিয়ায় জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে প্রবেশ করেন ১৯৭৮ সালে। আতিকুল হক চৌধুরীর ‘শেষ সংলাপ’ নাটকেও অভিনয় করেছেন। আবেদ খান ও ড. সানজিদা আখতার দম্পতির গ্রন্থনা-উপস্থাপনায় দম্পতি-বিষয়ক ধারাবাহিক ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘তুমি আর আমি’ প্রথম থেকেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। উল্লেখ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে আবৃত্তি সংসদে প্রশিক্ষণ দিতে গিয়ে যোগাযোগ স্থাপিত হয় সানজিদা আখতারের সাথে, জড়িয়ে পড়েন প্রেমে।পারিবারিক বাঁধা পেড়িয়ে গাঁটছাড়া বাঁধেন, ১৯৭৭ সালের ১০ জুলাই তারা বিয়ে করেন।
১৩.
দম্পতি-শিল্পীদের নিয়ে সঙ্গীত বিষয়ক ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘একই বৃন্তে’ সঞ্চালনার দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৮৪, ১৯৮৬ ও ১৯৯০ সালে আবেদ খান-সানজিদা আখতার দম্পতি ঈদের ‘আনন্দমেলা’ অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা ও গ্রন্থনা করেন। যেসব গুণী মানুষের সংস্পর্শে ‘আনন্দমেলা’ ঈদ অনুষ্ঠানটি জনপ্রিয়তার চূড়া স্পর্শ করেছে তাঁদের মধ্যে এই দম্পতি অন্যতম। এ সময় থেকে টেলিভিশনের অসংখ্য টক-শো সঞ্চালনার মাধ্যমে তাঁরা জনপ্রিয় টেলিভিশন-ব্যক্তিত্বে পরিণত হন, যা এখনও সমানভাবে প্রবহমান। কিছুকাল রেডিও-টেলিভিশন শিল্পী সংসদের প্রেসিডেন্টেরও দায়িত্ব পালন করেন আবেদ খান।
১৪.
১৯৯৯ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তিনি একুশে টেলিভিশনের সংবাদ ও চলতি তথ্য বিষয়ের প্রধান হিসেবে কাজ করেন। একুশে টেলিভিশনের জন্মলগ্ন থেকেই এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন এবং প্রথম আন্তর্জাতিকমানের সংবাদ উপস্থাপনার উদাহরণ হিসেবে একুশে টেলিভিশনকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। টেরেস্ট্র্রিয়াল ও স্যাটেলাইট টেলিভিশন মিডিয়ায় আধুনিক সাংবাদিকতা এ দেশে তাঁর হাত ধরেই স্পর্শ করেছে জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতার বিরল শিখর। এর আগে ১৯৯৬-৯৯ সালে তাঁর অনুসন্ধানমূলক টেলিভিশন রিপোর্টিং সিরিজ ‘ঘটনার আড়ালে’ টেলিভিশন-সাংবাদিকতার আরেকটি জনপ্রিয় অনুষ্ঠান।
১৫.
অনেকগুলো গ্রন্থের প্রণেতা আবেদ খান। তাঁর প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে: অভাজনের নিবেদন, গৌড়ানন্দ কবি ভনে শুনে পুণ্যবান, কালের কণ্ঠ, প্রসঙ্গ রাজনীতি, হারানো হিয়ার নিকুঞ্জপথে (গল্প সংকলন), আনলো বয়ে কোন্ বারতা, বলেই যাবো মনের কথা, গৌড়ানন্দ সমগ্র, অনেক কথা বলার আছে, দেশ কি জঙ্গিবাদের অভয়ারণ্য হবে, ও রাজকন্যে তোমার জন্য, স্বপ্ন এলো সোনার দেশে, আমাদের টুকুনবাবু ইত্যাদি।
১৬.
আবারো প্রিয়ভাষী, স্বজন আবেদ ভাইয়ের সুস্থ ও সুন্দর এবং কর্মময় আগামির যেমন প্রত্যাশা করি, সেই সাথে কামনা করি তাঁর দিনগুলোও কাটুক সবান্ধবে জীবনানন্দময় ।
(তথ্যসূত্র : ইন্টারনেট )
আবদুল্লাহ আল মোহন
১৬ এপ্রিল, ২০১৬ / ১৬ এপ্রিল, ২০১৭/ ১৬ এপ্রিল, ২০১৮/ ১৬ এপ্রিল, ২০১৯/ ১৬ এপ্রিল, ২০২০