আলাউল হোসেন : দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা পেলাম মুক্ত-স্বাধীন বাংলাদেশ আর পেলাম এক মহানায়ককে। যিনি তার প্রজ্ঞা, চিন্তা-চেতনা ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিয়ে বাঙালি জাতিকে তুলে আনলেন ‘শেকড় থেকে শিখরে’। একাত্তরের মহান বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখতে দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্মাণ করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিভাস্কর্য। তেমনি বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পাবনার বেড়ায় তৈরি হয়েছে ‘শিকড় থেকে শিখরে’, ‘বিজয় বাংলা’ ও ‘জ্যোতির্ময়’ নামে তিনটি দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্য ও শিল্পকর্ম। পাবনার বেড়ার কৃতি সন্তান তরুণ চিত্রশিল্পী ও ভাস্কর বিপ্লব দত্ত ভাস্কর্যগুলো নির্মাণ করেন।
শেকড় থেকে শিখরে : বঙ্গবন্ধু ও বাংলার ইতিহাসকে কেন্দ্র করে পাবনার বেড়ায় সম্প্রতি নির্মিত ‘শিকড় থেকে শিখরে’ ভাস্কর্যটি অতীতের সব ভাস্কর্যের চেয়ে বৃহৎ ও ব্যতিক্রম। ১০ ফুট উচ্চতার কংক্রিটের স্তম্ভের ওপর নির্মাণ করা হয়েছে ১৮ ফুট উচ্চতার বঙ্গবন্ধুর আবক্ষ ভাস্কর্য। এটি স্টেইনলেস স্টিলের তৈরি। বাংলাদেশে স্টেইনলেস স্টিলের তৈরি এটিই বঙ্গবন্ধুর সর্ববৃহৎ আবক্ষ ভাস্কর্য। এ ভাস্কর্যের দুপাশে রয়েছে তিনটি করে অতিরিক্ত স্তম্ভ। যাতে সিমেন্ট কেটে অঙ্কিত হয়েছে ’৭৫ পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতির উত্থান-পতন এবং উন্নয়নের ধারা। এ ভাস্কর্যের আরও একটি বৈশিষ্ট্য- মূল ভাস্কর্যের এক পাশে ২৬টি কলামের একটি সীমানা বেষ্টনী, যার প্রত্যেকটি কলামে টাইলসে এনগ্রেভিং করা হয়েছে বাংলার ইতিহাস। যেখানে সংক্ষিপ্ত আকারে লিপিবদ্ধ হয়েছে সিরাজউদ্দৌলা থেকে শুরু করে মহান মুক্তিযুদ্ধ ও ’৭৫ এর জাতির জনকের পরিবারের ঘৃণ্যতম হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত সচিত্র ইতিহাস। ভাস্কর্যটি একবার প্রদক্ষিণ করলে বাংলার ইতিহাস সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়।
ইতিহাস শনাক্ত করে, পাবনার বেড়া উপজেলার ডাববাগান যুদ্ধই একাত্তরের প্রথম সংঘটিত সম্মুখযুদ্ধ। সেই যুদ্ধের শহীদদের স্মৃতি অমর করে রাখা ও নতুন প্রজন্মের সামনে মুক্তিযুদ্ধ তথা বাংলার সঠিক ইতিহাস সদা উদ্ভাসিত রাখার প্রয়াসে উত্তর এবং উত্তর-পশ্চিমবঙ্গের প্রবেশদ্বার-খ্যাত বেড়া উপজেলার নগরবাড়ি ঘাটের অদূরে নাটিয়াবাড়ি নামক স্থানে নগরবাড়ি-পাবনা মহাসড়ক সংলগ্ন ধোবাখোলা করোনেশন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রধান ফটকের পাশে এ স্মৃতি ভাস্কর্য নির্মাণের উদ্যোগ নেন পাবনা-২ আসনের (বেড়া-সুজানগর) সাবেক সংসদ সদস্য খন্দকার আজিজুল হক আরজু। ২০১৫ সালে শিল্পী বিপ্লব দত্তকে এটি নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২০১৭ সালের শেষের দিকে বহুমাতৃক ও বৈচিত্র্যপূর্ণ এ ভাস্কর্য নির্মাণ কাজ শেষ হয়।
ধোবাখোলা করোনেশন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ আবুবকর সিদ্দিক বলেন, নতুন প্রজন্মের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, বাংলার ইতিহাস তথা বাঙালি জাতির ইতিহাস ছড়িয়ে দিতে খন্দকার আজিজুল হক আরজুর পৃষ্ঠপোষকতায় শিল্পী বিপ্লব দত্ত যে ভাস্কর্য নির্মাণ করেছেন, তাতে নতুন প্রজন্ম উদ্দীপ্ত হবে। আমাদের ছাত্রছাত্রীরা এখান থেকে ইতিহাসের সঠিক পাঠ নিতে পারবে। এ ভাস্কর্য জাতীয় জীবনে নান্দনিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বহন করবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
জ্যোতির্ময় : বেড়া পৌরসভার সামনে নির্মিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি আবক্ষ ভাস্কর্য ‘জ্যোতির্ময়’। সাতকোণ বিশিষ্ট ৫ ফুট উচ্চতার বেদির ওপরে বঙ্গবন্ধুর আবক্ষ ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। এটির উচ্চতা আড়াই ফুট। ভাস্কর্যটি ব্রোঞ্জ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। বেদির সাতকোণে সাত বীরশ্রেষ্ঠের ছবি টাইলসের ওপর খোদাই করে তৈরি করা হয়েছে। ২০১২ সালের শেষের দিকে এ ভাস্কর্যের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয় এবং ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে এটি উদ্বোধন করা হয়। এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক বেড়া পৌর মেয়র আলহাজ আব্দুল বাতেন জানান, একাত্তরের মহান বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখতে আমি আমার নিজ খরচে শিল্পী বিপ্লব দত্তকে দিয়ে স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মাণ করিয়েছি।
বিজয় বাংলা : বেড়ায় শহীদ আব্দুল খালেকের কবরের সামনে সম্প্রতি নির্মিত হয়েছে আরেকটি দৃষ্টিনন্দন স্মৃতিস্তম্ভ ‘বিজয় বাংলা’। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে জীবন উৎসর্গকারী শহীদদের স্মরণে বেড়া বিবি মডেল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশে ব্যতিক্রমধর্মী এ স্মৃতিস্তম্ভ বেড়া পৌর মেয়র আব্দুল বাতেনের পৃষ্ঠপোষকতায় নির্মাণ করেন বেড়ার তরুণ চিত্রশিল্পী বিপ্লব দত্ত।
বেড়া ছাড়াও পার্শ্ববর্তী উপজেলার বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা স্মৃতিস্তম্ভটি দেখতে প্রায় প্রতিদিন বিকালে এখানে ভিড় জমায়। স্মৃতিস্তম্ভটিতে নান্দনিক সৌন্দর্যে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ‘৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ‘৬৬-এর ছয় দফা, ‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ‘৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে বাঙালির নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা, ৭ মার্চে ‘৭১ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাক এবং একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস উঠে। স্মৃতিস্তম্ভটি দেখে শহীদদের অবদানের কথা স্মরণ করে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। এখানেই শায়িত আছেন এ উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেক। ২০১৫ সালে এ ভাস্কর্যের নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং ২০১৬ সালে এটি উদ্বোধন করা হয়। বর্তমানে অন্যায়ের প্রতিবাদের মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠেছে এ ভাস্কর্যটি।
বেড়া বিবি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক গিয়াস উদ্দিন আহমেদ বলেন, এ রকম একটি স্মৃতিস্তম্ভ থাকলে নতুন প্রজন্ম দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হবে। দেশের বীরদের গৌরবগাথা জানতে পারবে।
স্থপতি বিপ্লব দত্ত বলেন, বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে পৃথিবীর মানচিত্রে নতুন করে জন্ম নেওয়া একটি স্বাধীন দেশ। এ দেশের মানুষ স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছেন। যুদ্ধ করেছেন ভাষার জন্য। অস্তিত্ব, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সম্প্রীতির জন্য সংগ্রাম করেছেন। নতুন প্রজন্ম এ সংগ্রাম দেখেনি। তাই বাংলার সঠিক ইতিহাস ও সংগ্রামের বিভিন্ন দিক বিশেষভাবে তুলে ধরাই আমার তৈরি ভাস্কর্যের মূল থিম। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতার চেতনাকে প্রবাহিত করা এবং চোখের সামনে বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধকে ফুটিয়ে তোলার জন্যই আমি আমার সর্বোচ্চ শ্রম দিয়ে নিজের জন্মস্থান পাবনার বেড়া এলাকায় ৩টি ভাস্কর্য নির্মাণ কাজ করেছি। নিজের এলাকায় এ রকম কাজ করতে পেরে আমি নিজেও গর্ববোধ করছি।