আলাউল হোসেন, কাশিনাথপুর : কোন কাজই ছোট নয়। আমাদের যে কোন কাজকে বড় করে দেখার মানুষিকতা নাই- এটা আমাদের দেশের বেকারত্ব সমস্যার অন্যতম কারণ। রসায়ন শাস্ত্রে অনার্সসহ মাস্টার্স পাশ করা তৌহিদুল ইসলাম শাকিল এমনটাই মনে করেন। পাবনার বেড়া উপজেলার মাশুন্দিয়া কলেজ বাজারে চায়ের দোকান রয়েছে তৌহিদুল ইসলাম শাকিলের। চা বানিয়ে নিজেই পরিবেশন করেন তিনি। চায়ের দোকানি হলেও সবাই শাকিলকে সম্মান করেন তার শিক্ষাদীক্ষার কারণে। তিনি স্থানীয় একটি নৈশ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতাও করছেন খণ্ডকালীন। তিনি প্রমাণ করেছেন, কোনো কাজই ছোট নয়। ফলে আমিনপুর থানাধীন প্রতিটি অঞ্চলের মানুষের কাছে শাকিল এখন অনুপ্রেরণার প্রতিক।
স্কুল-কলেজে শিক্ষকতা করার স্বপ্ন নিয়ে এনটিআরসিএ কর্তৃক শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষাতেও উত্তীর্ণ হয়েছেন শাকিল। তার বিশ্বাস- চাকরী তার হবেই। তবে তিনি এক মুহূর্তের জন্যও অলস সময় কাটাতে পছন্দ করেন না। তাই তিনি সকাল-বিকাল চায়ের দোকানে বসেন।
শাকিলরা তিন ভাইবোন। অন্য দুই ভাই-বোনও পাবনার সরকারি এডওয়ার্ড কলেজে স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে পড়াশোনা করছেন। বাজারের ছোট চায়ের দোকানটি তাদের আয়ের একমাত্র ভরসা। চায়ের দোকান ও শিক্ষকতা থেকে যে আয় হয়, তা দিয়েই চলে সবার পড়াশোনা ও সংসারের খরচ।
শাকিলের বাবা মজিদ মোল্লা একসময় পরিবহনশ্রমিকের কাজ করতেন। প্রায় ১২ বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হন তিনি। সংসার চালাতে তিনি বাজারে ছোট একটি চায়ের দোকান দেন। শাকিল তখন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। ওই সময় থেকেই তিনি বাবাকে চায়ের দোকান চালাতে সাহায্য করে আসছিলেন। এক দিকে বাবার সঙ্গে চায়ের দোকান চালানো আর অন্য দিকে পড়াশোনা। এভাবেই তিনি বিজ্ঞান বিভাগে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। এরপর রসায়ন বিষয়ে বিএসসি সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি হন পাবনার সরকারি এডওয়ার্ড কলেজে। সেখানে পড়াশোনা করার ফাঁকে বাবার সঙ্গে চায়ের দোকানটি তিনি চালিয়ে গেছেন।
অনার্স পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়ার পর শাকিল চায়ের দোকানে কাজের সময় আরও বাড়িয়ে দেন। পাশাপাশি তিনি স্থানীয় রতনগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে বিজ্ঞানের শিক্ষক (খণ্ডকালীন) হিসেবে চাকরি নেন। বছর দুয়েক সেখানে শিক্ষকতা করার পর তিনি নিজের পড়াশোনার সুবিধার্থে আমিনপুর থানাধীন দয়ালনগরে অবস্থিত সিনথী পাঠশালা নামে একটি নৈশ বিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছেন। এছাড়া সকাল ১০টা থেকে বেলা ১টা এবং বিকেল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত তিনি চায়ের দোকানটি চালান।

শাকিল বলেন, একসময় কেউ কেউ আমার চা বানিয়ে বিক্রি করার বিষয়টি বাঁকা চোখে দেখতেন, কিন্তু এখন অনেকেই বাহবা দেন। বর্তমানে আমি খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করছি। অবসরে চায়ের দোকানটিও চালাচ্ছি। আমার কাছে দুটি কাজই সম্মানজনক। ভবিষ্যতে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্থায়ী চাকরির সুযোগ পেলে সেটিই হবে আমার একমাত্র পেশা। তার মতে, কাজ না করে বেকার বসে থাকাটা শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবার জন্যই অসম্মানের।
শাকিলের দোকানে নিয়মিত চা পান করতে আসেন মাশুন্দিয়া ভবানীপুর কে.জে.বি ডিগ্রি কলেজের কয়েকজন শিক্ষক। তারা বলেন, শাকিল সব ধরনের সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে ওঠা অসম্ভব পরিশ্রমী এক তরুণ। কোনো কাজই যে ছোট নয়, তা তিনি প্রমাণ করে দিয়েছেন। শিক্ষিত-অশিক্ষিত বেকার তরুণদের জন্য তিনি অবশ্যই অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। তারা আরও বলেন, শাকিল হয়তো অচীরেই তার শিক্ষক হবার স্বপ্ন পূরণ করবেন। কিন্তু কিছু সময়ের জন্য হলেও তিনি কাজকে ভালোবেসে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করছেন, তা যেন এলাকার শিক্ষিত-অশিক্ষিত বেকার-যুবকদের জন্য অনুকরণীয়-অনুসরণীয় হয়ে ওঠে।