Saturday, মে ১৮, ২০২৪
শিরোনাম

প্রণব মুখোপাধ্যায় : মহাপ্রয়াণে বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি

শেয়ার করতে এখানে চাপ দিন

আবদুল্লাহ আল মোহন
১.
ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি, উপমহাদেশের বরেণ্য রাজনীতিক, বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু প্রণব মুখোপাধ্যায় আর নেই। দিল্লির আর্মি হসপিটাল রিসার্চ অ্যান্ড রেফারালেই আজ ৩১ আগস্ট শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন স্বাধীনতা উত্তর সর্বভারতীয় রাজনীতির সফলতম বাঙালি প্রণব মুখোপাধ্যায়। তাঁর বয়স হয়েছিল প্রায় ৮৫ বছর। ভারতের সাবেক এই রাষ্ট্রপতি দিল্লির ক্যান্টনমেন্টের এক হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। গত ১০ আগস্ট থেকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। তাঁর মহাপ্রয়াণে বিনম্র শ্রদ্ধায় তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি এবং তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাই। ভারতের প্রবীণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় উপমহাদেশের রাজনীতিতে মেধা, বুদ্ধি, কুশলতা, প্রজ্ঞা, কূটনৈতিক দক্ষতা-যোগ্যতার কারণে জীবিত ‘চাণক্য’ হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। প্রণব মুখোপাধ্যায় ১৯৩৫ সালের ১১ ডিসেম্বর পশ্চিমবঙ্গে জন্মগ্রহণ করেন। ভারতের প্রথম বাঙালি আর ত্রয়োদশ রাষ্ট্রপতি (জুলাই ২০১২-২২ জুলাই ২০১৭) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন শ্রীযুক্ত প্রণব মুখোপাধ্যায়। দীর্ঘদিন কংগ্রেসের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী পদে থাকার পরে ২০১২ সালে তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। ২০১৯ সালে তাকে ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান – ‘ভারতরত্ন’ দেওয়া হয়। শিক্ষাগত যোগ্যতায় ছিলেন ইতিহাস ও পলিটিক্যাল সায়েন্সে ডবল এম.এ, পেয়েছেন সান্মাণিক ডি-লিট। সরকারি দফতরের কেরানি হিসাবে পেশাদার জীবন শুরু করেন। ছিলেন শিক্ষকও। ইন্দিরা গান্ধী কার্যত তাঁর রাজনৈতিক গুরু। কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী হিসেবে নানা গুরুদায়িত্ব পালন করে, বিভিন্ন সংকটকালে ধীশক্তি প্রয়োগ করে জটিলতা উত্তোরণে সাফল্যের কারণে তিনি ভারতে ‘চাণক্য’ নামে পরিচিতি লাভের পাশাপাশি মনস্বী রাজনৈতিক নেতৃত্বের আসন দখল করে ছিলেন। ১৯৭৩ সালে ইন্দিরা গাঁধীর মন্ত্রিসভার শিল্প প্রতিমন্ত্রী হিসাবে তাঁর পথ চলা শুরু। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি নানা মন্ত্রকের দায়িত্বে থাকার পর ২০১২ সালের ২৫ জুলাই ভারতের ১৩তম রাষ্ট্রপতি হিসাবে নিযুক্ত হন এবং ২০১৭ সালের ২২ জুলাই তার মেয়াদ শেষ হয়। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে প্রণব মুখোপাধ্যায় ছিলেন ভারতের রাজনীতির শীর্ষস্থানীয় সমস্যা-সমাধানকারী নেতা। উল্লেখ্য যে, তাঁর প্রয়াত স্ত্রী শুভ্রা মুখোপাধ্যায় ছিলেন আমাদের নড়াইলের মেয়ে।
২.
তাঁর জন্ম বীরভূম জেলার কীর্ণাহারের অদূরের মিরিটি গ্রামে। বাবা কামদাকিঙ্কর ছিলেন বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং কংগ্রেস নেতা। জেলা কংগ্রেস সভাপতি, এআইসিসি সদস্য এবং পশ্চিমবঙ্গ বিধান পরিষদেরও সদস্য হয়েছিলেন। সে দিক থেকে দেখতে গেলে রাজনীতি প্রণবের উত্তরাধিকার সূত্রেই পাওয়া। যদিও সিউড়ির বিদ্যাসাগর কলেজ বা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন রাজনীতির ছায়া মাড়াননি তিনি। বরং ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর পর্বের পরে মন দিয়েছিলেন আইনের ডিগ্রি পাওয়ায়। তবে আইনজীবীর পেশাকে বাছেননি কখনওই। ডাক ও তার বিভাগে করণিক এবং হাওড়ার বাঁকড়া স্কুলে শিক্ষকতা পর্বের পরে ১৯৬৩ সালে দক্ষিণ ২৪ পরগনার আমতলার অদূরে বিদ্যানগর কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষকতায় যোগ দেন। রাজনীতিতে তাঁর আত্মপ্রকাশ ১৯৬৯ সালে। ছয় দশকের রাজনৈতিক জীবনে তিনি সেদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রক সামলেছেন। এর জন্য তিনি ২০১১ সালে ‘দ্য বেস্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেটর ইন ইন্ডিয়া’ খেতাব পান। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে সেদিন আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং প্রণব মুখোপাধ্যায়ের হাতে এই সম্মান তুলে দেন। এ সময় তাকে একটি সোনার মেডেল, প্রশংসাপত্র এবং এক লাখ রূপীর চেক দিয়ে সম্মানিত করা হয়। এ সময় প্রধানমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের অসীম স্মৃতিশক্তি, অগাধ পান্ডিত্ব এবং কঠোর পরিশ্রমের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, সুষ্ঠুভাবে সরকার চালাতে এই নেতার জুড়ি নেই। একজন ব্যক্তি, নেতা ও কুটনীতিক হিসাবে এই মুহুর্তে সারাদেশে প্রণব মুখার্জির সমকক্ষ আর কেউ নেই।
৩.
রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হবার পর প্রণব মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, তিনি সকলের রাষ্ট্রপতি৷ যাঁরা ভোট দিয়েছেন এবং যাঁরা দেননি, তাঁদের সকলকেই তিনি ধন্যবাদ জানান৷ কারো প্রতি তিনি বিদ্বেষ পোষণ করেন না৷ তিনি সকলের আস্থা অক্ষুন্ন রাখতে চান৷ কারণ, রাজনৈতিক মেরুকরণে তিনি বিশ্বাসী নন৷ এতে বিদ্বেষ তৈরি হয়, যেটা চিন্তার বিষয়৷ তবে ইস্যু ভিত্তিক মেরুকরণ হতে পারে, জানান প্রণববাবু৷ তিনি জানান, তাঁর সামনে বহু চ্যালেঞ্জ৷ তবে পরিস্থিতি অনুযায়ী যা করণীয় তিনি তাই করবেন৷ তবে স্মরণ করা যেতে পারে, তাঁর তিন খণ্ডের আত্মজীবনী দ্য কোয়ালিশন ইয়ার্স-এর কিছু কথা। তিনি লিখেছেন, ২০০৪ সালে ভেবেছিলেন তাঁকে প্রধানমন্ত্রী করে মনমোহন সিংকে রাষ্ট্রপতি করা হবে। প্রধানমন্ত্রী হতে না পারার যন্ত্রণায় বিদ্ধ হয়ে তিনি রক্তাক্ত হয়েছেন। ইন্দিরা গান্ধীর অকৃপণ স্নেহ শেষ দিন পর্যন্ত পেলেও পরবর্তী গান্ধী প্রজন্মের বিশ্বস্ত সেভাবে তিনি হতে পারেননি। ২০১২ সালের যে পরিস্থিতিতে তিনি রাষ্ট্রপতি হন, তা তৈরির কৃতিত্ব তাঁরই। রাইসিনা হিলসে তাঁকে না পাঠিয়ে সোনিয়া গান্ধীর উপায় ছিল না।
৪.
দেশের রাষ্ট্রপতি যদি স্কুলে আসতেন পড়াতে তবে কেমন হত! শিক্ষক দিবসের প্রাক্কালে ২০১৬ সালেল ৪ সেপ্টেম্বর আমরা রাষ্ট্রপতি পদে আসীন থাকা অবস্থায় প্রণব মুখার্জীকে শিক্ষক হিসাবে দেখতে পেয়েছি। ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ সর্ভদয়া বিদ্যালয়ে ঐদিন উপস্থিত হয়ে রাষ্ট্রপতি পড়ালেন একাদশ ও দ্বাদশ ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের। স্কুলটি প্রেসিডেন্সিয়াল স্টেটে অবস্থিত, স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা ওই দিন জড়ো হয় ‘জ্ঞান-মেঝে’তে এবং শুনলো তাদের নতুন শিক্ষক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়কে। পরে রাষ্ট্রপতি প্রায় ১০০ জন শিক্ষকের উদ্দেশেও ভাষণ রাখেন। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল আর তাঁর উপ-মুখ্যমন্ত্রী মনিষ সিসোদিয়া রাষ্ট্রপতির কাছে এই ধারনাটি পেশ করেন। রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের এই ধারনাটি খুবই ভালো লাগে ও একদিনের জন্য শিক্ষকের ভূমিকা পালন করতে রাজি হয়ে যান। রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় ভালো শিক্ষার প্রসারে সবসময় জোর দিয়ে এসেছেন। এ বছরে স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে ভারতবাসীর উদ্দেশে ভাষণ রাখতে গিয়ে তিনি ‘গুরু-শিষ্য’ -র সম্পর্কের উপর খুবই গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
৫.
ছোটবেলায় গোপালের চেয়ে রাখালের সঙ্গেই বেশি মিল ছিল তাঁর। শিক্ষক দিবসের আগে দিল্লির ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ সর্বোদয়া বিদ্যালয়ে পড়ুয়াদের সঙ্গে আলাপচারিতায় শৈশবের ফিরে গেলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। তিনি আদৌ গোপালের মতো সুবোধ ছিলেন না। ছোটবেলায় সাংঘাতিক দুষ্টু ছিলেন তিনি। তাঁকে সামলাতে হিমশিম খেতে হত মাকে। তিনি জানিয়েছেন, মা-ই তাঁর আদর্শ শিক্ষক। তাঁর জীবনের সমস্ত সাফল্যর পিছনে রয়েছে এই মানুষটিরই কৃতিত্ব। তাঁর মা তাঁকে শিখিয়েছেন, পরিশ্রমের কোনও বিকল্প নেই। দিনের শেষে বাড়ি ফিরে এলে মা ছেলের কাছে সারাদিনের কাজকর্ম সম্পর্কে জানতে চাইতেন। সেই মতো প্রত্যেকদিন সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সমস্ত ঘটনা তিনি মাকে জানাতেন। তিনি বলেছেন, আমি কোনও দিনই মেধাবি ছাত্র ছিলাম না। তবে খুব পরিশ্রমী ছিলাম। মজার ছলে রাষ্ট্রপতি বলেন, অনেকটা হাঁটতে হত বলে স্কুলে যেতে চাইতাম না। তাই মা বলেছিলেন, এমন কলেজে ভর্তি করাবেন, যেখান থেকে হস্টেল খুব কাছে হবে। প্রতিশ্রুতি রেখেছিলেন মা। সেদিন স্কুলে পড়ুয়াদের ইতিহাস ও সংবিধানের পাঠ দেন রাষ্ট্রপতি। ক্লাসে তিনি বলেন, আজ আমি কোনও মন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি নই, আমি তোমাদের ‘মুখার্জী স্যার’। স্কুলের পড়ুয়াদের তিনি বলেন, মা-ই আসলে প্রত্যেকের জীবনে আদর্শ শিক্ষক।
৬.
প্রণব মুখোপাধ্যায়ের জন্ম অধুনা পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার কীর্ণাহার শহরের নিকটস্থ মিরাটি গ্রামে। তাঁর পিতার নাম কামদাকিঙ্কর মুখোপাধ্যায় ও মাতার নাম রাজলক্ষ্মী দেবী। বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী কামদাকিঙ্কর ১৯২০ সাল থেকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। ব্রিটিশ শাসনকালে তিনি দশ বছর কারারুদ্ধ ছিলেন। পরে কামদাকিঙ্কর অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটি এবং পশ্চিমবঙ্গ বিধান পরিষদের সদস্য (১৯৫২-৬৪) হন; তিনি বীরভূম জেলা কংগ্রেস কমিটির সভাপতির পদও অলংকৃত করেন। প্রণব মুখোপাধ্যায় সিউড়ির বিদ্যাসাগর কলেজের ছাত্র ছিলেন; এই কলেজটি সেই সময়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ছিল।
৭.
১৯৫৭ সালে শুভ্রাদেবীকে বিয়ের সময় আত্মীয়-পরিজনেদের একাংশের তরফে নাকি আপত্তি উঠেছিল। কারণ তিনি ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে ছিলেন না। প্রণব তাতে তোয়াক্কা করেননি। বিদ্যানগর কলেজে যোগ দেওয়ার পরে টানা পাঁচ বছর আমতলাতেই ছিলেন প্রণব। রিকশা করে যাতায়াত করতেন প্রায় ছ’কিলোমিটার দূরের কলেজে। মুখোপাধ্যায় দম্পতির বেশ পছন্দও হয়ে গিয়েছিল জায়গাটি। সেখানে থিতু হওয়ার জন্য জমিও কিনে ফেলেছিলেন। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি। ১৯৬৬ সালে, বিদ্যানগর কলেজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হরেন্দ্রনাথ মজুমদারের হাত ধরে, শুরু হওয়া রাজনৈতিক সফর প্রণবকে টেনে নিয়ে যায় অনেক দূরের অন্য ঠিকানায়। প্রণব মুখোপাধ্যায় একজন কলেজশিক্ষক রূপে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। পরে তিনি সাংবাদিকের কাজও করেন কিছুকাল। এই সময় তিনি দেশের ডাক নামে একটি পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এছাড়াও তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের ট্রাস্টি ও পরে নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতিও হন।
৮.
১৯৬৭ সালের বিধানসভা ভোটে হরেন্দ্রনাথ প্রার্থী হন। প্রণব তাঁর প্রচারে পথে নামেন। খুব দ্রুতই বাংলা কংগ্রেসের প্রধান তথা রাজ্যের তত্কালীন মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায়ের নজরে পড়ে যান প্রণব। প্রণবের বাবা কামদাকিঙ্করের সঙ্গে অজয়বাবুর ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল। যদিও তাঁকে কংগ্রেস ছাড়িয়ে নিজের দলে আনতে পারেননি অজয়বাবু। ১৯৬৯ সালের বিধানসভা ভোটে রাজ্যের নানা প্রান্তে প্রচারে পাঠানো হয় প্রণবকে। মেলে রাজ্যসভার সাংসদ পদ। ওই বছর মেদিনীপুর লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে বাংলা কংগ্রেস সমর্থিত নির্দল প্রার্থী, নেহরু জমানার প্রতিরক্ষামন্ত্রী ভি কে কৃষ্ণমেননের জয়ের নেপথ্যেও বড় ভূমিকা ছিল প্রণবের। সংসদীয় রাজনীতির ইনিংস শুরু করার পরেই প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধীর নজরে পড়ে গিয়েছিলেন প্রণব। তার পরে তাঁকে আর পিছনে ফিরে চাইতে হয়নি। ১৯৭১ সালে, প্যারিসে ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের সভায় যে ভারতীয় প্রতিনিধিদল বাংলাদেশের স্বাধীনতার হয়ে সওয়াল করেছিল, ৩৬ বছরের প্রণব সেই দলে ছিলেন। তখনও তিনি বাংলা কংগ্রেসেই আছেন। ১৯৭৫ সালে কংগ্রেসের টিকিটে দ্বিতীয়বার রাজ্যসভার সদস্য হন প্রণব মুখোপাধ্যায়। তার আগে, ১৯৭৩ সালে শিল্প প্রতিমন্ত্রী হিসেবে প্রথম বার কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় প্রবেশ। তত দিনে তাঁর পুরনো দল বাংলা কংগ্রেসও মিশে গিয়েছে কংগ্রেসে। প্রণব মুখোপাধ্যায় প্রায় পাঁচ দশক ভারতীয় সংসদের সদস্য। ১৯৬৯ সালে তিনি প্রথম বার কংগ্রেস দলের প্রতিনিধিস্বরূপ রাজ্যসভায় নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৭৫, ১৯৮১, ১৯৯৩ ও ১৯৯৯ সালেও তিনি রাজ্যসভায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালে কেন্দ্রীয় শিল্পোন্নয়ন উপমন্ত্রী হিসেবে তিনি প্রথম ক্যাবিনেটে যোগদান করেন।
৯.
ক্যাবিনেটে ক্রমান্বয়ে পদোন্নতির পর ১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি ভারতের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৪ সালে ইউরোমানি পত্রিকার একটি সমীক্ষায় তাঁকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ পাঁচ অর্থমন্ত্রীর মধ্যে অন্যতমের শিরোপা দেওয়া হয়।তাঁর মন্ত্রীত্বকালের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল ভারতের আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডারের ঋণের শেষ কিস্তির ১.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ না তোলা। তাঁর এই মন্ত্রীত্বকালে ড. মনমোহন সিংহ ছিলেন ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর। ইন্দিরা হত্যার অব্যবহিত পরে একটি দলীয় গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব্ব্বের শিকার হন প্রণব মুখোপাধ্যায়। এই সময় রাজীব গান্ধী তাঁকে নিজের ক্যাবিনেটে স্থান দেননি। কিছুকালের জন্য তাঁকে কংগ্রেস থেকে বহিষ্কারও করা হয়েছিল। এই সময় তিনি রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস নামে নিজস্ব একটি দলও গঠন করেছিলেন। তবে ১৯৮৯ সালে রাজীব গান্ধীর সঙ্গে মিটমাট করে নেওয়ার পর এই দল নিয়ে তিনি আবার কংগ্রেসে যোগ দেন। পরবর্তীকালে পি. ভি. নরসিমা রাও তাঁকে পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান নিযুক্ত করলে তাঁর রাজনৈতিক কর্মজীবনের পুনরুজ্জীবন ঘটে। রাওয়ের মন্ত্রিসভায় পরে তিনি ক্যাবিনেট মন্ত্রীরূপেও যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৯৫-৯৬ সালে তিনি রাওয়ের মন্ত্রিসভায় বিদেশমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৭ সালে তিনি শ্রেষ্ঠ সাংসদ পুরস্কারে ভূষিত হন।
১০.
প্রণব মুখোপাধ্যায় জাতীয় কংগ্রেসের পশ্চিমবঙ্গ শাখারও সভাপতি। ২০০৪ সালে, কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সংযুক্ত প্রগতিশীল জোট কেন্দ্রে সরকার গঠন করে। এই সরকারের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ রাজ্যসভার সদস্য হওয়ায়, প্রণব মুখোপাধ্যায়ের লোকসভায় কংগ্রেস দলনেতার দায়িত্ব পান। উল্লেখ্য, এই বছরই তিনি প্রথমবার জঙ্গীপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে লোকসভায় নির্বাচিত হন।
১১.
প্রণব মুখোপাধ্যায় বিভিন্ন সময়ে প্রতিরক্ষা, অর্থ, বিদেশ, রাজস্ব, জাহাজ-চলাচল, পরিবহন, যোগাযোগ এবং শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রকের মতো একাধিক মন্ত্রকের দায়িত্ব গ্রহণের বিরল কৃতিত্বের অধিকারী। তিনি সারা দেশের কংগ্রেস সাংসদ ও বিধায়কদের নিয়ে গঠিত যথাক্রমে কংগ্রেস সংসদীয় দল ও কংগ্রেস বিধানসভা দলেরও প্রধান। পঞ্চদশ লোকসভা নির্বাচনের অব্যবহিত পূর্বে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের বাইপাস সার্জারির সময় তদনীন্তন বিদেশমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় রাজনীতি বিষয়ক ক্যাবিনেট কমিটির চেয়ারম্যান ও কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রকের অতিরিক্ত দায়িত্ব গ্রহণ করে ক্যাবিনেট পরিচালনায় বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেন।
১২.
২০০৮ সালের ১০ অক্টোবর প্রণব মুখোপাধ্যায় ও ইউএস সেক্রেটারি অফ স্টেট কন্ডোলিজা রাইস সেকশন ১২৩ চুক্তি সই করেন। তিনি আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার, বিশ্ব ব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও আফ্রিকান উন্নয়ন ব্যাংকের বোর্ড অফ গভর্নরসের সদস্য। ১৯৮৪ সালে প্রণব মুখোপাধ্যায় আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার ও বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সংযুক্ত গ্রুপ অফ টোয়েন্টিফোরের সভাপতিত্ব করেন। ১৯৯৫ সালের মে থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত তিনি সার্ক মন্ত্রিপরিষদ সম্মেলনেও সভাপতিত্ব করেছিলেন।
১৩.
২০০৬ সালের ২৪ অক্টোবর প্রণব মুখোপাধ্যায়কে ভারতের বিদেশমন্ত্রীর দায়িত্বে নিযুক্ত করা হয়। প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের দায়িত্বে তাঁর পরিবর্তে আসেন প্রবীণ কংগ্রেস নেতা তথা কেরলের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এ. কে. অ্যান্টনি। এই সময় ভারতের রাষ্ট্রপতির পদে তাঁর নাম সাময়িকভাবে বিবেচিত হয়। কিন্তু পদটি নিছক আনুষ্ঠানিক হওয়ায়, কেন্দ্রীয় ক্যাবিনেটে তাঁর অবদান ও কার্যকরিতার কথা মাথায় রেখে তাঁর নাম বিবেচনা থেকে প্রত্যাহৃত হয়। বিদেশ মন্ত্রকে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কৃতিত্বগুলি হল প্রথমে মার্কিন সরকারের সঙ্গে ভারত-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অসামরিক পরমানু চুক্তি সই ও পরে নিউক্লিয়ার নন-প্রলিফিকেশন ট্রিটি সই না করেই নিউক্লিয়ার সাপ্লায়ারস গ্রুপের থেকে অসামরিক পরমাণু বাণিজ্যের অনুমতি আদায়। ২০০৭ সালে তাঁকে ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান পদ্মবিভূষণ দ্বারা সম্মানিত করা হয়।
১৪.
নিজের দলে প্রণব মুখোপাধ্যায় এক ব্যতিক্রমী সম্মানের অধিকারী। অন্যান্য গণমাধ্যমে তাঁর এই সম্মানকে “a reputation as a number-crunching politician with a phenomenal memory and an unerring survival instinct” বলে উল্লেখ করা হয়। সনিয়া গান্ধী অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাজনীতিতে যোগদান করতে সম্মত হলে প্রণব মুখোপাধ্যায় তাঁর প্রধান সহায়কের ভূমিকা পালন করেন। বিভিন্ন সমস্যা সনিয়ার শাশুড়ি ইন্দিরা গান্ধী কিভাবে সমাধান করতেন, তার উল্লেখ করে তিনি সনিয়াকে সাহায্য করতেন। প্রণব মুখোপাধ্যায়ের প্রশ্নাতীত আনুগত্য ও প্রজ্ঞা তাঁকে সনিয়া গান্ধী ও মনমোহন সিংহের ঘনিষ্ঠ করে তোলে। ২০০৪ সালে দল ক্ষমতায় এলে প্রণব মুখোপাধ্যায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের সম্মানজনক দায়িত্বটি পান। ২০০৫ সালে পেটেন্ট অ্যামেন্ডমেন্ট বিল পাসের ক্ষেত্রে তিনি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। যদিও এই বিলটি সরাসরি তাঁর মন্ত্রক বা তাঁর দায়িত্ব তালিকাভুক্ত ছিল না।
১৫.
প্রণব মুখোপাধ্যায় রাজনৈতিকভাবে পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির অধিকারী হলেও একজন বাস্তববাদী। রিডিফকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে তাঁকে তাঁর সরকারের দুর্নীতি সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন: দুর্নীতি একটি ইস্যু। আমাদের ইস্তাহারে এই প্রসঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু দুঃখের সঙ্গেই জানাচ্ছি যে কেলেংকারি কেবল কংগ্রেস বা কংগ্রেস সরকারের মধ্যেই আবদ্ধ নেই। অনেক কেলেংকারি রয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অনেক নেতাই এই ধরনের কেলেংকারির সঙ্গে জড়িত। তাই কংগ্রেস সরকার দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত; এমন কথা বললে বিষয়টি লঘু করে দেখানো হবে।
১৬.
মনমোহন সিংহের দ্বিতীয় সরকারে প্রণব মুখোপাধ্যায় পুনরায় অর্থমন্ত্রকের দায়িত্ব পান। উল্লেখ্য, ১৯৮০-এর দশকে তিনি এই মন্ত্রকেরই দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। ২০০৯ সালের ৬ জুলাই তিনি সরকারের বার্ষিক বাজেট পেশ করেন। এই বাজেটে তিনি কয়েকটি কর সংস্কারের প্রস্তাব রাখেন। যেমন, ‘অস্বস্তিকর’ ফ্রিঞ্জ বেনেফিট ট্যাক্স ও কমোডিটিজ ট্র্যানজাকশান ট্যাক্সের অবলোপন ইত্যাদি। এছাড়া তিনি ঘোষণা করেন যে অর্থমন্ত্রক শীঘ্রই গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স নামে একটি কর চালু করবে। এই করের কাঠামোটির প্রশংসা করেন বিভিন্ন কর্পোরেট কর্মকর্তা ও অর্থনীতিবিদগণ। এছাড়াও তিনি কয়েকটি সমাজকল্যাণমূলক প্রকল্পে অর্থবরাদ্দ করেন। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান সুনিশ্চিতকরণ আইন, শিশুকন্যাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবা ইত্যাদি। এছাড়াও অর্থবরাদ্দ করেন জাতীয় সড়ক উন্নয়ন কর্মসূচি, বিদ্যুদয়ন প্রকল্প, এবং জওহরলাল নেহেরু জাতীয় নগরোন্নয়ন মিশনের মতো পরিকাঠামো উন্নয়ন সংক্রান্ত প্রকল্পগুলিতেও। যদিও কেউ কেউ তাঁর অর্থমন্ত্রিত্বে রাজস্ব ঘাটতি বৃদ্ধিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
১৭.
এনডিএ প্রার্থী লোকসভার সাবেক স্পিকার মেঘালয়ের ভূমিপুত্র পিএন সাংমাকে ৭১ শতাংশের বেশি ভোটে হারিয়ে রোববার ভারতের রাষ্ট্রপতি পদে ইউপিএ প্রাথী প্রণব মুখার্জি নির্বাচিত হন। ২৫ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন তিনি। তিনি পান পাঁচ লাখ ১৮ হাজার ৬৮৯টি ভোট, অন্যদিকে সাংমা পান দুই লাখ ৩২ হাজার ৫৫৮টি ভোট।
১৮.
১৯৫৭ সালের ১৩ জুলাই প্রণব মুখোপাধ্যায় পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন শুভ্রা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তাঁদের দুই পুত্র ও এক কন্যা বর্তমান। তাঁর অবসরকালীন শখ ছিলো বই পড়া, বাগান করা ও গান শোনা।
১৯.
প্রণব মুখোপাধ্যায় একাধিক সম্মান ও পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৮৪ সালে ইউরোমানি পত্রিকার সমীক্ষায় তাঁকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ অর্থমন্ত্রী বলা হয়েছিল। ২০১০ সালে বিশ্ব ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের দৈনিক সংবাদপত্র এমার্জিং মার্কেটস তাঁকে ‘”ফাইনান্স মিনিস্টার অফ দ্য ইয়ার ফর এশিয়া” পুরস্কার দিয়েছিল। ২০১০ সালের ডিসেম্বর মাসে, দ্য ব্যাঙ্কার পত্রিকা তাঁকে “ফাইনান্স মিনিস্টার অফ দ্য ইয়াস” সম্মান দিয়েছিল। ভারত সরকার ২০০৮ সালে তাঁকে ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান পদ্মবিভূষণ প্রদান করেছিল। ২০১১ সালে উলভারহ্যাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সাম্মানিক ডক্টর অফ লেটারস ডিগ্রি দেয়। ২০১২ সালের মার্চ মাসে অসম বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্বেশ্বরায়া প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সাম্মানিক ডি. লিট ডিগ্রি দেয়। ২০১৩ সালের ৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সাম্মানিক ডক্টরেট অফ ল ডিগ্রি দেয়। ২০১৩ সালের ৫ মার্চ তিনি বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক পুরস্কার “বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা” পান। ২০১৩ সালের ১৩ মার্চ মরিশাস বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডক্টর অফ ল সম্মান দেয়।
২০.
তাঁর রচিত গ্রন্থাবলি : মিডটার্ম পোল’, বিয়ন্ড সারভাইভ্যাল, এমার্জিং ডাইমেনশনস অফ ইন্ডিয়ান ইকোনমি, অফ দ্য ট্র্যাক, সাগা অফ স্ট্রাগল অ্যান্ড স্যাক্রিফাইস, চ্যালেঞ্জ বিফোর নেশন। সম্প্রতি ভারতের রাষ্ট্রপতি এবং বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে পরিচিত কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা প্রণব মুখার্জির বই ‘দি ড্রামেটিক ডিকেড দি ইন্দিরা গান্ধী ইয়ার্স প্রকাশ করেছে দিল্লির রুপা পাবলিকেশন্স। এ বইয়ের একটি অধ্যায় ‘মুক্তিযুদ্ধ: দি মেকিং অব বাংলাদেশ’-এ আমাদের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখেছেন অনেক কথা।
২১.
ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে ৫ দিনের সফরে আসেন বাংলাদেশ। সফরে তিনি আন্তর্জাতিক বাংলা সাহিত্য সম্মেলনে অংশগ্রহণসহ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তন, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন শেষে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত করেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অগ্নিপুরুষ মাস্টারদা সূর্য সেন ও বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের স্মৃতিবিজড়িত কিছু স্থান পরিদর্শন করেছেন প্রণব মুখার্জি। চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে তৎকালীন ইউরোপিয়ান ক্লাবের সামনে স্থাপিত প্রীতিলতার আবক্ষ মূর্তিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান প্রণব মুখার্জি। এর পর ক্লাবটি ঘুরে দেখেন তিনি। এর আগে নগরের দামপাড়া পুলিশ লাইনে ব্রিটিশ পুলিশের অস্ত্রাগার হিসেবে ব্যবহূত দুটি স্থাপনা পরিদর্শন করেন তিনি। মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীরা অস্ত্রাগারটি দখলে নিয়েছিলেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব মাস্টারদা সূর্যসেন ও বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের স্মৃতিবিজড়িত স্থান পরিদর্শন এবং বিপ্লবীদের আবক্ষ মূর্তিতে শ্রদ্ধা নিবেদনের মাধ্যমে অনেক আবেগ নিয়ে চট্টগ্রাম ঘুরে যান ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী।
২২.
ভারতের প্রবীণ এই রাজনীতিবিদ রাষ্ট্রপতি ভবন ছেড়েছেন খুব বেশিদিন হয়নি। তার ২০১৮ সালের বাংলাদেশ সফরটা একটু অন্যরকম। ব্যক্তিগত হলেও গুরুত্বপূর্ণ। ‘বাংলাদেশের জামাই’ প্রণবের এদেশ সম্পর্কে জানাশোনাও বেশ। এ ভূমের রাজনীতিবিদদের সঙ্গেও তার নিবিড় যোগাযোগ। পাঁচ দিনের সেই সফরে প্রণব মুখার্জি গিয়েছিলেন চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানিত করেছে ডি-লিট ডিগ্রিতে। এজন্য প্রণব মুখার্জি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি। ডিগ্রি প্রদান অনুষ্ঠানে দেয়া বক্তব্যে ভারতের সাবেক এই প্রেসিডেন্ট ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাপ্রবাহ উপস্থাপন করেন। প্রণব মুখার্জী উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা পরবর্তী রাজনৈতিক হত্যাকান্ড প্রসঙ্গ তুলে ধরে বলেন, ইতিহাস ও সমাজতত্ত্বের পন্ডিতদের এর কারণ বের করা দরকার। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ১৯৩১ সাল পর্যন্ত ভারতবর্ষ একটা ইউনিট ছিল। একটি প্রশাসনের অধীনে ছিল। স্বাধীনতার অব্যবহিত পূর্বে এবং পরে কোন সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে এই বিপুলসংখ্যক রাজনৈতিক হত্যাকান্ড সংঘটিত হলো তার কারণও অনুসন্ধান করতে হবে। প্রণব মুখার্জী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দুটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে বলেন। প্রশ্ন দুটি হলো- কেন বার বার নেতাদের হত্যা করা হয় এবং কেন সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করতে ব্যারাক থেকে বেরিয়ে আসে । উপমহাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব কেন বারবার হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছে তার কারণ জানতে গবেষণার আহ্বান জানিয়েছেন। প্রণব মুখার্জি বলেছেন, এ উপমহাদেশে যাদের নেতৃত্বে বিভিন্ন দেশ স্বাধীন হয়েছে, সে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর কেন বারবার হিংসাত্মক আক্রমণ হয়েছে তা জানতে হবে। নিহত নেতাদের নামও নেন প্রণব। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশের জাতীয় চার নেতা, ভারতের মহাত্মা গান্ধী, শ্রীলঙ্কার সলোমন বন্দরনায়েক, রানাসিঙ্গে প্রেমদাসা, পাকিস্তানের জেনারেল জিয়াউল হক ও জুলফিকার আলী ভুট্টোর কথা উল্লেখ করেন।
২৩.
বাংলাদেশের রাজনীতির অন্দরমহলের সঙ্গে প্রণব মুখার্জির নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে। এ দেশের জন্ম প্রক্রিয়ায় ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করা এ রাজনীতিবিদ তার ‘দ্য কোয়ালিশন ইয়ারস ১৯৯৬-২০১২’ বইয়ে এ ব্যাপারে বিস্তারিত লিখেছেন। যেখানে জরুরি অবস্থার সময় বাংলাদেশের দুই নেত্রীর মুক্তিতে এবং আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ সংকট নিরসনে তার ভূমিকার বিস্তারিত বয়ান রয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে আরেকটি ঘটনাতেও প্রণব মুখার্জির নাম বারবার আলোচনায় আসে। ৫ই জানুয়ারি নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালে রাজনৈতিক গোলযোগের সময় বাংলাদেশ সফর করেন প্রণব মুখার্জি। সেসময় তার সঙ্গে সাক্ষাতের কথা ছিল বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার। কিন্তু হরতাল থাকায় নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে শেষ মুহূর্তে খালেদা জিয়া ওই বৈঠক বাতিল করেন। এ নিয়ে নানা সময়ে রাজনীতিতে নানা বাৎচিতও হয়েছে। এ রকম আরো অনেক রাজনৈতিক ঘটনার সাথে জড়িয়ে আছে প্রণব মুখার্জির নাম।
২৪.
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯২ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতোন বাংলায় সমাবর্তন ভাষণ দিয়েছিলেন কোনো সমাবর্তন বক্তা, তিনিই ভারতের প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি। প্রণব মুখার্জি ২০১৩ সালের মার্চে এসেছিলেন বাংলাদেশে। সেই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম সমাবর্তনে ‘আমার শিকড় বাংলাদেশের মাটিতে গাঁথা’ শিরোনামের সেই অসাধারণ বক্তৃতার পূর্ণ বিবরণ প্রকাশ করার লোভ সামলানো গোলো না বলে তুলে ধরা হলো।
১.
‘আজ এই ঐতিহাসিক স্থানে আপনাদের মধ্যে উপস্থিত হতে পেরে আমি গর্বিত। আপনারা আমাকে এক অসাধারণ অভ্যর্থনা জানিয়েছেন। আপনারা আমার প্রতি যে ভালোবাসা ও স্নেহসুধা বর্ষণ করেছেন এবং যে চমৎকার আতিথেয়তা প্রকাশ করেছেন, তাতে আমি অভিভূত।
২.
বাংলাদেশ ভারতের রাষ্ট্রপতি হিসেবে আমার বিদেশ সফরের প্রথম দেশ। বাংলাদেশে ভারতের রাষ্ট্রপতির শেষ সফর ছিল রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরির, প্রায় ৪০ বছর আগে ১৯৭৪ সালে।
৩.
আমার জন্য ব্যক্তিগতভাবে এটি একটি আবেগময় সফর। আমার শিকড় বাংলাদেশের মাটিতে গাঁথা এবং আমি এর ভাষা, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি আত্মভূত করেছি। আমার স্ত্রীর জন্ম নড়াইলে এবং এখানেই তিনি লেখাপড়া শুরু করেন। আমি বড় হয়েছি আপনাদের মতো একই সাহিত্যিক ও কবিদের লেখা পড়ে, সেসব গান শুনে যা আমাদের উভয় দেশের জনগণ ভালোবাসেন, ঘুরে বেড়িয়েছি একই নদীর তীরে, যা একই রকম গানের জন্ম দেয়, যা আমাদের মনকে একই রকমভাবে ভাবিত করে তোলে। যখন ছোট ছিলাম, আমি স্বপ্নেও ভাবিনি যে একদিন আমার দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে আমি এখানে আসতে পারব।
৪.
রাষ্ট্রপতির পদে নির্বাচিত হওয়ার পর বাংলাদেশের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন ও শুভেচ্ছা জ্ঞাপনে আমি অভিভূত। আমি বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সর্বস্তরের মানুষের অনেক অভিনন্দনবার্তা পেয়েছি। এই সুযোগে আমি সেদিনের শুভেচ্ছার জন্য বাংলাদেশের মানুষকে আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
৫.
আমি আজ শতবর্ষের দ্বারপ্রান্তে উপনীত মহান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্রভূমিতে দাঁড়িয়ে আছি। এটি একটি অর্জনের শতাব্দী এবং এই সমাবর্তন উৎসবে আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন শিক্ষাক্রমে কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ সব স্নাতক শিক্ষার্থীকে অভিনন্দন জানাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের প্রাচীনতম ও বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয়। আজ আমরা যেমন ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ হিসেবে এর পুরোনো খ্যাতির কথা স্মরণ করি, তেমনই আমরা গর্বের সঙ্গে লক্ষ করি সমসাময়িক এশিয়ার শীর্ষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এর অবস্থান। আজ আপনারা যাঁরা স্নাতক হচ্ছেন, তাঁরা আপনাদের আগের প্রজন্মগুলোর উত্তীর্ণ মহান প্রাক্তনীদের পদাঙ্ক অনুসরণ করছেন। মনে আসছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, বৈজ্ঞানিক সত্যেন্দ্রনাথ বোস, ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার, সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ, কবি বুদ্ধদেব বসু ও শামসুর রাহমানের নাম। এঁদের মধ্যে আছেন গত শতাব্দীর বহু উজ্জ্বলতম মননশীল ব্যক্তিত্ব, যাঁরা তাঁদের শিক্ষাগত অর্জনের জন্য বিশিষ্ট হয়ে আছেন।
৬.
এখানে যাঁরা আসেন তাঁরা কেউ ভুলতে পারেন না যে এই বিশ্ববিদ্যালয় কি অনুপমরূপে আপনাদের জাতীয়তার সঙ্গে চিহ্নিত। এই মহান শিক্ষায়তনের ছাত্রাবাসগুলো বাংলাদেশ সৃষ্টির সূতিকাগার ও কর্মভূমি। এই ক্যাম্পাসে স্বাধীনতাযুদ্ধের অগণিত রূপকার প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। এঁদের আগে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা ছিলেন পথপ্রদর্শক। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্র“য়ারি তৎকালীন সরকারের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ যে মিছিল বের করেছিল, সে কথা কে ভুলতে পারে ২১ ফেব্র“য়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করে আজ জাতিসংঘ ভাষা আন্দোলনের শহীদদের আত্মত্যাগের স্বীকৃতি দিয়েছে।
৭.
আবার এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাই ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পৈশাচিক হামলার বিরুদ্ধে বীরত্বব্যঞ্জক প্রতিরোধ গড়ে তোলেন, যে হামলায় তাঁদের তিন শতাধিক সতীর্থ, শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবী নিহত হন। তাঁরা অনেকের সঙ্গে এ দেশের ওপর চাপানো অসহিষ্ণুতা ও ঘৃণার বিরুদ্ধে প্রাচীর গড়ে তোলেন এবং তাঁরাই আবার স্বাধীনতার পর দেশের সামাজিক-রাজনৈতিক রূপান্তরকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার নিরন্তর প্রয়াস চালাচ্ছেন।
৮.
আজ যখন বাংলাদেশ মুক্ত ও স্বাধীন এবং আনন্দের সঙ্গে আত্মোন্নয়নে নিয়োজিত, তখন এর শহীদদের আত্মত্যাগের স্বীকৃতি মিলছে। তাঁদের আত্মত্যাগের ফলেই আজ বাংলাদেশের তরুণসমাজ এই দেশকে তাঁদের নিজেদের দেশ বলতে পারছে। আপনাদের মতো তরুণ-তরুণীরাই আমাদের অঞ্চলের আর্থসামাজিক উন্নয়নের চালিকাশক্তি। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ আপনাদের হাতে। আপনাদের জানা উচিত যে আপনাদের একটি মহামান্বিত অতীত আছে এবং প্রতিশ্র“তিভরা ভবিষ্যৎ আছে। জাতিগঠন কাজে বাংলাদেশের তরুণসমাজের বিচক্ষণতা, সচেতনতা ও সংশ্লিষ্টতা আমাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। এটি একটি ভালোবাসার শ্রম, যেভাবে এ দেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর অনবদ্য ভাষায় বর্ণনা করেছেন, ‘যা মানবসভ্যতাকে উদ্বিগ্ন করে, একজন মানুষ হিসেবে তা আমাকেও উদ্বিগ্ন করে। একজন বাঙালি হিসেবে বাঙালিকে যেসব বিষয় উদ্বিগ্ন করে, আমি তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই অবধারিত জড়িয়ে পড়া দীর্ঘস্থায়ী ভালোবাসা, চিরন্তন ভালোবাসার মধ্যে সৃষ্ট ও লালিত, যা আমার রাজনীতি এবং আমার একাত্মতা নিজস্বতা তাৎপর্য দিয়েছে।’
৯.
মানবতা ও আস্থার এই অসাধারণ চেতনাই বাংলাদেশের অগ্রগতি ত্বরান্বিত করেছে। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দ্রুত বেড়ে ওঠা অর্থনীতির দেশ হয়ে উঠেছে। এটি প্রশংসনীয়। সার্বিক মানব উন্নয়নে তাদের অর্জনের জন্য আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ও বাংলাদেশের জনগণের প্রশংসা করি। অনেক সামাজিক মাপকাঠিতে বাংলাদেশ দৃষ্টান্তমূলকভাবে এগিয়ে আছে। দেখা গেছে, ১৫ থেকে ২৪ বয়ঃক্রমের তরুণদের মধ্যে সাক্ষরতার হার এখন ৭৭ শতাংশ, অন্যদিকে মানুষের গড় আয়ু ৬৯ বছর। আপনারা দারিদ্র্য বিমোচন, ক্ষুধা নিরসন ও সর্বজনীন শিক্ষার ক্ষেত্রে নতুন নজির স্থাপন করেছেন। বাংলাদেশের বিদ্যালয় পাঠ্যবই প্রণয়ন প্রকাশ কর্মসূচি পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ শিক্ষাজনিত কর্মসূচি বলে পরিচিত এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয় পর্যায়ে তালিকাভুক্ত শিক্ষার্থীর গড় প্রায় ৫১ শতাংশ। যদিও দারিদ্র্যের হার প্রায় ৩১ শতাংশ, আপনাদের অর্জন বিশ্বমানের, যার ওপর ভিত্তি করে সমৃদ্ধ ও উন্নত বাংলাদেশের সৌধ নির্মিত হবে। এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত, আপনারা, বাংলাদেশের তরুণেরা, নিষ্ঠার সঙ্গে এই মহান দায়িত্ব পালন করবেন।
১০.
আজ বাংলাদেশ যে গণতন্ত্রকে বরণ করেছে, সেটি হলো ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধে এর জনগণ যে মূল্যবোধ ও নীতিমালার সমাদর করতেন, তার কারণে। আপনারা আপনাদের লক্ষ্যে অবিচল থেকেছেন। আপনারা যে কারোর চেয়ে ভালো জানেন যে গণতন্ত্রের অর্থ হচ্ছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সম্মান প্রদর্শন এবং অভিন্ন কল্যাণের জন্য জনগণের ইচ্ছাকে স্বীকৃতি দেওয়া। আপনারা জানেন যে এর অর্থ হচ্ছে আইনশৃঙ্খলার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন এবং স্বাধীন উক্তি ও স্পন্দমান সংবাদমাধ্যমের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করে তোলা। আমি নিশ্চিত যে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও শক্তিশালী হবে এবং আপনারা গণতন্ত্র রক্ষায় সদাসতর্ক থাকবেন।
১১.
ভারত ও বাংলাদেশ যেভাবে আন্তসম্পর্কযুক্ত, বিশ্বে এমন আর দুটি দেশ নেই। আমাদের নিয়তি আমাদের ইতিহাস এবং ভূগোলের মতোই একত্রে বোনা। আমাদের সাধ্যের মধ্যে ভারত বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নতি ও তার জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণে সমর্থন দিতে প্রতিশ্র“তিবদ্ধ। আমরা বিশ্বাস করি, ভারত ও বাংলাদেশকে একযোগে উন্নতি ও প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে এবং এটি নিশ্চিত করতে হবে যে আমাদের প্রবৃদ্ধি যেন আমাদের দুই দেশের জনগণের জন্য আরও সুযোগ সৃষ্টি করে। আমরা উভয়েই একই বাধার মোকাবিলা করছি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেমন বলেছেন, আমাদের একই শত্রু, সেই শত্রু দারিদ্র্য। আমাদের অর্থনৈতিক সহযোগিতার শক্তি সর্বাধিক করতে আমাদের একযোগে কাজ করা প্রয়োজন। একটি দ্রুতপ্রজ আধুনিক অর্থনীতির দেশ হিসেবে উঠে আসতে বাংলাদেশ তার প্রাকৃতিক ও মানবসম্পদ কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। স্থল ও জলসম্পদের শক্তি ছাড়াও বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান এমন একটি আশীর্বাদ, যা অনুসন্ধান করা এবং লাভজনকভাবে কাজে লাগানো দরকার। বাংলাদেশ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগস্থলে অবস্থিত। দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতার ধারণা বাংলাদেশে জন্মলাভ করে। উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আবার নেতৃত্ব গ্রহণ করেছে। এর বাস্তব ফল পাওয়া যাবে সুষ্ঠু জল ব্যবস্থাপনা, অধিক বিদ্যুৎ ও গ্রিড সংযুক্তি, আরও বাণিজ্য এবং দুই দেশের মধ্যে জনগণ ও পণ্যের আরও আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে। ভারত ও বাংলাদেশ আমাদের এই অঞ্চলে এবং এর বাইরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বৃহত্তর সমন্বয়ের পথে নেতৃত্ব দিতে পারে।
১২.
২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর এবং ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের ফলে ভারত ও বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে একটি নতুন জোয়ার এনেছে। এখন আমাদের উন্নয়নের জন্য সহযোগিতা চুক্তি কাঠামো রয়েছে, যা আমাদের ভবিষ্যৎ সহযোগিতার পথনির্দেশিকা। এ দুই ঐতিহাসিক সফরকালে গৃহীত সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নে দুই দেশের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখে আমি সন্তুষ্ট। আমি আপনাদের আশ্বস্ত করতে চাই যে ভারত সব গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে প্রতিশ্র“তিবদ্ধ রয়েছে।
১৩.
ভারত ও বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ানোর বিরাট সুযোগ রয়েছে। প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ভারত সরকার বাংলাদেশ থেকে আমদানির ক্ষেত্রে ২৫টি ট্যারিফ লাইন ছাড়া সব পণ্যের ওপর থেকে কোটা ও শুল্কের বাধা তুলে দিয়েছে। বাংলাদেশ এখন আমাদের বিশাল বাজারে করমুক্ত প্রবেশাধিকার লাভ করেছে। আমি বাংলাদেশের শিল্পমহলকে এই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহারের আমন্ত্রণ জানাই। আমরা বাকি পণ্যের কর-বাধা অপসারণে, আরও সীমান্ত হাট চালু এবং পণ্যের মানের সামঞ্জস্য বিধানের ক্ষেত্রে আপনাদের সরকারের সঙ্গে কাজ করছি।
১৪.
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্প্রতি স্বাক্ষরিত সংশোধিত ভ্রমণব্যবস্থার ফলে ভিসাব্যবস্থা সহজতর হবে। এর ফলে বিশেষ করে ব্যবসায়ী, ছাত্র, সাংবাদিক, ভ্রমণকারী এবং চিকিৎসার জন্য যেতে ইচ্ছুকদের সহায়তা হবে। আমাদের দুই দেশকে ঘনিষ্ঠতর করার সর্বোত্তম পন্থা হচ্ছে দুই দেশের মানুষের মধ্যে আরও যোগাযোগ ও আদান-প্রদান।
১৫.
বাংলাদেশ সরকারকে আমার সরকারের দেওয়া ঋণরেখা বাস্তবায়নে অগ্রগতি হচ্ছে জেনে আমি খুশি। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বিশেষ করে রেলওয়ে খাতে কাজ শুরু হয়ে গেছে। ঋণরেখায় কেনা দ্বিতল বাস রাস্তায় চলাচল করছে দেখে আমি খুশি হয়েছি। বাংলাদেশের রেলপথে শিগগিরই অনেক নতুন ভারতীয় ইঞ্জিন ও রেলশকট সন্নিবেশিত হবে। আমরা বাংলাদেশকে অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্প রূপায়ণের জন্য ২০ কোটি ডলার মঞ্জুরির প্রস্তাব করেছি। কয়েক সপ্তাহ আগে এই মঞ্জুরির পাঁচ কোটি ডলারের প্রথম কিস্তি হস্তান্তর করা হয়েছে।
১৬.
আমাদের দুই দেশ বিদ্যুৎ খাতেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। আমাদের স্বাধীনতা-পরবর্তী ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এ বছরের মাঝামাঝি আমাদের দুই দেশের বিদ্যুৎ গ্রিড সংযোগের মাধ্যমে ভারত থেকে বাংলাদেশে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সঞ্চালিত হবে। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে ‘ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী বিদ্যুৎ কোম্পানি’ মংলার কাছে রামপালে ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন একটি অত্যাধুনিক সুপার থার্মাল কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করছে।
১৭.
আমার সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে স্থলসীমানা চুক্তি এবং এর ২০১১-এর প্রটোকল কার্যকর করতে সংসদে সংবিধান সংশোধনের একটি বিল আনার প্রস্তাব করছে। সীমান্তে যাবতীয় দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা রোধে আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে প্রতিশ্র“তিবদ্ধ। সীমান্তকে শান্তি ও হিতকর সহযোগিতার প্রবেশপথ বানাতে আমাদের অবশ্যই একযোগে কাজ করতে হবে।
১৮.
অভিন্ন নদীর জলবণ্টন আমাদের কাছে একটি উচ্চ অগ্রাধিকারভিত্তিক বিষয়। অতীতে আমরা সাফল্যের সঙ্গে কয়েকটি চুক্তি করেছি এবং তিস্তার জল বণ্টনে আশা করি, তেমনি একটি চুক্তিতে আমরা শিগগিরই উপনীত হতে পারব।
১৯.
ইতিমধ্যে আমাদের যেসব ক্ষেত্রে সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে হবে, সেগুলো হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তি, দক্ষতা অর্জন, কৃষি গবেষণা, পরিবেশ সংরক্ষণ, জলবায়ু পরিবর্তন, সুন্দরবন রক্ষা এবং প্রচলিত ও উভয় উৎসের শক্তির সুরক্ষা ও নিয়ন্ত্রণ।
২০.
শিক্ষা খাতে আমাদের আরও অধিক বিনিয়োগ করতে হবে। আমাদের দুই দেশের মধ্যে অধিক হারে ছাত্র, অনুষদ, গবেষক ও শিক্ষক বিনিময় করতে হবে। আমরা বাংলাদেশের ছাত্র ও পেশাজীবীদের বিপুলসংখ্যক বৃত্তি দিয়ে থাকি। আরও অনেক ছাত্র নিজ খরচে ভারতে উচ্চশিক্ষা নিতে যান। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশন্স ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে টেগোর চেয়ার ও হিন্দি চেয়ার প্রবর্তন করেছে। এসব ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে অধিকতর শিক্ষাবিষয়ক যোগাযোগ ও মতবিনিময়ে উৎসাহ জোগাবে।
২১.
আমি গত বছর বাংলাদেশ থেকে প্রথমবারের মতো যাওয়া ১০০ জন যুবপ্রতিনিধির সঙ্গে রাষ্ট্রপতি ভবনে সাক্ষাৎ করে খুশি হয়েছিলাম। এঁদের অনেকেই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী। এ বছর অনুরূপ একটি প্রতিনিধিদল ভারত সফরে আসবে জেনে আমি আনন্দিত।
২২.
বিশ্বে এমন দেশ খুব কমই আছে যেখানে বাংলাদেশের মতো গান, কবিতা, শিল্পকলা ও নাটক জাতির বিবেক ও সচেতনতার সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত। আপনাদের কাছ থেকে আমাদের, ভারতের অনেক কিছু শেখার আছে। আমি এই সুযোগে জানাতে চাই যে, শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ক্যাম্পাসে ‘বাংলাদেশ ভবন’ নির্মাণের জন্য বাংলাদেশকে জমি প্রদান করেছে। বিশ্বভারতীর ‘বাংলাদেশ স্ট্যাডিজ প্রোগ্রাম’-এর গবেষণা ও তথ্য সংরক্ষণে ‘বাংলাদেশ ভবন’ কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কাজ করবে বলে আমার বিশ্বাস।
২৩.
আপনাদের দিকে তাকিয়ে আমি নিশ্চিত বুঝতে পারছি, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। আমি আপনাদের ভবিষ্যৎ জীবনের সাফল্য কামনা করি, যাতে আপনারা সোনার বাংলার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপায়িত করতে পারেন। আপনাদের দেশের ভাগ্য নির্মাণে ভারত আপনাদের পাশে থাকবে।
২৪.
এই কথা বলে আমি বিনম্র চিত্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টর অব লজ উপাধি গ্রহণ করছি।
২৫.
আজ আপনাদের মাঝে আমাকে আমন্ত্রণ জানানোর এবং কয়েকটি কথা বলার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে আবার ধন্যবাদ জানাই। এই সুযোগে আমি আপনাদের মাধ্যমে বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম জনগণকে ভারতের জনগণের শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করছি। ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী দীর্ঘজীবী হোক। ধন্যবাদ।’
২৬.
চলতি বছরের (২০১৮) জুনে ক্ষমতাসীন দল বিজেপির সহযোগী সংগঠন নাগপুরে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ বা আরএসএসের সম্মেলনে বক্তব্য দেন আদ্যন্ত একজন কংগ্রেসি প্রণব মুখোপাধ্যায়। পড়েন তীব্র সমালোচনার মুখে। ভারতীয় রাজনীতির অশীতিপর চাণক্য ‘বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান’–এর কথা বলেছিলেন। তুলে ধরেন দেশের ‘বহুত্ববাদী ও বৈচিত্র্যপূর্ণ’ চরিত্রের কথা। জোর দেন ‘সহিষ্ণুতার’ ওপর। স্মরণ করিয়ে দিলেন ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’-এর (গোটা বিশ্বই এক পরিবার) আদর্শ এবং সেই আলোয় ব্যাখ্যা করলেন ভারতীয় জাতীয়তাবাদের। এসব কথা তিনি আগে বহুবার বলেছেন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে বিদায়ী ভাষণেও বলেছেন। সেই সমালোচনার আলোকে ভারতীয় সাংবাদিক, আরম্ভ পত্রিকার সম্পাদক বাহারউদ্দিন লিখেছেন, প্রণববাবু, মাননীয় শ্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়, শুধু প্রাক্তন কংগ্রেস নেতা বা ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি নন। প্রজ্ঞা, জাতীয় ব্যক্তিত্ব আর প্রগাঢ় চিন্তার রাষ্ট্রদ্রষ্টা হিসেবে তাঁর অবস্থান, অবস্থানের উচ্চতা বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত। আদৃত। সামাজিক স্তরে, সব সময় নিজেকে ভাষিক—ধর্মীয়—দলীয় ক্ষুদ্রতার ঊর্ধ্বে রাখতে অভ্যস্ত তাঁর বীক্ষণ ও জীবনবোধ। ব্যক্তিক বিশ্বাসকে অন্যের ওপর চাপিয়ে দেবার মতো ভুল তাঁকে কখনো স্পর্শ করে না। ব্যক্তিগত পছন্দ আর সমাজের পছন্দের মধ্যে যে সীমারেখা অঙ্কনের নির্দেশ দেয় আধুনিক সমাজবিদ্যা আর দর্শন চর্চা, তাকে বরাবর গুরুত্ব দিয়েছেন এই বঙ্গসন্তান। ভারতীয় দর্শনে তর্কশীলতা, সহিষ্ণুতা আর বহুবাদিতার যে সমন্বয় আমরা দেখি, প্রণব বাবুর ভাবনায় তার চমত্কার আর নিরীহ আরোহন ও উত্তরণের নমুনা আমাদের বিস্মিত করে দেয়। নাগপুরে, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সদর দপ্তরে প্রণববাবু তাঁর বিশ্বাসের দৃঢ়তাকে, ঘোষিত ভাবাদর্শের অঙ্গীকারকে আরো মহিমান্বিত করে দিলেন। এখানে আদর্শিকি ক্ষয় আবিষ্কার করে যাঁরা উদ্বিগ্ন, তাঁরা নিজেদেরই ক্ষুদ্রতাকে, সংকীর্ণ মনোভাবকে বড় করে দিচ্ছেন। প্রণববাবুর প্রগাঢ় অভিব্যক্তি আর দার্শনিক অভিজ্ঞান আমাদের যেমন উদ্বুদ্ধ করেছে, ঠিক তেমনি এদের চিন্তার দারিদ্র্য, রাজনীতির ক্ষুদ্রতা শঙ্কিত করে তুলেছে। বিশ্বাসের ভিত যখন নড়বড়ে, সংশয়াচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, তখন অবক্ষয় সর্বগ্রাসী চেহারা নিয়ে পূজার বেদিতেও প্রস্তর নিক্ষেপ শুরু করে দেয়। স্বাস্থ্যময় মতভেদের নিঃসঙ্কোচ প্রকাশে, নিজের বিশ্বাস আর বোধির সুস্থিতি-স্থাপনে, প্রণববাবুর এ সংযত স্বঅর্জিত অভিব্যক্তি ইতিহাস হয়ে থাকে। বিরুদ্ধ মতামতের সুতিকাগারে দাঁড়িয়ে তিনি যেভাবে তাঁর আহরিত যুক্তি, বুদ্ধি ও বিদ্যার সাহায্যে—সহিষ্ণুতা ও বহুত্ববাদের শাশ্বত বাণীটি উচ্চারণ করেছেন তা আমাদের সামনে তাঁর পরিচিত ভাবমূর্তিকে আরো উজ্জ্বল, আরো উদ্ভাসিত করে দিলো। কী বললেন তিনি? প্রত্যয়িত ভাষায় জানিয়ে দিলেন—মতানৈক্য আছে, থাকতে পারে। কিন্তু এটি যেন মনান্তরের কারণ না হয়ে ওঠে। যেন অসহিষ্ণুতা আর পারস্পরিক বিচ্ছেদকে, অমিলনের বাহুবল আর অভিপ্রায়কে বিস্তৃত করার বিলকুল সুযোগ না পায়। আবু সয়ীদ আয়ুবের বিজ্ঞান, দর্শন আর রবীন্দ্রচর্চার সংযোগধর্মী অমূল্য সাধনাকেই প্রকারান্তরে নাগপুরে শুনিয়ে এলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। এখানেই তিনি আল কিন্দি আর পরম যুক্তিশীল বার্টান্ড রাসেলের নিখাদ অনুসারী। ভারতীয় সারস্বত আহ্বানেরও পরমাসক্ত, অতন্দ্র উপাসক।

(তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া, দৈনিক প্রথম আলো, দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকাসহ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক, ইন্টারনেট)

আবদুল্লাহ আল মোহন
১১ ডিসেম্বর, ২০১৫/ ১১ ডিসেম্বর, ২০১৬/ ১১ ডিসেম্বর, ২০১৮/ ১১ ডিসেম্বর, ২০১৯/৩১ আগস্ট. ২০২০

শেয়ার করতে এখানে চাপ দিন

সর্বশেষ খবর