নিজস্ব প্রতিবেদক : কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ বা স্কুল-কলেজের শিক্ষক, আবার কেউ কেউ ব্যবসায়ী-ঠিকাদার। অর্থাৎ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ যাদের এলাকায় সামাজিক মর্যাদার অধিকারী, তারাই উদ্যোগটি নিয়েছেন। বলতে গেলে একেবারেই ভিন্নধর্মী একটি উদ্যোগ। সম্প্রতি দেশের কর্তাব্যক্তিদের অনেকেই এ জাতীয় উদ্যোগ নিয়েছিলেন, কিন্তু সেই উদ্যোগে কোন প্রাণ ছিল না- মমতা ছিল না, ছিল শুধু সেলফি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারের প্রয়াস। লাইক-কমেন্ট পাবার উদ্দেশ্যে ৫ মিনিটের জন্য এমপি-মন্ত্রী ও প্রশাসনের লোকজন পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন অভিযানসহ মাঠে গিয়ে কৃষকের ধান কেটে দেবার লোকদেখানো কর্মসূচি পালন করেছিলেন, ফটোসেশন শেষে তাদের আর সেই কাজের ধারে-কাছেও দেখা যায়নি।
কিন্তু এই প্রতিবেদনে যে ঘটনার বর্ণনা করা হচ্ছে, সেই ঘটনার পেছনে কোন অসৎ উদ্দেশ্য নাই; উদ্দেশ্য নাই নিজেদের প্রচার করারও। বস্তুত ভেতরের উৎপাত ও সমাজের প্রতি দায়বোধ থেকেই ব্যতিক্রমী এই আয়োজন করা হয়েছে। কাশিনাথপুর এলাকায় শিবপুর-টাংবাড়িতে গড়ে ওঠা এলকে মডেল টাউনের বাসিন্দারা ‘এলকে মডেল টাউন ফ্ল্যাট-প্লট মালিক বহুমুখি সমবায় সমিতি’ নামে যে সামাজিক সংগঠন গড়ে তুলেছেন, সেই সংগঠনের উদ্যোগেই চলছে প্রতিদিনের এই পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন অভিযান।

প্রতিদিন ভোর ৬ টা থেকে ৭ টা পর্যন্ত চলমান পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন অভিযানে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রায় ৪০ জন মানুষ স্বতস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে থাকেন। তবে এখানে ব্যতিক্রম বিষয় এটাই- কেউই তাদের নিজেদের জন্য নয়, প্রতিবেশিদের পতিত জায়গা-জমি, পাশে অপরিচ্ছন্ন জায়গা পরিস্কার করে চলেছেন প্রতিদিন। গত ৭ দিন শুরু হয়েছে এই অভিযান। চলতে থাকবে কতদিন- তা আয়োজকরা এখন পর্যন্ত বলতে পারেননি; কেননা তারা শুধুমাত্র নিজেদের এলাকাতে নয়, আগামীতে আশপাশের দু’চারটি গ্রামেও এই অভিযান চালাতে চান।
এলকে ফ্ল্যাট-প্লট মালিক বহুমুখি সমবায় সমিতির সভাপতি মীর আব্দুল বারেক জানান, জনগনকে সচেতন করাই আমাদের মূল উদ্দেশ্য।
এলকে ফ্ল্যাট-প্লট মালিক বহুমুখি সমবায় সমিতির সেক্রেটারী ও বিশিষ্ট সমাজ সেবক মোখলেসুর রহমান মুকুল বলেন, আমাদের দেখাদেখি সবাই যেন নিজেদের বাড়ি-ঘর পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে উৎসাহী হয়। সে জন্য আমাদের এই আয়োজন। শিক্ষিত সমাজ সচেতন হলে সমাজ পরিবর্তন হতে বাধ্য।
এলকে মডেল টাউনের বাসিন্দা ও এ্যাড. শামসুল হক টুকু-অধ্যাপক লুৎফুন্নেছা ফাউন্ডেশনের সেক্রেটারী ডা. আমিরুল ইসলাম সানু বলেন, খাদ্যাভাস ও জীবনধারার পরিবর্তনের মাধ্যমেই একমাত্র শারীরিক সুস্থতা সম্ভব। এখানে প্রতিদিন ভোরে আমরা শারীরিক যে পরিশ্রম করছি, তাতে শরীর-মন দুটোই প্রাণবন্ত ও উৎফুল্ল থাকবে। ডায়াবেটিস প্রতিরোধে এই কর্মসূচি অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে বলে আমি মনে করি।
এল কে মডেল টাউনের বাসিন্দা ও সৈয়দপুর স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ আনোয়ার হোসেন খান বলেন, সকলের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণে যে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন অভিযান আমরা শুরু করেছি, এটা অনুকরণীয় হতে পারে। আমাদের দেখে শিক্ষিত সমাজের সবাই নিজের কাজ নিজে নিজে করতে শিখলে স্বার্থক হবে আমাদের আয়োজন।
এল কে মডেল টাউনের বাসিন্দা ও কাশিনাথপুর মহিলা ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক রঞ্জন কুমার দত্ত বলেন, এই কর্মসূচি দেখে আমি অভিভূত। নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পেরে গর্ববোধ করছি।
এল কে মডেল টাউনের বাসিন্দা ও বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী ফেরদৌস তপন বলেন, সম্মিলিত অংশগ্রহণে যে কাজ আমরা করছি প্রতিদিন, তাতে নিজেদের শরীরেও ব্যায়াম হচ্ছে।
এল কে মডেল টাউনের বাসিন্দা ও দুলাই ডা. জহুরুল কামাল সরকারি কলেজের প্রভাষক সালাহউদ্দিন আহমেদ জানান, আমি শারীরিক পরিশ্রম অনেকটা ছেড়েই দিয়েছিলাম, এখন সবার সাথে কাজ করতে গিয়ে শারীরিকভাবে সুস্থতা অনুভব করছি।
এলকে মডেল টাউনের বাসিন্দা ও হুঁইখালী বাংলা স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ মীর শিহাব উদ্দিন বলেন, দৃষ্টিভঙ্গী বদলালে জীবন বদলে যায়। আমরা জীবন বদলের আয়োজন করেছি।

এলকে মডেল টাউনের বাসিন্দা প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম বলেন, প্রতিটি পাড়ায় পাড়ায় তরুণ সমাজ এই উদ্যোগ নিলে সমাজের পরিবর্তন হতে সময় লাগবে না। কাশিনাথপুর মহিলা ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক মাসুদ রানা বলেন, আমি সবার আগ্রহ ও প্রচেষ্টার প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
এলকে মডেল টাউনের বাসিন্দা ব্যবসায়ী সরোয়ার হোসেন, আকতার হোসেন, জিলাল উদ্দিন খান, আনিসুর রহমান, সাইদুল ইসলাম, আব্দুর রাজ্জাক, কবির হোসেন সরদার, শ্রী রতন কুমার শীল, আবু বকর দুলাল, কাজেম খান, হেলাল উদ্দিন, বিল্লাল হোসেন, ইন্দ্রজিৎ শীল, জাকিরুজ্জামান টিপু ও শিপন মোল্লা বলেন, আমাদের এই পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন অভিযান অব্যাহত থাকবে। প্রচারের জন্য নয়, আমরা আমাদের দায়িত্ববোধ থেকেই এই কাজে সম্পৃক্ত হয়েছি। আমরা নিয়মমাফিক প্রতিদিন ভোরে এক ঘণ্টা পরিশ্রম করে যে যার কাজে বেরিয়ে পড়ছি। এতে করে একদিকে আমাদের দিনটা বড় হচ্ছে, অন্যদিকে শারীরিক পরিশ্রমের কারণে শরীর-মন উৎফুল্ল থাকছে।
২৫ সেপ্টেম্বর সকালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন অভিযান চলাকালীন আশপাশের বাসা-বাড়ি থেকে অনেকেই তাদের কাজে সন্তুষ্ট হয়ে সকালে নাস্তার ব্যবস্থা করে তাদের কাজকে আরও খানিকটা বেগবান করে তুলছেন।