Sunday, মে ১৯, ২০২৪
শিরোনাম

মাসুম আজিজ; এক অসামান্য অভিনেতার প্রস্থান

শেয়ার করতে এখানে চাপ দিন

অলোক আচার্যঃ বাংলাদেশের অভিনয় জগতের আরও একটি নক্ষত্র ঝরে গেলো। একজন মানুষ দেশের মানুষের কাছে কিভাবে মূল্যায়িত হবে তা নির্ভর করে তার কর্মের ওপর। কাজের বৈচিত্র্যপূর্ণ ক্ষেত্র রয়েছে। কেউ শিক্ষা,কেউ ক্রীড়া,কেউ আবার অভিনয় জগতে নিজেদের মেধার স্বাক্ষর রাখেন। অনেকের মধ্যে নিজের প্রতিভার বিস্ফুরণ ঘটিয়ে মানুষের মনে জায়গা করে নেয়। যেমনটা করতে পেরেছেন, সদ্য প্রয়াত অভিনেতা মাসুম আজিজ। যে যে কাজে নিয়োজিত বিশেষ করে সৃষ্টিশীল কাজ সেখানে তিনি কতটা দক্ষতার ছাপ রাখছেন বা নিজস্বতা সৃষ্টি করছেন তার ওপর নির্ভর করে তিনি কিভাবে মানুষের হৃদয়ে ঠাঁই করে নেবেন। মাসুম আজিজ একেবারেই নিজস্বতা বা আলাদা বৈশিষ্ট্য দিয়ে অভিনয় করে গেছেন নাটক বা চলচ্চিত্রে। আমরা মাসুম আজিজকে সহজ সাধারণ একজন জীবন দর্শনের অভিনেতা হিসেবেই সর্বাধিক জানি। তার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নাটকেই তিনি গ্রামীণ পরিবেশের একজন সাধারণ মানুষের জীবন ফুটিয়ে তুলেছেন দক্ষতার সাথে। তার অভিনয় দেখতে দেখতে ভুলেই গেছি যে সেটা অভিনয়, বাস্তব জগত না। তার সেইসব নিজস্বতা এতটাই জনপ্রিয় যে তা জনগণের চোখ জুড়িয়েছে। অভিনয়ে স্বার্থকতা এনেছে। দর্শক তার নাটক,সিনেমার অভিনয় দেখে তৃপ্তি পেয়েছে। নিজেদের জীবনের সাথে মিলিয়ে হাসি-কান্নার অনুভূতি এনেছে।
তিনি অভিনেতার পাশাপাশি ছিলেন একজন সফল নাট্য নির্মাতা। তিনি মঞ্চে এবং চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন। চট্রগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন তিনি থিয়েটারে কাজের মাধ্যমে অভিনয়ে আতœপ্রকাশ করেন। এরপর ১৯৮৫ সালে তিনি প্রথম টিভি নাটকে অভিনয় করেন। এরপর থেকে তিনি চারশতাধিক নাটকে অভিনয় করেন। অসংখ্য অভিনয় দিয়ে তিনি জাদুকরের মতো মন্ত্রমুগ্ধ রেখেছেন দর্শকদের। চলে যাওয়ার রাস্তায় সবাই থাকে। তবে যতদিন এসব সৃষ্টিশীল জাদুকর আমাদের মাঝে থাকেন ততদিন সেই ক্ষেত্র উপকৃত হয়। যা এতদিন হয়েছে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগত বা নাট্যজগত তার কাছ থেকে বহুকিছু পেয়েছে। যার অভিনয় দেখে দশকের পর দশক ধরে মুগ্ধ থেকে দর্শককুল সেই জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পী মাসুম আজিজ চলে যাওয়ার সাথে সাথে দর্শক হৃদয়ে সৃষ্টি হয়েছে এক বিশাল শূণ্যতা। আর কোনোদিন সেই অভিনয়শৈলী দেখার সৌভাগ্য আমাদের হবে না। যে শূণ্যতা আর কোনোদিনই পূরণ হবার নয়। সৃষ্টিশীল কাজ আসলে এমন একটি অভ্যন্তরীণ শক্তি তার বিকল্প কোনো শক্তি দিয়ে পূরণ করা যায় না। কৌতুক অভিনেতা দিলদার বা নায়ক মান্নার মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে যেমন আজ অভিনয় জগত শূণ্য তেমনি আরও একটি শূণ্যতা বৃদ্ধি পেলো তার বিদায়ের মধ্যে দিয়ে। একজন লেখক তার লেখনীর মাধ্যমে পাঠককে কাছে টানেন। আবার সেই পাঠক যখন দর্শক হয়ে টিভি সেটের সামনে বসে অভিনয় দেখে তখন তাকে কাছে টানে একজন অভিনেতা।
অভিনয়ের সাফল্য দর্শককে কাছে টানার মাধ্যমে। খুব কম সংখ্যক এমন প্রতিভাসম্পন্ন অভিনেতা থাকেন যারা মাসুম আজিজের মতো দর্শককে নিজের অভিনয় জাদুতে মুগ্ধ রেখেছেন বছরের পর বছর। তার শুরু থেকে শেষ অবধি সেই জনপ্রিয়তা। কোনো নাটক বা সিনেমায় তিনি থাকা অর্থই হলো সেই অভিনয় দেখার সুযোগ পাওয়া যা দেখার জন্য দর্শক অপেক্ষা করে থাকে। জানি এ অভাব আর কোনোদিন পূরণ হবে না। তবে তার বড় পরিচয় হলো অভিনেতা। মুহাম্মাদ মাসুম আজিজ ১৯৫২ সালে পাবনা জেলার ফরিদপুরে জন্মগ্রহণ করেন। আমি তাকে আবিষ্কার করি ’উড়ে যায় বকপক্ষী’ নাটকে। এই নাটকে তার চরিত্র ছিল ওস্তাদ মজিদ মিয়া। যে গ্রামের একটি গানের দল চালায়। প্রখ্যাত হুমায়ুন আহমেদের এই নাটকটি বাংলাদেশের ব্যাপক জনপ্রিয় একটি নাটক। এই নাটকে মাসুম আজিজের অনবদ্য অভিনয় দর্শকের মন কেড়ে নেয়। খুব ধীরে শান্তভাবের অভিনয়ে তার বক্তব্যগুলো ছিল দর্শকের কাছে আকর্ষণীয়। আবার ঘানি চলচ্চিত্রে এবং সাকিন সারিসুরি নাটকে তার অনবদ্য অভিনয় এখনও চোখের পর্দায় ভাসে। তার কাজের স্বীকৃতিস্বরুপ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (শ্রেষ্ঠ পাশর্^অভিনেতা, ঘানি), মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার এবং একুশে পদক লাভ করেন। তবে সবচেয়ে বড় পুরস্কার হলো মানুষের ভালোবাসা। এই যে বাংলার কোটি কোটি মানুষের কাছে তিনি মাসুম আজিজ হয়ে হৃদয়ে ঠাঁই পেয়েছেন তার থেকে বড় কোনো পুরস্কার হতে পারে না। কোনো লেখক বা অভিনেতার কাছেই সবচেয়ে প্রিয় হলো মানুষের ভালোবাসা। তা তিনি পেয়েছেন সারাজীবন। তিনি যেমন তার দক্ষতার সবটুকু দিয়ে বাংলাদেশের নাটক,চলচ্চিত্রকে উজাড় করে দিয়েছেন, দেশের নাটক,চলচ্চিত্রকে যেমন প্রাণ দিয়েছেন সেভাবেই বাংলার মানুষ তাকে ভালোবেসেছে উজাড় করে। তাই তার চলে যাওয়া কষ্ট দেয়। তার প্রস্থানের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের অভিনয় জগত এক মহামূল্যবান অভিনেতাকে হারিয়েছে।
তার সাথে তুলনা করার কেউ নেই। কোনোদিন হবেও না। অভিনয় যে মানুষের কাছে পৌছানোর একটি শক্তিশালী মাধ্যম তা তিনি তার দীর্ঘ ছয় দশকের ক্যারিয়ারে অভিনয়ের মুগ্ধতা দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন। নিজেকে তার অভিনয় দক্ষতার মাধ্যমে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। যেখানে আজ তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তার অসংখ্য অভিনীত চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে মমতাজ, ঘানি,গহীনে শব্দ,বস্তির ছেলে কোটিপতি,গেরিলা,রুপগাওয়াল,গাড়িওয়ালা,লালচর,এইতো প্রেম ইন্দুবালা ইত্যাদি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। অসংখ্য টিভি নাটকের প্রাণ ছিলেন তিনি। ছোট পর্দায় তিনি রেখেছেন অভিনয় অসামান্য দক্ষতার স্বাক্ষর। বিভিন্ন ধারাবাহিক নাটকে তার চরিত্র ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয়। বস্তুতপক্ষে কাজের ক্ষেত্র এতটা বিশাল যে নামগুণে শেষ করতে বেগ পেতে হয়। এমন একজন মানুষ ক্যান্সারের কাছে হার মেনেছেন। এমন গুণী এক অভিনেতাকে আমরা আজ হারিয়েছি। বাংলা অভিনয় শিল্প হারিয়েছে এক সত্যিকারের মানুষকে যিনি অভিনয়কে ভালোবাসতেন হৃদয় দিয়ে।

শেয়ার করতে এখানে চাপ দিন

সর্বশেষ খবর