ডা. শামীম হুসাইন
খবরটা বেশ পুরানো হয়ে গেছে। দেশের প্রায় সকল দৈনিকে ঘটনাটা এসেছিল। কোনো কোনো পত্রিকায় এ নিয়ে সম্পাদকীয় পর্যন্ত লেখা হয়েছিল। তবে অনেক দেরিতে চোখে পড়েছে বলে খবরটা আমার কাছে নতুন। কিন্তু ঘটনা হিসেবে এর আবেদন এবং গুরুত্ব অনেক বেশি। দেশের দূর্বল এবং অকার্যকর স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থার একেবারে ভিত্তিমূলে গিয়ে তা আঘাত করেছে। অন্তত: সরকারি একজন চিকিৎসক হিসেবে আমার তাই মনে হয়েছে।
মানুষের অন্যতম প্রধান একটি মৌলিক অধিকার হচ্ছে চিকিৎসা। রাষ্ট্রের কাছ থেকে মানুষ এ অধিকার পাবে। আমাদের পবিত্র সংবিধানেও তা বলা আছে। কিন্তু স্বাধীনতার এতবছর পরও মানুষের মৌলিক এই অধিকার নিশ্চিত হয়নি। চিকিৎসার জন্য মানুষ প্রতিবেশী রাষ্ট্রে যাচ্ছে। হিসেব অনুযায়ী বছরে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা চিকিৎসা করতে গিয়ে মানুষ বিদেশে রেখে আসছে।
কিন্তু মানুষ কেন চিকিৎসার জন্য বিদেশমূখী হচ্ছে? বিশেষত: স্বাধীনতার পর এই প্রবণতা দ্রুত বাড়ছে কেন? শ্রমসাধ্য আর ব্যয়বহুল জেনেও চিকিৎসার জন্য মানুষের মধ্যে দেশ ত্যাগের এই প্রবণতা জাতির জন্য কতটুকু মঙ্গল আর সম্মানজনক দেশের নীতি নির্ধারকবৃন্দ মুহূর্তের জন্যও কি কখনও তা ভেবে দেখেছেন?
আমার এক বন্ধু চিকিৎসার জন্য দেশান্তরের কারণ খুঁজতে অত্যন্ত ক্ষুদ্র পরিসরে একটি গবেষণা চালিয়েছিলেন। ডেজারটেশন আকারের উক্ত গবেষণাকর্মটি মহাখালীর নিপসম লাইব্রেরীতে আজও আছে। আমি প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে কিছু উপাত্ত দিয়ে তাকে সাহায্য করেছিলাম।
উক্ত গবেষনা কর্মে দেখানো হয়েছিল চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশিদের দেশান্তরি হবার পিছনে প্রধানত: তিনটি কারণ কাজ করে থাকে। প্রথমত: দেশে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাব। দ্বিতীয়ত: হাতে গোনা যে দু’চার জন বিশেষজ্ঞের সাইন বোর্ডে চিকিৎসা পেশায় আছেন তাদের চামার (গবেষণায় ব্যবহৃত প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ গ্রহণকারীবৃন্দ এ শব্দটিই ব্যবহার করেছেন) সুলভ আচরণ । তৃতীয়ত: দেশে চিকিৎসার অতিরিক্ত ব্যয়।
এসব বক্তব্যের পিছনে অকাট্য যুক্তিও ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে পাওয়া গেছে। হৃদরোগীদের কথাই ধরুন। চৌদ্দ কোটি লোকের এই দেশে ক’জন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ আছেন বা আজ পর্যন্ত তৈরি করা গেছে? যারা আছেন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ আর আমলারা নিজের প্রয়োজনেই তাদেরকে ঢাকায় পোস্টিং দিয়ে রাখেন। কারণ কখন কার হার্ট এ্যাটাক হয়! শেষে কি বিনা চিকিৎসায় মরতে হবে? আর তাই ধনাঢ্যদের পিছনে তাদেরকে বেশি ব্যস্ত থাকতে হয়। সাধারণ মানুষের জন্য তাদের সময় খুবই কম। মৃত প্রায় রোগিটিকে দেখার তারিখ নির্ধারিত হয় তিন মাস পর। বিরক্ত রোগীরা ঘরের চাল বেঁচে ভারতমূখি হয়।
খবরের সায়মাকেও তার মা বাবা কলিকাতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু ততদিনে তার জীবনীশক্তির সামান্যই অবশিষ্ট ছিল। বাংলাদেশের জনৈক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অস্ত্রপচারের সময় তার পেটের মধ্যে তোয়ালে রেখে দিয়েছিলেন। ফলে মেয়েটার নাড়ি-ভুরিতে অসম্ভব রকমের পচন ধরেছিল। ভারতে গিয়ে পূনরায় অস্ত্রপচার করা হলেও তাকে আর বাঁচানো যায়নি। সায়মার মা বাবা চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপিকা তাহমিনা বানুর বিরুদ্ধে ‘পেশাগত অদতা এবং অসততা’র অভিযোগ এনে মামলা করেছিলেন। আদালত উক্ত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে জেল হাজতে প্রেরণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তার কী হয়েছিল- পত্রিকার পাতায় তা আসেনি। তবে আইনী লড়াইয়ে তিনি ছাড়া পাবেন- এটাই স্বাভাবিক। অর্থ-বিত্তেরও কমতি নেই তার। অতএব বিশেষজ্ঞ পরিচয় আর সামাজিক অবস্থানের সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে তিনি সায়মার মা বাবাকে নিশ্চয়ই বশীভূত করবেন। মেয়ের সমাধিতে কেউই নিশ্চল পাথরের মত চিরদিন পড়ে থাকে না। সকল দুঃখ বেদনার কথাই মানুষের অবচেতন মন থেকে এক সময় হারিয়ে যায়। সায়মার মা বাবাও হয়তো বা অধ্যাপিকা তাহমিনা বানুকে মা করবেন। আদালতে মামলাটির নিস্পত্তি হয়ে যাবে।
কিন্তু হতভাগ্য জাতির জন্য সায়মারা আকাশ ছোঁয়া একটা প্রশ্ন রেখে যাচ্ছে এই যে, ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই দেশে স্বাধীনতার এতগুলো বছর পরও মানুষের চিকিৎসা নিশ্চিত হয়নি কেন? বিনা চিকিৎসায় মরে যাবার জন্যই কি তবে এদেশে তাদের জন্ম হয়েছিল। এসব প্রশ্নের সদুত্তর রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকদেরই খুঁজে বের করা প্রয়োজন ছিল। অবশ্য মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো তাদের ক্ষেত্রে সর্বদা পূরণ করা হয়। চিকিৎসার প্রয়োজনে তারা বিদেশেও যেতে পারেন। আর জরুরী প্রয়োজন মেটানোর জন্য দেশের প্রথিতযশা বিশেষজ্ঞদেরকে তারা ঢাকায় জড়ো করে রেখেছেন। সে জন্য তাদেরকে সামান্য অসুবিধারও মুখোমুখি হতে হয় না। আর তাই অবোধ জনগনের চিকিৎসা সংক্রান্ত কোন সমস্যা নিয়ে চিন্তার সামান্যতম অবকাশ তাদের নেই। কিন্তু একটা জাতির জন্য এ অবস্থা অত্যন্ত দূর্ভাগ্যের। চিকিৎসার মত মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে না পারার ব্যর্থতা একদিন তাদেরকে ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেই। কারণ কাজটা যে খুব বেশী কঠিন ছিল তা নয়। সামান্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা আর প্রতিশ্রুতি থাকলেও এদেশে মানুষের চিকিৎসা নিশ্চিত করা যায়।
স্বাধীনতা পূর্ব যুগেও এদেশে চিকিৎসার এ দৈন্য দশা ছিল না। তখন চিকিৎসার জন্য মানুষের দেশান্তরি হবার ঘটনা খুব কমই ঘটতো। আর ঘটলেও তা কালে ভদ্রে হত- পত্রিকার পাতায় ফলাও করে আসতো না। খুব ছোট একটা জেলা শহরের বাসিন্দা আমি। স্বাধীনতা পূর্ব যুগে আমি এখানে এম.আর. সি. পি চিকিৎসকের নিয়োগ পর্যন্ত দেখেছি। আমার স্পষ্ট মনে আছে, পাবনার সদর হাসপাতালে ডা. পি বি রায় নামের একজন এফ. আর. সি. এস চিকিৎসক ছিলেন। শত শত অস্ত্রপচার করে অগণিত মানুষের মুখে তিনি হাসি ফুটিয়ে রেখে গেছেন। তার কথা পুরানো দিনের লোকেরা আজও বলেন। তিনি ঢাকায় চলে গেলে আরও দু’চার জন বিশেষজ্ঞ এখানে এসেছেন। তাদের অবদানের কথাও মানুষের মনে আছে। কিন্তু স্বাধীনতার প্রায় পর থেকে অদ্যাবধি এখানে বিশেষজ্ঞের পদগুলো শূন্যই রয়েছে। এই দৈন্যদশা থেকে মুক্তিরও কোন প্রয়াস নেই। পাবনা দেশের বিচ্ছিন্ন কোন জনপদ নয়। এখানকার বর্তমান এই দুরাবস্থা মূলত: গোটা দেশেরই প্রতিচ্ছবি। কিন্তু স্বাধীনতার পূর্বে জেলার সদর হাসপাতালগুলোতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের নিয়োগ দান সম্ভব হলেও আজ সে পদগুলো শূন্য থাকছে কেন?
সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ে কি পরিসংখ্যান আছে- আমাদের তা জানা নেই। জনগন হিসেবে স্বাধীনতার সুফল আমরা ভোগ করতে চাই-চাই চিকিৎসার মত মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যা বাড়ানোর দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আজ পর্যন্ত কার্যকর কোন ব্যবস্থা বা পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। কারণ সরকার প্রধান, মন্ত্রীবর্গ বা আমলাবৃন্দ ভুক্তভোগী কোন পক্ষ নন। চিকিৎসার মত মৌলিক অধিকার তাদের জন্য নিশ্চিত করা আছে। আর তাই বিশেষজ্ঞ সৃষ্টির ক্ষেত্রে বা কাজে তাদের আদৌ কোন আগ্রহ নেই। একটি ফিডব্যাক প্রক্রিয়ায় দেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকবৃন্দও এ কাজে তাদেরকে নিরুৎসাহিত করে থাকেন। চিকিৎসা নামের একচেটিয়া বাণিজ্যে কোন প্রতিদ্বন্দ্বী বা অংশীদার সৃষ্টিতে আমাদের দেশের তথাকথিত বিশেষজ্ঞবৃন্দের চরম অনীহা অত্যন্ত স্পষ্ট। আর তাই সীমিত সংখ্যায় শুধুমাত্র লোক দেখানোর অসৎ উদ্দেশ্যে স্নাতকোত্তর প্রতিষ্ঠানসমূহে ছাত্রছাত্রী ভর্তি করা হয়। বছরের পর বছর অকারণে তাদেরকে আটকেও রাখা হয়। উদ্দেশ্য একটাই- প্রতিদ্বন্দ্বী বা অংশীদার সৃষ্টি করা যাবে না। কিন্তু এ ধরনের হীনমন্যতা বিশ্বের অন্য কোথাও আছে বলে আমাদের জানা নেই। কারণ পার্শ্ববর্তী ভারতেও গ্রামে গঞ্জে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এদেশ থেকে যারা চিকিৎসার জন্য ভারত যান- তারা মালদহ বা কূচবিহারের মত জেলা সদর থেকেও সুচিকিৎসা নিয়ে ফিরে আসেন যা আমাদের রাজধানীতেও অসম্ভব প্রায়। কিন্তু কেন এই বৈপরীত্য? এখানে বিশেষজ্ঞ সৃষ্টির কাজটি পদে পদে বাঁধাগ্রস্থ কেন? কারা এর জন্য দায়ী?
শিক্ষার সকল ধাপে মেধা যাচাইয়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ছাত্র ছাত্রীরাই সাধারনত: এম. বি. বি. এস. পড়তে আসে। এক সময় পাশও হয়। কিন্তু বিশেষজ্ঞ হতে চাইলেই বাঁধা। এ যেন একেবারে অন্নপাপ আর হরিজনের ব্রাহ্মণ হবার ষ্পর্ধা দেখানো। স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ভর্তির সুবিধাদি যুগের পর যুগ সীমিত রাখা হয়েছে। সৌভাগ্যক্রমে কেউ ভর্তি হলেও তার পাশের প্রক্রিয়া পদে পদে বাধাগ্রস্থ হয়ে আছে। সম্পূর্ণ অকারণে তাকে পৌন:পৌনিকভাবে ফেল করানো হয়। কিন্তু মেধা যাচাইয়ের সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ছাত্র ছাত্রীটি স্নাতকোত্তর কোর্সে এসে বারবার ফেল করবে- তা কোনো ক্রমেই যুক্তি গ্রাহ্য হতে পারে না। বিশ্বের কোথাও এ ধরনের পরীক্ষায় ফেলের এই আকাশ ছোঁয়া হার নেই।
আসলে বিশেষজ্ঞ নামের এক শ্রেণীর চিকিৎসক সিন্দাবাদের বুড়োটির মত হতভাগ্য এই জাতির ঘাড়ে চেপে বসেছেন। চিকিৎসার একচেটিয়া বাণিজ্যে তারা কাউকে প্রতিদ্বন্দী বা অংশীদার দেখতে চান না বলে দেশে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় বিশেষজ্ঞ তৈরির কাজটি বাঁধাগ্রস্থ হচ্ছে। সামাজিক অবস্থান আর অর্থ বিত্তে তারা এতবেশি শক্তিশালী যে দেশের নীতি নির্ধারকবৃন্দও তাদেরকে তোয়াজ করেন। কারণ তাদেরও তো অসুস্থ হবার ভয় আছে- ভয় আছে অস্ত্রপচারের পর পেটে তোয়ালে থেকে যাবার! তাই কেউই তাদেরকে নাড়াতে চান না। চাকরীর ক্ষেত্রে তাদের কোন বদলী নেই-একেবারে ‘নট নড়ন চড়ন অবস্থা’। তাদেরই অনিচ্ছায় দেশে বিশেষজ্ঞ তৈরি হচ্ছে না- কাটছে না স্বাস্থ্য সেবার দৈন্যদশা।
দেশের হাতে গোনা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর রাত পর্যন্ত চেম্বারে রোগী দেখছেন। তবুও কিন্তু রোগীর সংখ্যা কমছে না। এক একজন রোগীকে দু’এক মিনিটে দেখা হয়ে যায়। ভালোভাবে পরীক্ষাও করা হয় না। ফলে রোগীর অতৃপ্তি থাকে-রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ভ্রান্তির হার বাড়ে। ত্যক্ত বিরক্ত রোগী চিকিৎসার জন্য দেশান্তরী হয়।
তদুপড়ি রয়েছে রোগীদের প্রতি চিকিৎসকদের দুর্ব্যবহার। এ প্রসঙ্গে আমার ব্যক্তিগত একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। প্রয়াত এক প্রথিতযশা ইউরোলজিস্ট জনৈক রোগীকে অন্ততপক্ষে শতাধিকবার দেখেছেন। আমিও দু’একবার তার সঙ্গে দেখা করেছিলাম। কিন্তু চিকিৎসার ক্ষেত্রে কোন অগ্রগতি হচ্ছিল না। রোগীর বাম কিডনী আর ইউরেটার পাথরে ভর্তি। আর পাথরের চাপে সেগুলো বর্তমানে অকেজো হবার পথে। অথচ চিকিৎসক মহোদয় কোনদিনই তাকে অস্ত্রপচারের পরামর্শ দেননি। রোগী মাত্র একদিন শুধু ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌছে জিজ্ঞেস করলেন, স্যার আমার অসুখ কি ভালো হবে না? ক্রোধে উন্মত্ত চিকিৎসকের জবাব ছিল, এখানে আসেন কেন? মাজারে মাজারে ঘুরতে পারেন না? সেখানে গিয়ে বাবার দোয়া নিন। অসুখ ভালো হয়ে যেতে পারে। রোগীটি অবশ্য তার রোগ থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। লিথোট্রপসি পদ্ধতিতে তার সমস্ত পাথর বের করে আনা হয়েছিল। ভারত থেকে ফিরে তিনি একবার উক্ত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন । কিন্তু তিনি নিজেই তখন পরপারে।
এই হচ্ছে আমাদের দেশের বিশেষজ্ঞদের চিকিৎসক সুলভ আচরণ! একবারের জন্যও তিনি রোগীকে লিথোট্রপসির মাধ্যমে তার পেট থেকে পাথর বের করে আনার পরামর্শ দিতে পারতেন না? এতে আর কিছু না হোক রোগীর কষ্ট
অন্তত: কমতো। সত্যিই বড় বিচিত্র এই দেশ। সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য সমস্যাকে বিশেষজ্ঞ নামের এক শ্রেণীর চিকিৎসক বাণিজ্যের স্বার্থে ব্যবহার করছেন। তাদের অর্থ আর বিত্ত আকাশ ছুঁয়ে যাবার স্পর্ধা দেখাচ্ছে, অবাধ এই বাণিজ্য ক্ষেত্রে তারা কাউকে ভাগ বসাতে দিতে রাজি নন। আর তাই সুপরিকল্পিত উপায়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সংখ্যা বাড়তে দেয়া হচ্ছে না। কিন্তু জাতি সিন্দাবাদের এই বুড়োদের আর কতকাল বয়ে বেড়াবে? এবার অন্তত: তাদেরকে এ দায় থেকে মুক্তি দেয়া হোক। বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের সংখ্যা বৃদ্ধির কাজটিকে অবাধ করা হোক। যারা পাঁচ বছরের কঠিন অধ্যবসায়ের পর এম. বি. বি. এস. পাশ করেছেন-তাদের জন্য দু’তিন বছর মেয়াদী স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন কি খুবই কঠিন? একজন স্নাতক আর স্নাতকোত্তর ডিগ্রীধারীর মধ্যে তত্ত্বগত জ্ঞানের পার্থক্য কতটুকু – সে প্রশ্ন তুলবো না। কারণ পাঁচ-পাঁচটি বছরের অর্জনের সঙ্গে পরবর্তী দু’তিন বছরের অর্জনের পার্থক্য নিশ্চয়ই আকাশ পাতাল হয় না। তবে পেশাগত দক্ষতার পার্থক্য অবশ্যই আছে। কিন্তু সে পার্থক্য দূর করতে একজন ছাত্রকে বছরের পর বছর ফেল করানোর পিছনেও কোন যুক্তি থাকতে পারে না।
দীর্ঘ এই প্রবন্ধের শেষে এসে পুনরায় একটা সাম্প্রতিক খবরের উদ্ধৃতি দিতে চাই। নাটোরের মেয়ে আঞ্জুয়ারার পেটে অস্ত্র পাচারের পর ফরসেপ রেখে দেয়া হয়েছিল। দীর্ঘ চার বছর ধরে সে স্ত্রীরোগ বিশেয়জ্ঞ ডা. এস কে রায়ের অপকীর্তি আপন শরীরে ধারণ করেছিল। ক’দিন আগে তার পেটে অস্ত্র পাচার করে ফরসেপটি সরানো হয়েছে। তোয়ালে আর ফরসেপের পর যে জুতা স্যান্ডেল কিংবা চশমার মত জিনিস পত্রও তালিকাভুক্ত হবে না বলা যায় না।
এবার একটা ব্যক্তিগত প্রসঙ্গের অবতারনা করবো। আমি একজন সরকারি চিকিৎসক। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে এম, বি. বি. এস. পর্যন্ত অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে পাশ করে এসেছি। বড় আশায় বিশেষজ্ঞ হবার প্রত্যাশা নিয়ে এম. এস কোর্সে ভর্তি হয়েছিলাম। কিন্তু পাঁচ পাঁচবার পরীক্ষা দিয়েও প্রথম পার্টের বেড়াজাল অতিক্রম করতে পারছি না। গতবার সিসটেসোমিয়াসিস সংক্রান্ত একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনি বলে তাহমিনা ম্যাডাম আমাকে আটকে দিয়েছিলেন। বাংলাদেশে উক্ত রোগ কোনদিন ছিল না-এখনও নেই। বর্তমানের এই বিশ্বায়নে ভবিষ্যতে রোগটি এদেশে আসবে না-তা বলা যায় না। অতএব একজন বিশেষজ্ঞ হতে গেলে আমাকে সে সম্বন্ধে জানতে হবে। তাই কোন দুঃখবোধ আমার নেই।
এবার পুনরায় পরীক্ষায় উপস্থিত হবো প্রত্যাশা আছে। তাহমিনা ম্যাডাম হয়তো বা ততদিনে জেল হাজত থেকে মুক্তি পাবেন। আমার ভাইভা বোর্ডে তিনি থাকবেন অসম্ভব নয়। এবার কি আমাকে স্লিপিং সিকনেস এর মত বিদেশী কোন রোগ সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করে বিড়ম্বনায় ফেলবেন। স্নাতকোত্তর কোর্সের জন্য প্রশ্নটি কতটুকু যথার্থ-অন্তত: আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে, সে প্রসঙ্গে আমি যাবো না। তবে একটা প্রতিশ্রুতি অন্তত: আমি দেব। আর তা হল অস্ত্র পাচারের পর তোয়ালে বা ফরসেপ রেখে রোগীর পেট সেলাই করবো না। তাহলে কি আমার পাশ হবে? (পুরোনো লেখা)
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রাজশাহী।