আবদুল্লাহ আল মোহন
১.
চিকিৎসক, সাহিত্যিক, নাট্য রচয়িতা, শিল্পী, বাগানিয়া- নানা পরিচয়ে ধরা যায় তাঁকে। আবার কোনও এক পরিচয়ে তাঁকে ধরা যায়ও না। তিনি কর্মপ্রাণ বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়। যিনি বনফুল ছদ্মনামেই সমধিক সুপরিচিত। কথাশিল্পী সতীনাথ ভাদুড়ীর ভাষ্যমতে, মানুষ যেভাবে নি:শ্বাস নেয়, বনফুল তেমনিভাবে লেখেন। বনফুল রচনা করেছেন ছয় শতাধিক ছোটগল্প। সংক্ষিপ্ত অবয়বে ছোটগল্পকে সমৃদ্ধ করেছেন বনফুল। বাঙালির অতি নিকটজন এই ‘বনফুল’-এর ছোটগল্প সৃষ্টির পথটি কেমন, কী ভাবেই বা হেঁটেছেন ছোটগল্পের রাজপথে, সন্ধানের চেষ্টা করেছেন সোহানা বিলকিস (Sohana Sohely)। বাংলা ছোটগল্পের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী, জনপ্রিয় কথাশিল্পী বনফুলের প্রায় প্রতিটি ছোটগল্পের সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ করা হয়েছে। গবেষকের বিবেচনায়, ‘নিজ শিল্পকৌশলে বনফুলের ছোটগল্প স্বমহিমায় হয়েছে উজ্জ্বল’। ফলে অন্তর্নিহিত শক্তি, আলো-আঁধারকে দেখার দারুণ প্রয়াস, বইটির পাঠককে মুগ্ধ না করে পারে না। অশেষ ধন্যবাদ আন্তরিক কৃতজ্ঞতা বনফুল গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সোহানা বিলকিসকে। সোহানা বিলকিস-এর ‘বনফুলের ছোটগল্প: একটি নিমেষ ও বহতা জীবন’ স্নাতকোত্তর শ্রেণীতে অভিসন্দর্ভের গ্রন্থরূপ। বইয়ের শুরুতেই সোহানা বিলকিস যথার্থই বলেছেন, ‘তাঁর নির্মিত অভিনব আঙ্গিকের অতি ক্ষুদ্র, বিচিত্র রসাত্মক গল্প পড়ে বিস্মিত, শিহরিত, মন্ত্রমুগ্ধ এবং ক্রমশ কৌতুহলী হয়েই স্নাতকোত্তর শ্রেণীতে অভিসন্দর্ভের বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম বনফুলের ছোটগল্পকে। আর এ গবেষণার সুবাদেই আবিস্কার করলাম বনফুলের শৈল্পিক সাহিত্যভুবন।’
২.
ব্যতিক্রমধর্মী গল্পের অমর স্রষ্টার অনন্য নাম বনফুল। একজন অনন্য বাঙালি কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার ও কবি বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় (জন্ম: ১৯ জুলাই, ১৮৯৯ – মৃত্যু: ৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৯)। অবিভক্ত ভারতবর্ষের বিহার রাজ্যের মনিহারী গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। উল্লেখ্য, এই পূর্ণিয়াই বাংলা সাহিত্যকে দিয়েছে আর এক নক্ষত্র, অমর কথাশিল্পী সতীনাথ ভাদুড়ীকে। বনফুলদের পূর্বপুরুষদের আদি নিবাস ছিল হুগলি জেলার শিয়ালখালায়। পিতা সত্যচরণ মুখোপাধ্যায় ছিলেন পূর্ণিয়া জেলার মণিহারী ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড হাসপাতালের ডাক্তার। মাতার নাম মৃণালিনী দেবী। বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় কৈশোর থেকেই লেখালেখি শুরু করেন। শিক্ষকদের কাছ থেকে নিজের নাম লুকোতে তিনি বনফুল ছদ্মনামের আশ্রয় নেন। ১৯১৫ সালে সাহেবগঞ্জ স্কুলে পড়ার সময় মালঞ্চ পত্রিকায় একটি কবিতা প্রকাশের মধ্য দিয়ে তার সাহিত্যিক জীবনের সূচনা হয়। পরে প্রবাসী, ভারতী এবং সমসাময়িক অন্যান্য পত্রিকায় ছোটগল্প প্রকাশ করেন। বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় পূর্ণিয়ার সাহেবগঞ্জ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক (১৯১৮) এবং হাজারিবাগের সেন্ট কলম্বাস কলেজ থেকে আইএসসি (১৯২০) পাশ করেন। একই বছরে তিনি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন। তবে তিনি যখন ষষ্ঠ বার্ষিক শ্রেণিতে পড়েন, তখন বিহারের পাটনায় মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। বিহার থেকে আসা ছাত্র হিসেবে তিনি এ নব প্রতিষ্ঠিত কলেজে স্থানান্তরিত হন এবং সেখান থেকে এমবিবিএস (১৯২৮) পাস করেন। তিনি কর্মজীবন শুরু করেন কলকাতার একটি বেসরকারি ল্যাবরেটরিতে নিয়োগ লাভের মধ্য দিয়ে। ১৯২৭-এ বিয়ে, সংসার পাতা; পরে মুর্শিদাবাদের আজিমগঞ্জের মিউনিসিপ্যালিটি হাসপাতালে মেডিক্যাল অফিসার পদে কিছুকাল দায়িত্ব পালন করেন। তবে তিনি ভাগলপুরের খলিফাবাগে নিজ উদ্যোগে The Secro-Bactro Clinic নামে একটি ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠা করে খ্যাতিমান ডাক্তার হিসেবে পরিচিত হন। তিনি ১৯৬৮ সালে কলকাতায় চলে আসেন স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য।
৩.
বনফুল’কে বাংলা সাহিত্যে আধুনিক ছোটগল্পের অন্যতম স্রষ্টা হিসেবেও বলে থাকেন অনেক সাহিত্য সমালোচক। তিনি হাসির গল্পের পাশাপাশি লিখেছেন সিরিয়াস গল্পও।লেখক হিসেবে বনফুল হাজারেরও বেশি কবিতা, ৬শতাধিক ছোট গল্প, ৬০টি উপন্যাস, ৫টি নাটক, জীবনী ছাড়াও অসংখ্য প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তার রচনা সমগ্র ২২ খণ্ডে প্রকাশিত। বনফুলের ব্যক্তিত্ব তাঁর সমগ্র সাহিত্যে যতটা উদ্ভাসিত, তাঁর লেখা ‘মর্জিমহল’ দিনলিপিতেও ততটাই বলে গবেষকগণ সংশয়হীনভাবে ঘোষণা করেছেন। বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় পরীক্ষাপ্রবণ শিল্পী। ছোটগল্প পরিকল্পনায় তাঁর মৌলিকতা, তীক্ষ্ম মননশীলতা ও নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে মানবচরিত্রের উপস্থাপন পাঠকের মনে বিস্ময় উদ্রেক করে। আবার এ ধারাতেই তাঁর গল্প জীবনের অভিজ্ঞতায় সরস, গভীর ও নৈর্ব্যক্তিক ভাবনায় স্বাতন্ত্র্য। তাঁর গল্পের অন্য বিশেষত্ব ও অভিনবত্ব হচ্ছে স্বল্প অবয়ব। তাঁর অধিকাংশ গল্প এ সূত্রে বাঁধা বলে এগুলিকে বলা হয় অনুগল্প। বলা যেতে পারে ছোটগল্প রচনায় তাঁর প্রতিভা সম্যকরূপে বিকাশ লাভ করে। ছোটগল্প কত ছোট হতে পারে, খন্ডিত বা আকস্মিকতাজনিত অসমাপ্তির বোধ কীভাবে সৃষ্টি না হয় তার পরীক্ষা তাঁর গল্পগুলিতে পাওয়া যায়। ক্ষুদ্র পরিসরের মধ্যে গভীর চিন্তা ও জটিল অভিজ্ঞতার নিপুণ প্রকাশ তাঁর ছোটগল্পগুলিকে এক অসাধারণত্ব দান করেছে। তাঁর উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থ-বনফুলের গল্প (১৯৩৬), বিন্দুবিসর্গ (১৯৪৪), অদৃশ্যলোকে (১৯৪৬), তন্বী (১৯৪৯), অনুগামিনী (১৯৫৮), দূরবীণ (১৯৬১), মণিহারী (১৯৬৩), বহুবর্ণ (১৯৭৬), বনফুলের নতুন গল্প (১৯৭৬) প্রভৃতি।
৪.
নামে ‘ছোটগল্প’। কিন্তু ছোটগল্প যে জীবনের কতো বৃহৎ ও গভীর সত্যকে প্রকাশ করতে পারে তা বনফুলের (বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়) গল্প না পড়লে বোধ করি কোনোদিন বোঝা সম্ভব নয়। বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্পের জনক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ছোটগল্পের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘ছোট প্রাণ ছোট ব্যথা, ছোট ছোট দুঃখ কথা, নিতান্ত সহজ সরল/ নাহি বর্ণনার ছটা, ঘটনার ঘনঘটা, নাহি তত্ত্ব, নাহি উপদেশ/ অন্তরে অতৃপ্ত রবে, সাঙ্গ করি মনে হবে, শেষ হইয়াও হইলো না শেষ।’ সংজ্ঞার যদি সার্থক উদাহরণ দিতে হয় তাহলে বনফুলের ছোটগল্পের বিকল্প খুঁজে পাওয়া ভার। আধ পৃষ্ঠা-এক পৃষ্ঠায়ও যে একটা আস্ত ছোটগল্প লিখে ফেলা যায়, তা যে কেউ বনফুল পড়লেই বুঝতে পারবেন। পুরো গল্পজুড়ে কাহিনী ও চরিত্রের যে বলিষ্ঠ গাঁথুনি পাঠক পাবেন তাতে তার মনে স্পষ্টতই একটি চিত্রকল্প ফুটে উঠবে। তবে এটাই তার গল্পের বিশেষত্ব নয়। গল্প পড়তে পড়তে পাঠক যে কল্পনার ডাল-পালা ছড়িয়ে সামনে এগিয়ে যাবেন তা একেবারে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে গল্পের শেষ বাক্যে বা লাইনে গিয়ে। এভাবে না বলে বরং বলা উচিত, গল্পের শেষ বাক্যে বা শেষ লাইনে পাঠক যে ঝাঁকুনিটা খাবেন, নিশ্চিতভাবেই বলে দেয়া যায় তার জন্য তিনি মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। যেমন, বনফুলেরই লেখা ‘পাঠকের মৃত্যু’ নামে বিখ্যাত গল্পটি হয়তবা অনেকেরই পড়া আছে। তবে ‘নিমগাছ’ গল্প থেকে একটু তুলে দিয়ে বনফুলের সংক্ষিপ্ত অথচ ক্ষুরধার বাক্যবিন্যাস এবং অপ্রত্যাশিত চমকের একটি উদাহরণ দেয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে। ‘কেউ ছালটা ছাড়িয়ে নিয়ে সিদ্ধ করছে। পাতাগুলো ছিঁড়ে শিলে পিষছে কেউ, কেউ বা ভাজছে গরম তেলে। কচি ডালগুলো ভেঙে চিবোয় কতো লোক- দাঁত ভালো থাকে, হঠাৎ একদিন একটা নতুন ধরনের লোক এলো। ছাল তুললে না, পাতা ছিঁড়লে না, ডাল ভাঙলে না, মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো শুধু। নিমগাছটার ইচ্ছা করতে লাগলো লোকটার সঙ্গে চলে যায়। কিন্তু পারলে না। মাটির ভেতর শিকড় অনেক দূরে চলে গেছে। বাড়ির পেছনে আবর্জনার স্তুপের মধ্যেই দাঁড়িয়ে রইলো সে।’ না পাঠক, গল্প এখনও শেষ হয়নি। শেষ বাক্যটি যে এখনও বাকি আছে! পুরো এক পৃষ্ঠাজুড়ে নিমগাছের বর্ণনা দেয়ার পর শেষ বাক্যটি লক্ষ্য করুন, ‘ওদের বাড়ির গৃহকর্ম-নিপুণা লক্ষ্মী বউটির ঠিক এক দশা!’ মনোযোগ দিয়ে পড়ার পর পাঠকরে অজ্ঞাতসারেই মন থেকে একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে যাবে, এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। আর তাই সাহিত্য সমালোচক-গবেষকদের অনেকের মতে, বাংলা সাহিত্যে সর্বপ্রথম অণুগল্প লেখেন বনফুল। তাঁর গল্পগুলো অর্ধ পৃষ্ঠা, এক পৃষ্ঠা কিংবা দুই পৃষ্ঠা পর্যন্ত সীমায়ত। তবে এক পৃষ্ঠা, অর্ধ পৃষ্ঠা কিংবা এক পঙ্ক্তিতে সমাপ্ত গল্পের দৃষ্টান্ত ইংরেজী সাহিত্য দুর্লভ নয়। বাংলা পরিভাষা করলে হয় অণুগল্প ইউরোপে ঈশপের গল্প, ভারতবর্ষে জাতকের গল্প, পঞ্চতন্ত্র, হিতোপদেশ প্রভৃতি বনফুলের অণুগল্পের পূর্বতন মৌখিক ঐতিহ্যের নিদর্শন। এরপর আধুনিক (লিখিত) সাহিত্যে পাই বনফুলের অণুগল্প। তবে তিনি সেই অণুগল্পগুলো ছোটগল্পের সঙ্গে এক কভারের গ্রন্থে এনেছেন। সেগুলোকে স্বাতন্ত্র্যতা দিয়ে ভিন্ন গ্রন্থে গ্রন্থিত করে যাননি। বনফুল ছোটগল্প যেমন সিদ্ধহস্ত তেমনি অণুগল্পেও; যদিও তিনি তাঁর অণুগল্পগুলোকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করেননি। অবশ্য তখন ‘অণুগল্প’ কথাটি সাহিত্যে স্বাতন্ত্র্য মর্যাদার আসন লাভ করেনি। তাঁর অধিকাংশ অণুগল্প রূপক ও প্রতীকধর্মী।
৫.
বনফুল তথা বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের গল্প লেখা সম্পর্কে একটি গল্প প্রচলিত। কখনো কখনো কোনো সাহিত্য পত্রিকা দপ্তরে তিনি পোস্টকার্ডে গল্প পাঠিয়েছেন! সংবাদটি যেকোনো ভাষার সাহিত্যের পাঠকের জন্য বিস্ময়কর, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিস্ময়কর এই জন্য, একটি পোস্টকার্ডে লেখার জন্য কতটুকু জায়গা, তা আমাদের ভালোমতো জানা আছে। সেখানে একটি গল্প পাঠানো তো দূরকল্পনা, ছাপানোর জন্য একটি কবিতাও ঠিকঠাক পাঠানো যায় কিনা, সে সন্দেহ কিন্তু কোনোভাবে মুছে যায় না। বনফুল গল্প-উপন্যাস রচনার পাশাপাশি কবিতাও লিখতেন। পেশায় চিকিৎসক, সে চর্চায় তাঁর সুনাম ছিল। তাই পোস্টকার্ডে গল্প- এ সংবাদ সত্যি দূরকল্পনা, যারা তাঁর কাব্যচর্চা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, তারা কবিতা পাঠানোর কথা ভেবে নিতেও পারেন। কিন্তু সত্য এই, বনফুল পোস্টকার্ডে পত্রিকায় প্রকাশের জন্য গল্প পাঠিয়েছেন।
৬.
‘বনফুলের ছোটগল্প: একটি নিমেষ ও বহতা জীবন’ গ্রন্থের প্রথম অধ্যায় ‘ছোটগল্পের পরিচয় ও বাংলা ছোটগল্প’ থেকে জানতে পারি বাংলা সাহিত্যের বহু শাখা-প্রশাখা রয়েছে। উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক, কবিতা প্রভৃতি। গভীর সত্যের গল্পকার বনফুল, জীবনের গভীর সত্যের গল্পকার বনফুল, ব্যতিক্রমধর্মী গল্পের অমর স্রষ্টা, বাংলা সাহিত্যে যে নামটি অতি প্রিয়, বিশেষ করে ছোটগল্পে যার সৃষ্টিকর্ম অক্লান্ত। শিল্পরূপায়ণে- নতুন নতুন রীতি ও রূপনির্মাণে তাার তুলনা নেই। ছোটগল্পে একাত্ম হয়ে আছে তাার ব্যক্তিত্ব ও প্রতিভার স্বাক্ষর। নিজস্ব শিল্পরীতিকে তিনি ব্যক্তিত্বের প্রতীক হিসেবেও সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন খুব সহজেই। ছোটগল্প লিখে বনফুল বাংলা সাহিত্যে অমরত্ব লাভ করেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো- ছোটগল্প কী? এক্ষেত্রে প্রশ্নটা যতটা সহজ, উত্তরটা কিন্তু এতটা সহজ নয়। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বক্তব্য আমরা অনেকেই জেনেছি, তবু কথা থেকে যায়। তবে সহজে বলা যায়, সাহিত্য যদি শিল্পকলার শাখা হয়, গল্প এর প্রশাখা। আর ছোটগল্প সেই প্রশাখারই অঙ্গ। যে অঙ্গের সঙ্গে জড়িত দুটি ধারণা- ছোটত্ব ও গল্পত্ব। অর্থাৎ, আকারে ছোট হবে এবং তাতে গল্পের স্বাদও থাকবে। গল্পের কলেবর ছোট হলেই ছোটগল্প। কিন্তু এক্ষেত্রে ছোটত্বের সীমা কী? সীমা নির্ধারণ যে আরো জটিল। কারণ একটি ছোটগল্প দু-চার বাক্যেও হতে পারে, আবার ছাপা বইয়ে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ পৃষ্ঠাও হতে পারে। অবশ্য এর শেষ সীমাটা চল্লিশ পৃষ্ঠা হতে পারে বলেও মনে করেন অনেকেই। তবে চল্লিশ পৃষ্ঠার চেয়ে বেশি হলে আমরা বড়গল্প বলি। এবার নতুন প্রশ্ন। ছোট কিংবা বড় হোক, আসলে গল্পটা কী? এককথায় বলা যায়, গল্প মানে ঘটনাপ্রবাহ। তবে এতে শিল্পরূপসম্পৃক্ত। মানবজীবনের কোনো বিশেষ মুহূর্ত, দিন বা ঘটনা অবলম্বন করেই লেখা হয় গল্প। গল্প সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা লাভের পর ছোটগল্প নিয়ে আরও কিছু বলা প্রয়োজন। তাতে বনফুলের সৃষ্টিকর্ম ও অমরত্ব সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া সম্ভব হবে। এক্ষেত্রে বলতে হয়, ছোটগল্পের সূচনা আকস্মিক ও পরিসমাপ্তি হয় নাটকীয়। এতে ঘটনার ঘনঘটা, তত্ত্ব, উপদেশ বা দর্শন থাকে না। থাকে অতৃপ্তির বেদনা। আর এতসব বৈশিষ্ট্যের সবকিছু নিয়েই বনফুল ছোটগল্প তুলে দিয়েছেন পাঠকের দরবারে।
৭.
আগেই উল্লেখ করেছি, অণুগল্পও বাংলা সাহিত্যের একটি নবতর শাখা। এই নবতর শাখাটি বাংলা কথাসাহিত্যে ভিন্নমাত্রা সৃষ্টি করেছে। অণুগল্পে সবকিছু বলে দেয়া হয় না, শুধু ইঙ্গিত করা হয়। পাঠক সেই ইঙ্গিত অনুযায়ী এগিয়ে যায়। অণুগল্প একটি শাণিত শরের নাম; যার একমাত্র উদ্দেশ্য লক্ষ্যভেদী হওয়া। অণুগল্পের প্রতিটি শব্দ-বাক্য এমন কি যতি চিহ্ন পর্যন্ত একেকটি অগ্নিকণার ভূমিকা পালন করে। অণুগল্প অত্যন্ত সুনিয়ন্ত্রিত। এর আকার, অবস্থান, বোধ, ঘনত্ব তথা সার্বিক পরিবেশ বাষ্পীয় মনে হলেও অস্তিত্বমান। সাহিত্যের অন্যান্য শাখার এক ধরনের সংজ্ঞা পাওয়া গেলেও অণুগল্পকে ঠিক সংজ্ঞায়িত করা যায়নি। এ যেন এক মায়াবী ব্যাপার, কিছুটা কুয়াশাচ্ছন্ন আলো-আঁধারির খেলা। স্বপ্নের মতো ঘোর লেগে যায় অণুগল্প সম্পর্কে ভাবতে গেলে। মূলত অণুগল্প এক শক্তিশালী বোধ এবং চিরন্তন প্রজ্ঞার সারসংক্ষেপ। বিশ্বসাহিত্যে প্রথম অণুগল্প পাই আমরা ঈশপের গল্পে। এর পর ভারতীয় উপমহাদেশে পঞ্চতন্ত্র, হিতোপদেশ গল্পগুলো। তবে এগুলো ছিল মৌখিক সাহিত্য। ফ্রানৎস কাফকার অণুগল্প বা প্যারাবোলার বিষয়টি বিশ্বের বিভিন্ন দিকে পরিচিতি লাভ করে।
৮.
আলোচ্য গ্রন্থের দ্বিতীয় অধ্যায় ‘বনফুল ও সমকালীন ছোটগল্পধারা’য় পরিচয় পাই তার সমকালের লেখকদের কয়েকজনের, যারা ছোটগল্প রচনা করে সাহিত্যে স্মরনীয় হয়ে আছেন। সাহিত্য সমালোচকেদের মতে, ছোটগল্পের আরো ছোট আকৃতির গড়ন আর ধরনকে আজকাল অনুগল্প ইত্যাদি বলা হয় বটে। কিন্তু উপদেশমূলক গল্পের বাইরে, বাংলা তথা ভারতবর্ষের সর্বত্রই এমন অতি ছোট আকারের কাহিনী বলার অথবা লেখার চল যত দূর জানা যায় প্রাচীনকাল থেকেই ছিল। বনফুলের আগে এ মাধ্যমের আর এক সার্থক লেখকের নাম রবীন্দ্রনাথ। তবে রবীন্দ্রনাথের এ ক্ষুদ্র আকৃতির ছোট ছোট গল্পের তুলনায় বনফুলের আঙ্গিকগত কিছু তফাত্ চোখে পড়ে। হয়তো এজন্য বাংলা ভাষায় এমন আকৃতির গল্পের প্রধান লেখক হিসেবে বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় ওরফে বনফুলকেই ভাবা যায়। এর অবশ্য একটি কারণ, এসব আকৃতিময় সার্থক গল্প তিনি প্রচুর লিখেছেন। যেন গল্প-কল্পনা মগজে কোনোভাবে জায়গা পাওয়া মাত্রই কাহিনীর চুম্বক অংশকে সিধে কাহিনী বর্জনের সচরাচর পথের বাইরে গিয়ে মূল গল্পটাই বলে ফেলেছেন। আর প্রায় সব গল্পেই শেষের আগ পর্যন্ত তা প্রায় কোনো গল্পই না, যেন শেষ পঙিক্ততে গিয়ে তা প্রকৃত ছোটগল্প হয়ে উঠল অনায়াসে। তবে তাতে কিন্তু বহুশ্রুত ‘শেষ হয়ে হইল না শেষ’ বলে রবীন্দ্রনাথের নামে চলা প্রচলিত যে হেয়ালি, তারও কোনো সার্থকতা রচিত হয় না; কারণ ওখানেই বনফুল-রচিত গল্পটি শেষ। অতি সংক্ষিপ্ত বলে এ গল্প বাংলা সাহিত্যের শ্রেণীপাঠ্য কোনো সংজ্ঞার্থকে কোনোভাবে আমলে নেয় না। বনফুল সম্পর্কে এ কথাগুলো মাথায় রেখে, তাঁর অতি পরিচিত ‘নিমগাছ’ গল্পটি পড়তে পড়তে এক ধরনের নিজস্ব দোলাচলও তৈরি হয়। কেন ‘নিমগাছ’ প্রথম পড়া থেকে আজ পর্যন্ত যতবার পড়েছি, প্রতিবারই নতুন, এক বিস্ময়ও বটে আর কিছুতেই এ গল্প কোনোভাবেই ভোলা গেল না, ভোলা যায় না। এ গল্পটা গল্পের সব ধরনের সংযম রক্ষা করে প্রায় কবিতা? মাত্র আটাশ পঙিক্তর রচনা। বাংলা ভাষায় কবিতা তো সাধারণত এমনই আকৃতির হয়। অতটুকু জায়গায় কত কথা বলে যান কবি। শব্দের অর্থান্তর ঘটে সেখানে পাঠকের নিজস্ব জগতে। গল্পে সে সুযোগ আসলেই কম। ‘নিমগাছে’ তা নেইও। কিন্তু বারবার পড়ায় এক ধরনের কবিতা পড়ারই স্বাদও পাওয়া যায়। অথচ ‘নিমগাছ’ গল্প। যেভাবেই ভাবা হোক গল্পই।
৯.
তৃতীয় অধ্যায় ‘বনফুলের ছোটগল্প ও বিষয়বৈচিত্র্য’ জানান দেয় বনফুলের ছোটগল্পের শ্রেনীবিভাজনকে, বিষয়বৈচিত্র্যের নিরিখে লেখিকা বনফুলের গল্পগুলোকে কয়েকটি উপবিভাগসহ তেরটি ভাগে সাজিয়েছেন। হাস্য-কৌতুক ও ব্যঙ্গরসে তিনি ছিলেন চৌকস। কবিতা, উপন্যাস, নাটক-সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় বিচরণ করলেও মূলত ছোটগল্পেই তার প্রতিভা পরিপূর্ণ স্ফূর্তি লাভ করেছে। বাংলা ছোটগল্পকে তিনি বিষয়বৈচিত্র্যের সমান্তরালে আঙ্গিকগত পরিচর্যায়ও সমৃদ্ধ করেছেন। অভিজ্ঞতার আলোকে জীবনকে তিনি যতটুকু দেখেছেন ততটুকুই শিল্পিত করে তুলেছেন। বনফুলের ছোটগল্পগুলোকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক, বিজ্ঞানচেতনামূলক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যামূলক, প্রেম-চেতনামূলক, পারিবারিক সমস্যামূলক, পেশাগত অভিজ্ঞতাকেন্দ্রিক, সাহিত্য-ভাবনাকেন্দ্রিক, পৌরাণিক রূপকথা-উপকথাকেন্দ্রিক, মানবিকবোধজাত, সময়কেন্দ্রিক, রসসৃজনমূলক, প্রতীক এবং শিশুতোষ- এমন সব ভাগে সাজানো যায়। কিন্তু কথা হলো, ভাগ যতই করি গল্পগুলোতে তিনি মানবজীবনের বহুরূপী রূপটি ফুটিয়ে তুলেছেন সার্থকভাবে। জীবনসত্যকে তিনি আঁকড়ে ধরেছেন নব নব রূপে। জীবনের রূপকার এবং ব্যাখ্যাকার হিসেবে তাঁর সাফল্য অসামান্য বলেই প্রতীয়মান। সুস্থ ও বলিষ্ঠ জীবনবোধ থেকেই তার এই ব্যক্তিত্ব উদ্ভূত। তার কল্পনালোকে প্রতিষ্ঠিত ছিল একটি পূর্ণমানবতার বিগ্রহ। কিন্তু কল্পনামূলে জীবনের কোনো অতিবাস্তব আদর্শের প্রতি তার বিশেষ কোনো আসক্তি ছিল না।
১০.
চতুর্থ অধ্যায় ‘বনফুলের ছোটগল্পের আঙ্গিক বীক্ষণ’ রচনায় বনফুলের গল্পগুলোর কাঠামো, ঘটনা সংস্থান, চরিত্র সৃষ্টি, ভাষা, লোক ঐতিহ্য, লোকভাষা, লেখকের জীবনবোধ ও প্রতীতির সমগ্রতা, অবয়ব বিচিত্রা, চিত্রকল্পে কবি,বিজ্ঞানী ও চিত্রকর বনফুল-এর মতোন শিরোনাম-উপশিরোনামে নিজস্ব ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন উদাহরণসহ। মানুষের অন্যায়-অবিচার, দুর্নিবার নিয়তি আর স্বকর্মার্জিত দুর্গতিপ্রাপ্তিতে তার ওষ্ঠাধরে দেখা দিয়েছে ঘৃণাদ্বেষক্রোধ প্রদীপ্ত বক্রহাসি, যা তার গল্পের বিশিষ্ট লক্ষণ। জীবনবোধের জাগ্রত নিষ্ঠায় তিনি নির্মম করে তুলেছেন স্যাটায়ার-এর কশাঘাতকে। সমাজবৃক্ষে লুকিয়ে থাক দুষ্টদের নিখুঁত ছবিটি তিনি ফুটিয়ে তুলতে পারতেন দু-চারটি আঁচড়ে। তবে লোক হাসানোর উদ্দেশ্যে কৌতুকাবহ কোনো ঘটনা সৃষ্টি করেননি। তার হাস্যরস তাকে উদ্দীপিত ও উন্নীত করেছে, যে হাসিতে বিধৃত ও বিস্ফোরিত হয়েছে তার জীবনদর্শন, মোহমুক্তি ঘটাতে সক্ষম হয়েছে রসিকের। তাঁর ‘মানুষ’ গল্পটি এ বক্তব্যের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত কিংবা প্রমাণ।
১১.
পঞ্চম অধ্যায় ‘বনফুলের ছোটগল্পে পাশ্চাত্য প্রভাব’-এ বলেছেন ‘উনিশ শতকের সৃষ্টি ছোটগল্প এ শতকের শেষভাগেই সাহিত্যের ইতিহাসে বৈচিত্র্য ও গভীরতর মহিমান্বিত স্থান অধিকার করে নিয়েছিল’। জানাতে ভুল করেন না, ‘উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগেই ফরাসি ও রুশ সাহিত্যে ছোটগল্পের স্বর্ণযুগ শুরু হয়েছিল’। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে মোপাসাঁ, চেখভ, ও হেনরীদের কথা তুলে ধরেন তাদের নানান গল্প ও মতামতে উদ্ধৃত করে। শেষে গিয়ে বলেছেন নিজের কথাটিও, ‘বস্তুত বনফূল তাঁর গল্পের উপাদান খুঁজে পেয়েছেন সমকালীন প্রেক্ষাপটে নিজের জীবনভূমিতেই, আর তাকে রূপ দিয়েছেন স্বত:স্ফূর্ত আনন্দে। সমকালীন জীবন জটিলতা আর মানসিক সাদৃশ্যে লেখকের আন্তরিক স্বত:স্ফূর্ত লেখনীতে অনুভূতির মুক্তির সঙ্গে সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায় দেশী-বিদেশী নানা লেখকের সঙ্গে। সাদৃশ্য সত্ত্বেও নিজের শিল্পকৌশলে বনফুলের ছোটগল্প স্বমহিমায় হয়েছে উজ্বল।’ (পৃ:১০৬)
১২.
‘বনফুলের ছোটগল্প: একটি নিমেষ ও বহতা জীবন’ প্রবন্ধ গ্রন্থে সোহানা বিলকিস বাংলা ছোটগল্পের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বনফুলের সাফল্য ও স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত করতে সচেষ্ট ছিলেন। বনফুলের কবিপ্রতিভা ও বিজ্ঞানমনস্কতা গল্পের প্রকরণশৈলীতে যে অভিনবত্ব এনেছে, প্রাবন্ধিক তার স্বরূপ আবিষ্কার করেছেন। তার অনুসন্ধিৎসায় নির্মিত হয় বনফুলের নতুন পাঠ, যেখানে গল্পের ভাষা ও বক্তব্যের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক চিহ্নিত করার প্রয়াস চোখে পড়ে। গ্রন্থের ‘উপসংহার’ পরিচ্ছদের শুরু করেছেন, ‘বনফুলের ছোটগল্প প্রসঙ্গ ও প্রকরণ পর্যালোচনায় এই প্রতীতি জাগরুক হয় যে তিনি একজন সূক্ষ্ম দৃষ্টিভঙ্গির জীবন-দ্রষ্টা।’ (পৃ:১০৮) আর সবশেষে গিয়ে সৎ গবেষকের সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়ে অকপটে বলছেন, ‘তাঁর এ সৃষ্টি-প্রাচুর্য অনেক ক্ষেত্রে শৈল্পিক মানদণ্ডের বিচারে সীমাবদ্ধ হলেও নিত্য নতুন প্রসঙ্গ ও প্রাকরণিক অভিনবত্ব তাঁর রচনাকে বৈচিত্র্যময়তা দিয়েছে, যা পাঠককে একঘেয়েমীতে আক্রান্ত করে না। প্রসঙ্গ ও প্রাকরণিক বৈচিত্র্য, অতিসূক্ষ মানবিক চেতনার অন্তরঙ্গতা ও কবি ভাবনা বনফুলের ছোটগল্প-ল্পিকে দেশ-কালোত্তীর্ণ করে তুলেছে।’(পৃ:১০৯)
১৩.
এবার আলোচ্য গ্রন্থর আলোকে এখন বনফুলের কয়েকটি গল্পের সংক্ষিপ্ত আলোচনা ও স্বরূপ বিশ্লেষণের চেষ্টা করাটা অপ্রাসঙ্গিক হবে না আশাকরি। ‘নাম’ গল্পে বনফুল সমাজবাসীকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছেন, আমাদের প্রায় সমস্ত বিচার-সিদ্ধান্তই আপেক্ষিক। ‘ভিতর ও বাহির’ গল্পে তিনি উকিল নবকিশোর বাবুর দুই মনের বিরোধ ফুটিয়ে তুলেছেন। মানবমনের দুর্জ্ঞেয় রহস্যের বিচিত্র দিক প্রকাশ করেছেন ‘মানুষের মন’, ‘অভিজ্ঞতা’, ‘তিলোত্তমা’ এবং ‘মুহূর্তের মহিমা’ গল্পে। এসব গল্পে সৃষ্ট বিস্ময়বোধ নিঃসন্দেহে বনফুলের জীবনের অভিজ্ঞতারই ফসল। তবে গল্পগঠনরীতির বৈশিষ্ট্য বিচারে বলতে হয়-‘নিমগাছ’ বনফুলের শ্রেষ্ঠ এক ছোটগল্প। যে গল্পে তিনি লিখেছেন, ‘ওদের বাড়ির গৃহকর্মা-নিপুণা লক্ষ্মী বউটির ঠিক এক দশা।’
১৩.২
বনফুল তাঁর ‘মানুষ’ গল্পে গঙ্গার বুকে অস্তায়মান সূর্যের রশ্মিচ্ছটায় ভাবাবিষ্ট চোখে পৃথিবীটাকে একটি স্বপ্নালোক বলে মনে করেন। কিন্তু অবাক হন স্বর্গীয় পরিবেশের পাশেই কুষ্ঠব্যধিগ্রস্ত একটি লোক আর স্বাস্থ্যবতী এক যুবতীকে ভিক্ষা করতে দেখে। প্রকৃতির আরেক দিকে ইঁদুরের চিৎকার। এক সময় তার প্রয়োজন হয় সিগারেটের ধোঁয়া। গল্পকারের ভাইয়ের জন্য সুখবর নিয়ে আসে পিয়ন। তার চাকরি হয়েছে। অথচ গল্পকারের ভাইয়ের চেয়েও অনেক যোগ্য প্রার্থী ছিল। সুপারিশ দুর্বল হওয়ায় তারা চাকরি পায়নি। এমন অন্যায় গল্পকারের বিবেককে নাড়া দেয় বলে উদীয়মান চন্দ্রকে আকাশে রেখে তিনি দ্রুতগতিতে ছুটে যান গলির সিগারেটের দোকানে। সিগারেট টেনে ভাইয়ের চাকরি প্রাপ্তির আনন্দ সম্পূর্ণরূপে উপভোগ করার সিদ্ধান্ত নেন। প্রকৃত অর্থে সিগারেটের আগুনে গল্পকার জ্বালাতে চেয়েছেন সমাজবৃক্ষে থাকা অন্যায়-অনিয়ম ও অবিচার।
১৩.৩
স্বপ্ন আর বাস্তব বিস্তর ফারাক। তবু বাস্তবকে অবহেলা করে মানুষ স্বপ্ন দেখতেই অধিক ভালবাসে। এ ভালোবাসা বুকে নিয়েই মানুষ তার ভবিষ্যৎ সাজানোর চেষ্টা করে। আর এ নিয়েও জীবনদার্শনিকের হাসি পায়। এ নিয়ে বনফুল লিখেছেন ‘সুলেখার ক্রন্দন’। গল্পে গভীর রাত, বাইরে জোছনা। এই স্বপ্নময় আবেষ্টনীর মধ্যে দুগ্ধ ফেননিভ শয্যায় উপুর হয়ে ষোড়শী তন্বী সুলেখা কাঁদছে। ঘরে কেউ নেই। গল্পকারের প্রথমে মনে হলো- সুলেখা হয়তো বা তার পছন্দ ও শ্রদ্ধার পাত্র অরুণদাকে মনে করে কাঁদছে। শেষবার মনে হলো- সিনেমা দেখতে না পারার দুঃখে হয়তো বা কাঁদছে সুলেখা। কিন্তু সুলেখা আসলে কাঁদছিল দাঁতের ব্যথায়! বাহ্- কল্পিত সত্যের সঙ্গে বাস্তব সত্যের তফাৎটা বনফুল কত সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছেন।
১৩.৪
প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির যতই পার্থক্য বা তফাৎ থাকুক না কেন- জীবন থেমে থাকে না। দাম্পত্য-জীবন এগিয়েই চলে। কিন্তু এই এগিয়ে চলা জীবনে এমন ট্রাজেডিও ঘটে যা একপক্ষে অত্যন্ত শোকাবহ হলেও অন্যপক্ষে আনন্দ আর হাসির খোরাক হয়। তেমনি এক গল্প ‘অদ্বিতীয়া’। গল্পে প্রভাকে তার স্বামী খুবই ভালবাসে। প্রভার ছোটবোন তাদের ভালবাসা পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিল। প্রভা বাবার বাড়ি বেড়াতে গেলে তার ছোটবোন বোনের বরকে মিথ্যে চিঠি লিখে জানায়, তার দিদি মারা গেছে। তাই সে বোনের বরকে দ্বিতীয় বিয়ের প্রস্তাব দিল। তিন মাস পার না হতেই বর দ্বিতীয় বিয়ে করলো। কিন্তু বাসরঘরে গিয়ে তো অবাক। এ যে তার প্রথমা স্ত্রী সাতটি সন্তান নিয়ে বসে আছে। পুরুষ-পরীক্ষায় শ্যালিকার এই রসিকতা যেমন উপভোগ্য, তেমনি মর্মান্তিক হয়ে দাঁড়ায় স্বামী-স্ত্রীর জীবনে। আবার, ‘পরিবর্তন’ গল্পে বনফুল ফুটিয়ে তুলেছেন দাম্পত্য-জীবনাদর্শের চরম ট্রাজেডির চিত্র। গল্পটির মুখ্য উপপাদ্য হলো অন্ধ-পতিভক্তির পরিণাম। স্বামী হরিমোহনের যক্ষ্মা হয়েছে, স্ত্রী সরমা অক্লান্ত পতিসেবা করে যাচ্ছে। তবু ভাল না হওয়ায় সরমা স্বামীর নিশ্চিত মৃত্যু ভেবে নিজের জীবনও শেষ করার সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে স্বামীর উচ্ছিষ্ট দুধ গোপনে পান করে। কিন্তু বিধি বাম! এক সময় স্বামী সুস্থ হয়ে ওঠলেও সরমা নিজেই রোগাক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। স্বামী সরমাকে ভুলতে পারেনি বলে বেছে বেছে সরমা নামী একটি মেয়েকেই বিয়ে করে সংসার পাতে। এ যেন পতিব্রতার পুরস্কার! তেতো এক বাস্তবসত্য।
১৩.৫
ওঝার প্রতি মানুষের অন্ধ-বিশ্বাস এবং পরিণতি নিয়ে লেখা গল্প ‘দিবা দ্বিপ্রহরে’। এ গল্পে হারু ঘোষের সেজছেলেকে সাপে কেটেছে। একজন সাপটিকে বল্লমের আগায় বিঁধে রেখেছে। চিকিৎসার একপর্যায়ে সেখানে এক আগন্তুকের আবির্ভাব হলো। তার কথাবার্তা শুনে সবাই তাকে গুণী ওঝা বলে ভাবলো। তার কথায় রোগীর বাঁধন খুলে দেয়া হলো। সাপটিকে বল্লমমুক্ত করা হলো। লোকটি সাপের মাথায় চুমু খেলো। এক সময় ছারু ঘোষের ছেলের মৃতদেহের পাশে তাকেও রাখা হলো। পরক্ষণে জানা গেলো, আগন্তুকটি এক পাগল, যে কিনা পাগলা-গারদ থেকে পালিয়ে এসেছে! অপরদিকে স্বপ্ন আর বাস্তবে তফাৎ থাকে- সবাই জানি এবং মানি। কিন্তু মানুষের প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির মধ্যে কি কম পার্থক্য থাকে? আমরা যা চাই, তার কতোটুকুই বা পাই? এ নিয়ে বনফুল লিখেছেন ‘যুগল স্বপ্ন’। গল্পে অমলা তার স্বামীর পাশে ঘনিষ্ঠভাবে শুয়ে আছে। কিন্তু দুজনেই সেই দূর অতীতে হারিয়েছে। অতীতের প্রেম নিয়ে ভাবছে দুজনেই। অমলা স্বপ্ন দেখেছিল অন্য পুরুষ নিয়ে, অমলার স্বামীও পেতে চেয়েছিল অন্য এক নারীকে। কিন্তু দরদাম মেলেনি বলে তাদের কারও প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। তবু দুজনে মিলে সুখের সংসার পেতেছে।
১৩.৬
অন্যায়-অবিচার ও পাপাচারীর প্রায়শ্চিত্ত বিধানেও বনফুলের বিবেক ছিল সোচ্চার। এক্ষেত্রেও তিনি যে খড়গহস্ত ছিলেন তার প্রমাণ পাই ‘আইন’ গল্পে। অর্থের বিনিময়ে ডাক্তার টি. সি. পাল অপরিচিত ব্যক্তিকে মিথ্যা সার্টিফিকেট দিয়ে আত্মতৃপ্তিতে ভুগছিলেন। কিন্তু পরক্ষণেই জানতে পেরেছিলেন, তার ছেলে খুন হয়েছে এবং সার্টিফিকেট নেয়া লোকটিই ছেলের খুনি। অথচ তিনি এমন সার্টিফিকেট লিখে দিয়েছেন যে, আইনের বাবারও সাধ্য নেই- লোকটিকে অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত করে! ‘চন্দ্রায়ণ’ গল্পে আর. এম. এস.-এর শর্টার চন্দ্রবাবুর প্রায়শ্চিত্তটিও কবিবিধাতার চরম দণ্ড বিধানের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। চাকরির সুযোগে গোপনে অন্যের প্রেমপত্র পড়ার সাজা যে কতটা নির্মম হতে পারে তা গল্পটি না পড়লে বোঝা মুশকিল। আবার স্যাটায়ারের সরু কাজে ওস্তাদির প্রমাণ দিয়েছেন বনফুল ‘ছোটলোক’ আর ‘শ্রীপতি সামন্ত’ গল্পে। প্রথম গল্পে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন ছোটলোকেরও আত্মমর্যাদাবোধ থাকতে পারে। আর দ্বিতীয় গল্পে ভণ্ড সাহেবকে বুঝিয়ে দিয়েছেন দীন চেহারার কোনো মানুষের অন্তরটা কেমন হতে পারে।
১৪.
বনফুলের ছোটগল্পের সংখ্যা অল্প নয়, কিন্তু শিল্পরীতি ও রূপকর্মের দিক দিয়ে তার সৃষ্টিতে পুনরাবৃত্তি খুঁজে পাওয়া কঠিন। তার গল্পে কত বিচিত্র মানুষ, কতো বিচিত্র কাহিনী, কথা বলার কতো বিচিত্র ধরন। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে তার বিচিত্ররূপী কারুশিল্প সত্যিই অতুলনীয়। নিজের ব্যক্তিত্ব আর প্রতিভার স্বাক্ষর তুলে ধরতে ছোটগল্পকে বেছে নিয়ে সার্থক হয়েছেন তিনি। বলা যায়, গল্পের রূপ-সৃষ্টিই তার সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি। গল্প আকারে কত ছোট আর হালকা হলেও তাতে জীবনের কত বড় ও গভীর সত্যকে তুলে ধরা সম্ভব, বনফুল তা প্রমাণ করতে পেরেছেন অমর সৃষ্টিতে। তার আলতা আর কাজলবিহীন বাক্যগুলোও কত সুন্দর। সরল বাক্যে কতো বলিষ্ঠ বক্তব্য তুলে ধরেছেন। তার ক্ষুরধার বাক্যগুলোও চিত্তহারী। এখানেই বাংলা ছোটগল্পে তার শ্রেষ্ঠত্ব। যতদিন বাংলা সাহিত্য থাকবে, ততদিন বনফুলের ছোটগল্প পাঠে পাঠক মুগ্ধ হবে। আর আলোচ্য গ্রন্থে ছোটগল্পের ধারাবাহিকতা বিবেচনায় এনেই সোহানা বিলকিস সমকালীন ছোটগল্পে বনফুলের ব্যক্তিগত কণ্ঠস্বরকে চিহ্নিত করেন। মানবজীবনের বিচিত্র বিষয়ে লেখকের অভিজ্ঞতা ও অর্জনের শিল্পভাষ্যকে শনাক্ত করতে দারুণভাবে সক্ষম হয়েছেন।
১৫.
সোহানা বিলকিস-এর ‘বনফুলের ছোটগল্প: একটি নিমেষ ও বহতা জীবন’ গ্রন্থের প্রকাশক স্বরাজ প্রকাশনী, দাম: ১৩০ টাকা, প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি, ২০০৮, প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ। উৎসর্গ: ‘আমার অস্তিত্ব অর্থিত অদ্বয় অধিপ-কে’। প্রিয় লেখকদের অন্যতম নাম-বনফুলকে নিয়ে মনস্বীধারার চমৎকার গ্রন্থ উপহার দেওয়ার জন্য আবারো শিক্ষক, গবেষক সোহানা বিলকিস-কে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন, কৃতজ্ঞতা, ধন্যবাদ। বইটির বহুল পাঠ, প্রচার এবং আলোচনা প্রত্যাশা করি।
আবদুল্লাহ আল মোহন
২৫ এপ্রিল, ২০২০