নিজস্ব প্রতিবেদক : পাবনা জেলার দক্ষিণ-পূর্ব কোণের পদ্মার পলি বিধৌত বিস্তৃর্ণ চরাঞ্চলে প্রায় অর্ধ লক্ষ জনগণের বসবাস। সন্ত্রাস, অশিক্ষা, দূর্গম ইত্যাদি নানা রকম প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও প্রবল প্রচেষ্টায় সভ্যতার বিকির্ণ আলোয় এরা উদ্ভাসিত হতে যাচ্ছে। এই শক্তিশালী প্রচেষ্টার পেছনে ভূমিকা কেবল কৃষিজমি ও কৃষকের। প্রকৃতির অপার ঐশ্বর্যে ভরপুর করে দিয়েছে এক সময়ের নদী-নির্ভর জনগোষ্ঠির জীবন। প্রাথমিক শিক্ষার গণ্ডি পেরিয়ে এই জনপদের সন্তানেরা অতি কষ্টে দূর-দূরান্তের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হতে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষাগ্রহণে সফল হয়েছে। একই সঙ্গে অনেকেই পৌঁছে গেছে উচ্চ শিক্ষার দরবারে। যারা খুব দূর থেকে দেখেন- এই বিস্তৃর্ণ চরাঞ্চল তারা হয়তো এই সত্যটি উপলব্ধি করতে পারবেন না। কেননা এই জনপদ প্রায় সকল সময়ই অন্য কোনো অঞ্চলের ভিন্ন ভিন্ন কোনো মানুষের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বা শাসিত হয়েছে। বিগত দশকে যোগাযোগ ও অবকাঠামোর উন্নতি হলেও প্রশাসনিক কিংবা রাষ্ট্রীয় সুবিধা ও সংস্কৃতির বিকাশে কোনো দিক দিয়েই তৎপরতা চোখে পড়বার মতো নয়। তবুও কৃষকের অক্লান্ত পরিশ্রমে-ত্যাগে তাদের যাপিত জীবনে পরিবর্তন হচ্ছে ইতিবাচক গতিতে।
কিন্তু ভাঙন আর সন্ত্রাসের মতো সর্বগ্রাসী প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠতে গিয়ে হঠাৎ এই কৃষকদের জীবনে নেমে এসেছে অন্ধকার। যদিও অন্ধকারের এই প্রতিভূরা বলছেন, এদের জীবনকে আলোয় আলোয় ভরিয়ে তোলার জন্যই এই চেষ্টা। কৃষকরা সেকথা মানতে নারাজ। তারা বলছেন, যে ভূমিতে তাদের অন্তত ৩৫ বছরের বাস, বাগান ও অন্নের জোগান সেই মাতৃ-স্বরুপা ভূমিতে কেন সৌর বিদ্যুৎ প্লান্ট? তারা বলছেন, পাবনা জেলার শেষপ্রান্তে সুজানগর উপজেলার সাগরকান্দি ইউনিয়নের রামকান্তপুর মৌজার প্রায় ৯০০ বিঘা জমিই তাদের সহায় ও সম্বল। এই জমিতে ধান, পাট, গম, ভুট্টা, শিম, বেগুন, কফি, উস্তে, পটল, টমোটো, কালাই উৎপাদন করে, গরু-ছাগল-মহিষ চড়িয়ে চলে জীবন ও জীবিকা। তাদের আনন্দ ও উৎসবের কেন্দ্র-বিন্দু এই জমি। তারা জানাচ্ছেন, এই মৌজার মধ্যে ১৩০টি বসতবাড়ি, ১টা মসজিদ, ২০-২৫টি বাগান আর আনুমানিক ২০০টি গভীর নলকূপ রয়েছে। একই জমিতে আউশ, আমন চাষের পাশাপাশি দীর্ঘ ২০ বছর যাবৎ চলছে গভীর নলকূপের সাহায্যে ইরিধানের আবাদ। কৃষকেরা এও জানাচ্ছেন যে, তিন মওসুমে তারা এই সব চাষাবাদ করে থাকেন।
খোঁজ করতে নেমে জানা যায়, পদ্মার বুক থেকে ১৯৭৭ সাল নাগাদ এই চরের জন্ম ও বেড়ে ওঠা। সেই হিসেবে প্রায় ৪৩ বছরের এই চরে জনবসতি অন্তত ৩৫ বছর ধরে বিস্তৃত ও সমৃদ্ধ হয়েছে। এই বিশাল ব্যাপৃত সময়ের ইতিহাস না টেনে আমরা খোঁজ করি কেন কৃষকের চোখে এখন কালির চিহ্ন। জানতে পারা যায়, ২০১৯ সালের কোনো এক সময় কৃষকদের নিকট সরকারি কর্তৃপক্ষের লোকজন এসে জানায়, ভূমি জরিপের কাজ হবে- যার যার জমি তার তার নামে রেকর্ড করিয়ে নিতে হবে। এই সংবাদ বাদে কৃষকের দৌড়-ঝাঁপ শুরু হয়। ঘাটে ঘাটে ঢালতে থাকেন অর্থ-কড়ি। কিন্তু ফল হলো ‘আমও গেল, ছালাও গেল’ ধরণের। ২০২০ সালে এসে কৃষক দেখতে পেল ২০১৮ সালেই সংশ্লিষ্ট দিয়ারা সেটেলমেন্ট অফিস পাবনা জেলা প্রশাসক বরাবর খাস-ভূমি হিসেবে রেকর্ড লিপিবদ্ধ করে দিয়েছে তাদের স্বপ্নের সোনালি ভূমি। যেই জমির শ্রেণি বেহগুদা বদলে দিয়ে ডাঙ্গা, পতিত, ছনখোলা, বালুচর, ডোবা ইত্যাদি হিসেবে দেখানো হয়েছে। অথচ কৃষক জানাচ্ছেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের লোক ২০১৯ সালে সরেজমিন এসে তাদের সাথে নিয়ে ঘুরে ঘুরে কৃষিজমি দেখে কৃষকদের নামেই দেওয়া হচ্ছে- মর্মে জানিয়ে গেছেন। তদুপরি দুর্দশায় হতাশ কৃষককূল পাবনা জেলা প্রশাসককে কৃষকের জমি কৃষকের নামে রেকর্ড করার আর্জি জানায়। এই বাতুলতাই শেষ নয়, এই ঘোরাঘুরির মধ্যে হঠাৎ একটা সৌর বিদ্যুৎ কোম্পানি কৃষকের ক্ষতি পূরণ দিয়ে জমি নিতে পারেন- এই মর্মে সংবাদ ভাসতে থাকলেও কৃষকেরা তাতে নিমরাজি বরাবরই। চলতে চলতে সেই আলাপ খাঁদের কিনারে এসে গেল, যখন জানা হলো ২০১৯ সালেই কৃষকের জমি পাবনার তৎকালীন জেলা প্রশাসক নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড-এর নামে ৩০ বছরের লীজ দিয়ে দিয়েছেন।
হতাশ কৃষকেরা এরপর কোম্পানির পক্ষে ঠিকাদার ও মিস্ত্রী সীমানা প্রাচীর নির্মাণে এলে বিভিন্ন সময় বাঁধা দিতে থাকেন, ছুটতে থাকেন নেতা-নেতৃ, পুলিশ ও জেলা প্রশাসকের দফতরে। এরপর একে একে কৃষকের ঘাড়ে জমা হয় দুটি অন্যায্য ফৌজদারি মামলা। তখন নিরূপায় কৃষক বিজ্ঞ হিতৈষীজনের পরামর্শে বাধ্য হয়ে ছুটে যায় হাইকোর্টের নিকট। সেখানে প্রাথমিকভাবে ৫৮ জন কৃষক একটি রিট পিটিশন দাখিল করলে কোর্ট সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উপর একটি রুল জারি করে। সেখানে পাবনার জেলা প্রশাসককে হাইকোর্টের রুল জারির দিন থেকে ৬০ দিনের মধ্যে কৃষকের নামে জমি রেকর্ড সংক্রান্ত আবেদনের আইনি সুরাহার নির্দেশ রয়েছে।
এই পথ-পরিক্রমায় এ প্রতিনিধি অনুসন্ধান কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন। জানতে ও বুঝতে চেষ্টা করছেন কৃষক ও কোম্পানির সুবিধা-অসুবিধা এবং বিবাদ। অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে ২৬ জানুয়ারি বুধবার সরেজিমন গিয়ে দেখা যায়, রামকান্তপুর মৌজার প্রায় ৯০০ বিঘার জমির মধ্যে কোম্পানি দখলকৃত প্রায় ৬১৫ বিঘা জমির বিভিন্ন স্থানে কাঁটাতারের বেষ্টনী নির্মিত হয়েছে। সেই কাঁটাতারের বেড়া কোনো কোনো কৃষকের বাড়ির উঠান দিয়ে আবার কোনো কোনো কৃষকের রান্নার চুলার উপর দিয়ে অতিক্রম করে গেছে। এ যেন আরেক সীমান্ত নির্মাণ করা হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের ভূ-সীমায়।
কোম্পানী কর্তৃক মামলার আসামী সেলিনা বেগম নামের এক কৃষক জানান, তাদের বাড়ির চুলার উপর দিয়ে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের জন্য কোম্পানীর মিস্ত্রীরা যায়, তাতে বাঁধা দিলে কোম্পানীর ইঞ্জিনিয়ার অকথ্য, অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করে। তখনই আরেক কৃষক এগিয়ে আসেন, তিনি জানান, বাড়ি ও চাষের জমি জোর করে নিয়ে যাচ্ছে আবার গালাগালিও করে, এইজন্য ইঞ্জিনিয়ারের কলার চেপে ধরেছিলাম। অপর কৃষক সেলিনার পরিবারের তিন বিঘা জমি চাষাবাদে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বৃদ্ধা মা, কিশোর ভাই আর ছোটবোন। সেলিনা বিবাহিতা। ঘটনার দিন তিনি শ্বশুড়বাড়িতে ছিলেন; তবুও হয়েছেন মামলার আসামী।
দুলাল মণ্ডল, জলিল সরদার, রোকন বিশ্বাস, আতাই মৃধ