Monday, ডিসেম্বর ১১, ২০২৩
শিরোনাম
ডলি সায়ন্তনীকে নির্বাচনে চান পাবনার সংস্কৃতিকর্মীরাওনার্স পরিচয় দেন ডাক্তার, দিচ্ছেন সর্ব রোগের চিকিৎসাডলি সায়ন্তনীর প্রার্থীতা ফেরার অপেক্ষায় সুজানগর, আমিনপুরের মানুষঅবহেলা অব্যবস্থাপনায় অকার্যকর পাবনার সেচ উন্নয়ন প্রকল্প, বিপাকে কৃষকসাঁথিয়ায় ভোটার হালনাগাদকারীদের পাওনা দিতে গরিমসি করছেন নির্বাচন অফিসারআটঘরিয়ায় গলায় ফাঁস দিয়ে গৃহবধূর আত্মহত্যা, স্বামী আটকসাঁথিয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রবেশ পথে মন্দির নির্মাণ করার চেষ্টা ॥ জনমনে অসন্তোষসাঁথিয়ায় চলাচলের রাস্তায় বেড়া,অবরুদ্ধ ১৬ পরিবারআটঘরিয়ায় বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট উদ্বোধনবেড়ায় পাট ক্ষেত থেকে ভ্যান চালকের লাশ উদ্ধার

অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ‘সংগঠন ও বাঙালি’

শেয়ার করতে এখানে চাপ দিন

বাঙালির সংগঠন দর্শনের নির্যাস গ্রন্থ


আবদুল্লাহ আল মোহন


১.
নানা বিশেষণে সুখ্যাত একজন সফল সংগঠক, শিক্ষক, উপস্থাপক অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। এদেশে ও বিদেশেও আলোকিত মানুষ গড়ার সংগঠন ‘বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে’র প্রতিষ্ঠাতা সায়ীদ স্যারের সাংগঠনিক সুখ-দুঃখ, বেদনার নানা নির্মম অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা, এক অর্থে সংগঠনচিন্তার ক্ষেত্রে মহাগ্রন্থ হয়ে ওঠা ‘সংগঠন ও বাঙালি’র প্রতিটি লাইন খুব বেশি সমকালীন, প্রাসঙ্গিক এবং নতুন চিন্তার উৎসস্থল। বইয়ের লেখক সায়ীদ স্যারের সাথে কাজ করার সুযোগে খুব কাছ থেকে চেনা-জানার কারণে একজন সংগঠকের দার্শনিক চিন্তার নির্যাস বলেই প্রতীয়মান হয়েছে আমার কাছে।
২.
বইটি লেখার কারণ হিসেবে ভুমিকায় বলছেন সায়ীদ স্যার, ‘সংগঠন আমাদের জীবনে একটা নতুন জিনিস। এ নিয়ে আজ ব্যাপক ও শ্রমসাধ্যভাবে এ জাতিকে ভাবতে হবে। খুব অস্ফুট, অসম্পূর্ণ ও অযোগ্যভাবে আমি, হয়তো প্রথমবারের মতো এই ছোট্ট বইটির মাধ্যমে এ ব্যপারে কিছুটা ভাবনা তুলে ধরলাম।’ ‘কী কী কারণে আমরা সংগঠন গড়ে তুলতে পারছি না, এর ঐতিহাসিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, মনস্তাত্ত্বিক, ভৌগলিক ও শরীরিক কারণগুলো কী কী- এসব বিষয় আমি সাদা চোখে দেখে বুঝেছি, তা এই বইয়ে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি।’
৩.
আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর, এদেশের আনন্দ শিক্ষার সচকিত প্রাঙ্গণ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা, জনপ্রিয় শিক্ষক অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের জীবনটাই ব্যয় হলো সংগঠন নির্মান ও সম্প্রসারণে। শিক্ষার মাধ্যমে আলোয় ভূবন গড়তে, আলোয় ভূবন ভরতে সায়ীদ স্যার আজও আমাদের মাঝে সদা সক্রিয়, তারুণ্যসম সজীব, দারুন প্রাণবন্ত। তাঁর সাংগঠনিক স্বপ্ন, বাস্তবতা, সুখ-দুঃখ, ব্যথা-বেদনার অজস্র নির্মম অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা ‘সংগঠন ও বাঙালি’ যেন এক অর্থে সংগঠনকর্মীদের জন্য মহাগ্রন্থই হয়ে ওঠে। আগুণের পরশমনি ছোঁয়ানোর মহান ব্রত নিয়ে তিনি যে কর্মযজ্ঞে মাঠে নেমেছিলেন, সেই অভিজ্ঞতারই নির্যাস বইটি। কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠা ও সম্প্রসারণ করতে গিয়ে অবিরাম অপমান, ব্যথা সহ্য করতে হয়েছে স্যারকে।
৪.
স্বাধীনতা পরবর্তীকালে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার নিচু মান ও এর অর্থহীনতায় হতাশাগ্রস্ত হয়ে সায়ীদ স্যার সংগঠনের ভাষায় এই সংকটের উত্তর দেবার চেষ্টা করেছিলেন। আমাদের আলোহীন, বিচ্ছুরণহীন ও অকর্ষিত শিক্ষা ব্যবস্থার অন্ধকারে সুপ্ত ও সম্ভাবনাময় শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। আলোকের ঝরণা ধারায় কঁচি প্রাণ, অসীম সম্ভাবনাকে জাগিয়ে দিতে, ভরিয়ে দিতে, তাদের ভেতরকার কলুষতাকে ধুইয়ে দিতে চেয়েছেন স্যার। আর তাই পুরোপুরি অর্থহীন, শুধুমাত্র বেতনভোগী একজন শিক্ষক হিসেবে ব্যর্থ জীবন কাটাতে চাননি বলেই এই নিঃস্ব পরিবেশের ভেতর বাস করে একটা সৃজনশীল , কল্পনাসমৃদ্ধ অনাবিল আনন্দভুবনে আমাদের ছেলেমেয়েদের গড়ে তোলার, সুপ্ত প্রতিভাকে বিকশিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
৫.
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মতো সংগঠনের জন্ম দিতে গিয়ে নানাভাবে দুঃখ পেয়ে স্যার লিখছেন ‘দেশজোড়া এত অসহায় অপারগ মানুষ নিয়ে কী করে শক্তিশালী সংগঠন আমরা গড়ে তুলব এদেশে ? কী করে গড়ে উঠবে সুসংহত রাষ্ট্র ? কী করে পৃথিবীর সঙ্গে আমরা প্রতিযোগিতা করব ?’ (পৃ-৩২)। তাইতো, দেশজোড়া এত অসহায় অপারগ আর নিম্নমানের মানুষ নিয়ে কী করে শক্তিশালী সংগঠন আমরা গড়ে তুলব এদেশে ? কী করে গড়ে উঠবে আমাদের স্বপ্নের একটি সুসংহত রাষ্ট্র ? আত্মঘাতী বাঙালিকে কে রুখবে ?
৬.
বাঙালির সাংগঠনিক দুর্বলতার আলোচনায় তিনি বলছেন তাঁর শিক্ষকতা জীবনের অভিজ্ঞতার কথা । শিক্ষাক্ষেত্রসহ সর্বক্ষেত্রের বিপর্যয়ের কারণ খুঁজতে গিয়ে আবিস্কার করেন এ হচ্ছে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আমাদের প্রতিটি স্তরে যে দস্যুতা, লুন্ঠন প্রক্রিয়া শুরু হয় তারই প্রভাবমাত্র। একারণে আজ শিক্ষাক্ষেত্রসহ সর্বত্র বিপর্যয়। সায়ীদ স্যার দেখেছেন সর্বত্র লুন্ঠনকারীদের, লিখেছেন ‘এই লুন্ঠনকারীর চরিত্র আজ কেবল জাতির প্রধান দস্যুদের ব্যাপারে প্রযোজ্য নয়। প্রতিটি মানুষই আজ এরকম। এই লুন্ঠনকারীর চরিত্র প্রতিটি দেশবাসীর ভেতর ছড়িয়ে গেছে। আজ দেশের প্রায় প্রতিটি মানুষ মাস্তান; যে যার জায়গায়। লুন্ঠন আর এই জাতি আজ প্রায় সমার্থক’ (পৃ-১৬)।
৭.
সায়ীদ স্যার বেদনা নিয়ে আরো লিখেছেন ‘সারা জাতির প্রতিটি জায়গায় আজ যা হচ্ছে তা তো লুন্ঠন- যার অন্য নাম আত্মঘাত- যুথবদ্ধ মানুষের কল্যাণের ওপর ব্যক্তিস্বার্থের আক্রমণ। ন্যায় ও সংঘশক্তির সার্বভৌমত্বের ওপর আত্মপরায়ণ মানুষের সর্বাত্মক সন্ত্রাস’ (পৃ-১৯)। সায়ীদ স্যার বাঙালির সাংগঠনিক দূর্বলতার যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কারণের কথা লিখেছেন – তার মধ্যে রয়েছে : আত্মপরতা, ব্যক্তিগত অসহায়তা, অক্ষমতা, হীনমন্যতা ও আত্মঘাত। আর মৌলিক কারণ হিসেবে স্বাস্থ্যগত দুর্বলতাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন।
৮.
আমাদের সাংগঠনিক দুর্বলতার মূল কথাটি সায়ীদ স্যার সংক্ষিপ্ত কিন্ত অত্যন্ত স্পষ্ট করে লিখেছেন ‘নিজের স্বার্থের জন্য আমরা করতে পারি না এমন কিছুই নেই। এ ব্যাপারে আমরা প্রায় নিশ্চক্ষু ও নির্বিকার’ (পৃ-১৮)। স্যার আরো লিখছেন, ‘অক্ষম মানুষ সাধারণত ব্যর্থ হয়, ব্যর্থ মানুষ হয় পরশ্রীকাতর। পরশ্রীকাতরতা তাই আমাদের জীবনের সার্বভৌম অধীশ্বর। অক্ষমতার কারণে আমরা এমন নেতিবাচক। আমরা যে পরিমানে নিষ্ফল, সেই পরিমাণেই নিন্দুক। নিন্দার ভেতর দিয়ে নিজেদের অক্ষমতার প্রায়শ্চিত্ত খুঁজি’ (পৃ-৪৪) । এদেশের মানুষের মধ্যে আত্মবিনাশী, আত্মবিধ্বংসী এই প্রবণতা আজও বাঙালি সমাজে চরম মাত্রায় বিদ্যমান ও ক্রমবিকাশশীল। তা না হলে কী কম দুঃখে রবীন্দ্রনাথকে লিখতে হয় ‘সাতকোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করোনি।’ সায়ীদ স্যার এর ব্যাখা দিয়েছেন এভাবে ‘কথাটার মানে একটাই : বাঙালি আজও মানবপদবাচ্য নয়। শক্তিতে নয় বলে মহত্ত্ব বা মর্যাদাতেও নয়’ (পৃ-১৭)।
৯.
ভুমিকায় সায়ীদ স্যার যথার্থই লিখছেন, ‘একটা জাতির সংগঠনগুলো যত শক্তিশালী, সেই জাতি তত শক্তিশালী। আমাদের এই সংগঠনের জগৎটা খুবই দুর্বল। এটাই জাতি হিসেবে আমাদের দুর্বলতার মূল কারণ। জাতিগতভাবে সমর্থ হয়ে উঠতে হলে এই দুর্বলতা আমাদের কাটিয়ে উঠতেই হবে।’ ‘আমাদের জাতির অধিকাংশ মানুষের ব্যক্তিগত যোগ্যতার অভাবও একে আরও প্রকট করে তুলেছে।’ সেইসাথে ‘অজস্র দক্ষ সংগঠন গড়ে তোলার ভেতর দিয়ে জাতীয় ভাগ্যকে আজ আমাদের সুদৃঢ় করতে হবে।’ আমরাও সেটাই চাই। আমাদের সংগঠনগুলো সুস্থভাবে বিকশিত হোক তার উদ্দেশ্য সাধনে।
১০.
সায়ীদ স্যার ‘সংগঠন ও বাঙালি’ বইটিতে আমাদের আমাদের সাংগঠনিক ব্যর্থতার মৌলিক কারণ : স্বাস্থ্যগত দুর্বলতা নিয়ে চমৎকার বিশ্লেষণী আলোচনা করেছেন। আবার সাংগঠনিক প্রেক্ষাপটে আমাদের সরকার পদ্ধতির রূপরেখা, সংসদীয় বনাম রাষ্ট্রপতিকেন্দ্রিক গণতন্ত্র নিয়েও অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত কিন্ত মৌলিক প্রশ্নগুলো তুলে ধরেছেন। এক্ষেত্রে সাংগঠনিক সাফল্যের স্বার্থে স্বৈরাচারী গণতন্ত্রের চেয়ে সায়ীদ স্যার একনায়কতন্ত্রের প্রতি তাঁর দুর্বলতার কথা তুলে ধরতে দ্বিধা করেননি। লিখেছেন, ‘আমরা স্বপ্ন দেখি গণতন্ত্রের, কিন্ত স্বস্তি বোধ করি একনায়কতন্ত্রে’ (পৃ-৭২)।
১১.
‘সংগঠন ও বাঙালি’ বাঙালির সংগঠন প্রেম ও বিরহের, উদ্যোগ ও ব্যর্থতার সুলিখিত দলিল। বইটিতে বাঙালিকে, তার বহুমুখী বৈচিত্রময় চরিত্রকে চেনা যায়। অত্যন্ত প্রাণবন্ত ও সরস ভাষায় সায়ীদ স্যার বাঙালি চরিত্রের নানাদিকগুলো চিত্রময় করে ফুটিয়ে তুলেছেন। আমরা জানি ‘বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে’র কর্মকান্ড আরো বেড়েছে । সেই সব সর্বশেষ অভিজ্ঞতা, চিন্তা নিয়ে আরো সবিস্তারে বইটির নতুন সংস্করণ প্রকাশের দাবি রইল স্যারের কাছে। বইটি পাঠশেষে বিভিন্ন আলোচনায় সায়ীদ স্যারের বলা একটি কথাই কেবল মনে হয়- কোন সংগঠকের জন্য আসলে ‘কোন সময়ই সুসময় নয়’।
১২.
সংগঠন ও বাঙালি : অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
দিব্য প্রকাশ, ঢাকা, দ্বিতীয় মুদ্রণ: জুলাই ২০০৬
প্রচ্ছদ : কাইয়ুম চৌধুরী, মূল্য : ১০০ টাকা
বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানকে ।

আবদুল্লাহ আল মোহন
১১ এপ্রিল, ২০২০

শেয়ার করতে এখানে চাপ দিন

সর্বশেষ খবর