আবদুল্লাহ আল মোহন :
ডা. মো. ফজলে রাব্বি মিয়া, মানবতার মহান একজন মানুষের মুখ। আমাদের পাবনার বেড়া-সুজানগর-সাঁথিয়া অঞ্চলে যিনি গরিবের চিকিৎসক, পরম স্বজন হিসেবে বাচ্চু ডাক্তার নামেই সমধিক পরিচিত। তাঁর অকৃত্রিম জনসেবার কারণে আমার কাছে তিনি অলিখিত উপন্যাসের একজন জীবন্ত কিংবদন্তি নায়ক চরিত্র। মাদার তেরেসার মতই তাঁর মানবসেবাও ভালোবাসার কাছেই কেবল দায়বদ্ধ বলে মনে হয়েছে। গ্রামের নিভৃতকোণে নিরন্তর নিরলসভাবে চিকিৎসক হিসাবে নানাভাবে সেবা দিয়ে গেলেও প্রচারের আলোয় তিনি কখনো পথ চলেননি। ফলে দেশ ও দশের কাছে তিনি অচেনাই রয়ে গেছেন, অজানা দেশসেবক, মানবপ্রেমিক হিসেবেই অজানা থেকে গেছেন।
‘মানুষ মানুষের জন্য’ গানটি অমর শিল্পী ভুপেন হাজারিকা যেন ডা. মো. ফজলে রাব্বি মিয়ার মতন আলোকিত মানুষদের জন্যেই গেয়ে ওঠেন। তাঁর প্রতিবেশি বা পাশাপাশি বাড়ি হওয়ার কারণে অনেক উদারতা, মহানুভবতার কাহিনি আমার জানা বলেই সংশয়হীনভাবে বলতে পারি, তিনি আমাদের কালের একজন সত্যিকারের নায়ক। বারবার তাঁর মুখের পানে তাকালেই আমি বিস্মিত হই, হয়ে খেয়াল করি, যেন মহান লেখক ঋষি টলস্টয়ের সামনেই দাঁড়িয়ে আছি আমি।
পরম শ্রদ্ধেয় স্বজন, মানবতাবাদী মহান এই সুচিকিৎসকের কথা মনে হলেই, দেখা পেলেই আমার মনের ক্যানভাসে বারবার কেন যেন ‘সপ্তপদী’ উপন্যাসের-সিনেমার অমর মানবপ্রেমিক চিকিৎসক, নায়ক কৃষ্ণেন্দু কিংবা উত্তম কুমারের মুখটিই ভেসে ওঠে, মনে পড়ে। আর তাই আমি খুব তীব্রভাবে অমর কথাশিল্পী তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়কেও অনুভব করি। তিনি বেঁচে থাকলে আমাদের কালের মনে রাখবার মতন এই মহান মানব প্রেমিক, নির্লোভ সুচিকিৎসক ডা. মো. ফজলে রাব্বি মিয়াকে নিয়ে নিশ্চিতভাবেই আরেকটি অমর কথাকাহিনি রচনা করতেন। কারণ ‘সপ্তপদী’ তো তাঁর দেখা চরিত্রকে কেন্দ্র করেই বিরচিত। ডা. মো. ফজলে রাব্বি মিয়াকে যারা চেনেন, জানেন, তাঁদের সকলেই সংশয়হীনভাবে আমার সঙ্গে একমত হবেন যে, পাবনার আমার এলাকার দরিদ্রজনের চরম দুঃসময়ের একান্ত আপনজন, বন্ধু ডা. মো. ফজলে রাব্বি মিয়া। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই তাঁকে যতই দেখছি, জানছি ততই ভালোবেসে ফেলছি, তাঁকে জানা যেন আমার ফুরায় না।
এবারের ঈদের ছুটিতে পাবনার নগরবাড়ির গ্রামের বাড়িতে সবচেয়ে বড় পাওনা ডা. মো. ফজলে রাব্বি মিয়া, যিনি সম্পর্কে আমার ভাই হন, দীর্ঘদিন পর তাঁর একান্ত সান্নিধ্য লাভ। বয়সের কারণে তিনি এখন ঢাকায় তাঁর সন্তানদের সঙ্গে বসবাস করছেন বলে এলাকার দুঃস্থজনেরা তাঁর সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তাঁর স্মৃতিশক্তিও আর আগের মত সবল নেই। অথচ এই মানুষটিই সময়ে-অসময়ে গ্রামের মেঠোপথে পায়ে হেঁটে-সাইকেল চালিয়ে কিংবা দুর্গম চরাঞ্চলে চষে বেড়িয়েছেন সুচিকিৎসা দিতে। কখনো কোন রোগীর কাছ থেকে চেয়ে ফি নেননি। উল্টো রোগীর জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ-পথ্য-পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা করেছেন নিজের টাকায়। কেউ খুশি হয়ে গাছের ফলমূল দিলে তিনি তাও সাধারণত গ্রহণ করতে বিব্রতবোধ করতেন।
ডা. মো. ফজলে রাব্বি মিয়ার প্রায় মধ্য যৌবনে শিশু সন্তানদের রেখে স্ত্রী মারা গেলে তিনি আর বিয়ে করেননি।সহস্র প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েই যুগপৎভাবে পিতা এবং মাতার মমতায় সন্তানদের মানুষ করেছেন। তাঁর সন্তানদের সকলেই এখন সমাজে, দেশে-বিদেশে প্রতিষ্ঠিত। আবার তাঁর বাড়িতে অনেক ছেলেমেয়ে জায়গীর থেকেও স্থানীয় স্কুল-কলেজে লেখাপড়া করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দরিদ্র রোগীর অসহায় আত্মীয়-স্বজনকে নিজের আপনজন ভেবে নিজ বাড়িতে, নাটিয়াবাড়ির বাড়িতে স্থান দিয়েছেন। তিনি ব্যক্তিগত লোভ-লালসা-সুখের অসুখে কখনো ভুগেছেন বলে মনে হয়নি। সম্পদের মোহ গরিবের ডাক্তারকে কখনো কাবু করেনি।
তাঁর কাছ থেকে শেখার আছে অনেককিছু। আমার মতন অনেকের কাছেই তিনি কেবল মানবতার পাঠই নয়, সদা অমায়িক হাসিমাখা মুখ, বিনয়, ভদ্রতা, সৌজন্যতা শিক্ষারও একজন অনুকরণীয় মানুষ, রোল মডেল হয়ে ওঠেন তিনি। বর্তমানকালের চিকিৎসকদের সেবা প্রদানের নানান সমালোচনাকালে আমার কেবলই পরম এই প্রিয়জনের মুখটি মনের আকাশে ভেসে ওঠে।
আমাদের রাষ্ট্রের উচিত তাঁর মতন মনে রাখবার মতন মানুষদের খুঁজে বের করে যথাযথভাবে সম্মানিত করা, বিরল দৃষ্টান্ত হিসেবে ভবিষ্যত প্রজন্মের সামনে তুলে ধরার ব্যবস্থা করা। জানি না তেমন কারো চোখে আমার এ লেখাটি পড়বে কিনা, তাঁকে সম্মানিত করে আসলে নিজেদেরই গৌরবের অংশীদার করার সুযোগ কেউ নেবেন কি না জানি না। তবুও কবীর সুমনের ভাষা ধার করে উচ্চস্বরে বলতে মন চায়, ‘স্বপ্ন দেখার ইচ্ছে আমার আজো যে গেলো না…’।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ভাসানটেক সরকারী কলেজ, ঢাকা