Saturday, মে ১৮, ২০২৪
শিরোনাম

রাষ্ট্র চিন্তা : বোধের সন্ন্যাসী

শেয়ার করতে এখানে চাপ দিন

রেজাউল করিম শেখ

এক. আমাদের সমস্যাগুলো নিয়ে আমরা মুখ খুলে কথা বলতে পারি না। আলোচনা করতে পারি না। নিজেদের জন্য নিজেদের উন্নতির জন্য যে আত্ম-সমালোচনা দরকার ছিলো, তা একেবারেই অনুপস্থিত বলতে পারি। ফলে আমরা বিশৃঙ্খল দো-পায়া বিশেষ প্রাণিই কেবল। অথচ প্রকৃত প্রস্তাবে একটা জাতির বিকাশের জন্য এর কি কোনো উত্তম বিকল্প আছে? আদতে নাই। স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও বাস্তবিক অর্থে একটা রাষট্রযন্ত্রের শাখাকেও পরিচ্ছন্ন ও মানুষোপযোগী করতে পারিনি। পুরো একটা রাক্ষস রাষ্ট্র ব্যবস্থায় পেট মোটা, মাথা ছোটো অক্ষম পৌরুষের কুরুচিপূর্ণ জীবন-কাঠামো গড়ে নিয়ে যাপন করছি দিন। এখানে মূল্যবান কেবল অর্থ আর ভোগ। কী ডাক্তার, কী ইঞ্জিনিয়ার, কী সাংবাদিক, কী পুলিশ, কী কবি- সবাই যে যার সুযোগ মতো চাটুকারিতা, ভোগ-লিপ্সা আর পরশ্রীকাতরতায় মেতে আছি। আর যদিও কদাচিৎ বা দৈবাৎ দু-একজন বিচক্ষণ সৃজনশীল মানুষ কাজ করতে থাকেন-তাকে কেবল সকলে মিলে খোঁচানোর পাঁয়তারা করি। এখানে একজন সাংবাদিক একজন ডাক্তারের অনিয়মের বিরুদ্ধে বলতে পারবে না। তাদের কটু-আচরণ, ধান্দাবাজি নিয়ে লিখতে পারবে না। লিখলেই তাকে চিকিৎসালয়গুলোতে অবাঞ্চিত ঘোষণা করবে। একজন রাজনীতিক একজন সাংবাদিকের নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে পারবে না। করলেও তার চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করা হবে। একজন শিক্ষককে নিয়ে কথা বলা এখানে পাপ নয়- মহাপাপ। শিক্ষকের ঘুষ খাওয়া নিয়ে বলা যাবে না, অযোগ্যতা নিয়ে বলা যাবে না, ফাঁকিবাজি নিয়ে বলা যাবে না। পূত-পবিত্রের জজবা নিয়ে যে এদের অনেকে পূতি-গন্ধময় হয়ে আছে সে কথা বললে কথক পরিত্যাজ্য বিবেচিত হবে। কোনো রকম কয়েকটা আরবি কেতাব একবার কষ্টেসৃষ্টে পড়তে পারলে সে তো কথার বাইরেই চলে যান! এই রকম করে ধরে ধরে আমরা স্বার্থ-সিদ্ধির জন্য একে যেমন অপরের বিরুদ্ধে তেমনি একেকটা গোষ্ঠি অপর গোষ্ঠির বিরুদ্ধে সংহত অবস্থায় আছি। এখন তো আরেক স্বর্গীয় বিভক্তি আমরা পেয়ে গেছি- বিএনপি বনাম আওয়ামীলীগ। সন্তানাদির বিয়ের বেলাতেও এখন খোঁজা হয়- কে কোন দল করে। সরকারি চাকুরীতে যেমন আওয়ামী পরিবারের সন্তান বলে সনদপত্র নিতে হয়, তেমনি হয়তো বিয়ের বেলাতেও নিতে হবে খুব শীঘ্রই। দলীয় কমরেডদের আরেকটু কদর বাড়বে বৈকি! যদি আমরা এইসব কথা না বলে থাকতে পারতাম তবে কতই না ভালো হতো। কিন্তু না বলে পারা যায় না। কারণ যাপিত জীবনের ঘোর অন্ধকার ভাবিয়ে তোলে- আর কত দূর, আর কত দিন? আমাদের ঘটে ও ঘাটে যা কিছু আছে তা তো প্রায় উজার হবার পালা। তা প্রকৃত খবর হয়তো আরো খারাপ- সব ফুরিয়ে গেছে। উন্নয়নের পোয়াতি মেয়ে যে পেট উঁচু করে ঘুরে বেড়াচ্ছিলো- করোনা তো অকালে প্রসব করিয়ে দিলো। এখন আমাদের কর্মকর্তাদের বেতন-বোনাস দেওয়া দুষ্কর। প্রণোদনার অর্থ গেলাও প্রায় শেষ। রিজার্ভ ভাঙতে হবে মায়ের জমানো অলঙ্কারের মতো করে। ব্যবসা-বাণিজ্যে হাহাকার পড়লেও কলরব শোনা যাচ্ছে না তেমন। কারণ রবের অধিকার কেবল হাওয়া নিয়ন্ত্রিত ঘরে। সেখানে কথা বলে ক্রেতা ও কেতা দুই-ই বাড়ে। তথাপি বাস্তবতা বুঝছে না, এমন নয়। নৈরাজ্য আর গোলামী চিন্তার বাইরে বেরুতে না পারা আমাদের বিসিএস কেন্দ্রিক বিবিগুলো যা দেয়- তা তো কার্যকর কর্মসংস্থানের এক রকম অন্তরায়। যারা জনগণের দফতরে কাজ করতে যান- তাদের থেকে এ কথা আর কে ভালো জানে! ফলে একদিকে যেমন মওকা না মেলার হতাশা আছে- তেমনি আছে বেকার তৈরীর যন্ত্রণা। এই বেকারত্ব মূলত শিক্ষায়তনগুলোরই তৈরী করা। কারণ এরা শিক্ষা দেওয়ার চাইতে- চাকরির লোভ দেখাতে বেশি পারঙ্গম। ইতোমধ্যে আমাদের বাজার ব্যবস্থাপনা উলোট-পালট হয়ে গেছে। আমাদের কর্মসংস্থান সংকুচিত হয়েছে। শিক্ষায় জট লেগেছে। উৎপাদনে কার্যত কোনো ভারসাম্য আছে কি না বোঝা কঠিন। সব মিলিয়ে আগামিতে একটি বৃহৎ সংখ্যক মানুষ আর্থিক দেউলিয়ার শিকার হবে। সেই সাথে বাড়বে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ঝরে পড়ার হার। ইতোমধ্যে ইস্কুলগামী মেয়ে-শিশুদের একটা বড় অংশ বিয়ের পিঁড়িতে বসে পড়েছে। নিজ নিজ গ্রামে খোঁজ নিলেই সেটা পরিষ্কার বোঝা যাবে। আর্থিক অনটনের যেমন তারা শিকার তেমনি অসচেতনতাও রয়েছে। আবার নিরাপত্তার প্রশ্ন তো তর্কাতিত বিষয়। কে না জানে বর্ষা মানে গ্রামীণ জীবনে নিপীড়নের আরেক নাম! এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধসহ করোনার ঘরবন্দি দিনে সে ভাবনা আরও প্রকট। ইতোপূর্বে আমাদের ভালো-মন্দ মিলিয়ে টিকে থাকা থুত্থুরে বুড়ির মতো জীর্ণ সমাজ কাঠামোও ভেঙে চূরমার হয়েছে- এর জায়গায় যে শক্তিশালী সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বসার কথা, সেগুলোর তো কোমরই নাই। ফলে দুর্বিপাকে পড়ে আছি ইতোমধ্যে। যে আশার স্বপ্ন এক কালে এদেশে শিক্ষিত-পণ্ডিতগণ দেখাতেন, তাদের নিজেদের অবস্থাই দেখছি এখন তথবৈচ! ক্ষমতার লোভী মঞ্চে এখন তো সত্যিকার গণমানুষের, গণজোয়ারের, ঘরে ঘরে হেঁটে যাবার মতো রাজনৈতিক নেতাও নেই। তাল কুড়ানোতে তিলের ব্যাপারীরা খুব ব্যস্ত। তবে কি একেবারেই শেষ! ঠিক তা নয়। স্বপ্নভঙ্গের কালে একরাশ বিশুদ্ধ স্নিগ্ধ অনুভূতির মতো কিছু বিদগ্ধ মানুষ এখনো আমাদের নিয়ে ভাবছেন- আলো জ্বালাবার চেষ্টা করছেন। সৌভাগ্যক্রমে যদি আমরা তাদের সাক্ষাত পাই তবে যেন চিনতে পারি। আর গ্রহণ না হোক বর্জনের বর্বরতা যেন তাদের উপর নেমে না আসে। তবে হয়তো ধ্বংসের সব রকম রেকর্ড ভেঙে তলিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো পথ পাবো না। এই সমস্ত কথার বা আপনাদের সকল সমালোচনা ও আলোচনার সারকথা হোক জীবনকে বোঝার ও জানার। জীবনকে সুন্দরভাবে যাপন করার কৌশল রপ্ত করে আমরা এগিয়ে যাই- একটি সুন্দর সমাজের দিকে। দুই. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং যুদ্ধোত্তর স্নায়ুযুদ্ধের অব্যবহিত পরে প্রযুক্তির মহাবিপ্লবের কালে সবচেয়ে শক্তিশালী ও কার্যকর অস্ত্র এই তথ্য। পুঁজিপতি ও শাসক-শোষক শ্রেণি সর্বতোভাবে এই তথ্যকেই হাতিয়ার করছে নিয়ন্ত্রণ বিধি জারি রাখতে। আবার প্রকৃত ও জনগণমন উদ্বেলের তথ্যকেও তারা বন্দিশালার অন্তঃপুরে আটকে ফেলতে চাইছে। একাজ করতে তারা বিভিন্ন সময়ে লোহার হাতকড়া পরিয়েছে ও গরাদের ক্ষিণ আলোর প্রকোষ্ঠে নিক্ষেপ করেছে গণমানুষের আস্থা অর্জনকারী তথ্য বীরদের। এই তালিকায় সংবাদকর্মীদের প্রথম লাইন থাকার কথা। কিছুটা হয়েছেও। সবচেয়ে বেশি ঘটেছে উঠতি বয়েসী তরুণ-তরুনীদের। বিভিন্ন দাবি-দাওয়া করতে গিয়ে তারা অবর্ণনীয় নিগ্রহের শিকার হয়েছে। রাজনৈতিক দৃষ্টিতে প্রকৃত প্রস্তাবে কার্যকর কোনো শোষণ-বিরোধী, নিপীড়কের ভীতি সৃষ্টি করতে পারে এমন দল বা দলীয় কর্মসূচি না থাকলেও একান্ত দলীয় কর্মসূচি বাস্তবায়ন বা মত প্রকাশ করতে গিয়েও নিগ্রহের শিকার হতে হয়েছে অনেককে। নৈরাজ্যকারীদের জন্য আশার ঘটনা হলো- যুগে যুগে প্রতিহতের সংগ্রামে শিল্পবোধ সম্পন্ন মানুষের যে ঐক্য গড়ে ওঠে, তাঁদের কণ্ঠ যে পরিমান উচ্চকিত হয় বা হওয়া দরকার, তেমনটি এখনো হয়নি। এখনো উল্লেখযোগ্য কোনো লেখক কিংবা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হাত মুষ্টিবদ্ধ করেননি। তথাপি করোনার মেকি ঘরবন্দি দিন নানা প্রসঙ্গ আলোচনার সুযোগ করে দিয়েছে। সুযোগ করে দেওয়ার কথা বলছি, একারণে যে মানুষ তথ্যের অবাধ প্রচারে কিছুটা বেপরোয়া হয়েছে। তারা অনেকটা রক্তচক্ষু উপেক্ষা করা শিখেছে। অসাধারণ মানুষগুলো ভয়ে নতমস্তক হলেও, সাধারণ মানুষগুলো ভীতির মুণ্ডুপাত করেছে। তারা তথ্য ছড়িয়ে দিচ্ছে দুর্দান্ত গতিতে। দূর্নিবার সেসব কথা মুহূর্তে ছড়িয়ে যাচ্ছে চতুর্দিক। এইখানে কিছুটা বিপত্তি আছে জেনে না জেনে বা বুঝে না বুঝে বা ইচ্ছাকৃত বিকৃত তথ্যের উপস্থাপনের। এ বিষয়ে সতর্ক ও সচেতন থাকা বাঞ্ছনীয়। ২৩ জুলাই ২০২০ খ্রিষ্টাব্দ। নপম

শেয়ার করতে এখানে চাপ দিন

সর্বশেষ খবর