গোলাম মাহবুব, নিজস্ব প্রতিনিধি (আমিনপুর) : প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস সংক্রমণের ভয়ে কাজ হারিয়ে বেড়া উপজেলার হাজার হাজার দিনমজুর ও হতদরিদ্র মানুষ চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছেন। এসব মানুষ বেকার সময় পার করছেন। অনেকের ঘরের সঞ্চিত খাবার শেষ হয়ে গেছে। নেই গচ্ছিত টাকা। দিন কাটছে অর্ধাহারে-অনাহারে। এ কারণে আর ঘরে থাকতে চাইছেন না তারা। ইতিমধ্যেই ঘর ছাড়তে শুরু করেছে অনেকেই।
এদিকে, ত্রাণের দাবিতে বিভিন্ন ইউপি কার্যালয়, ইউপি সদস্যের বাসভবন ও অফিস, গ্রাম প্রধানদের বাড়ির সামনে হতদরিদ্র শ্রমজীবী নারী-পুরুষ ভিড় করছেন। কেউ কেউ ত্রাণ পেলেও অনেককেই আশ্বাস নিয়েই ফিরে যেতে হচ্ছে।
বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী বেড়া উপজেলায় ৯টি ইউনিয়নে মোট ২,৫৬,৭৫৩ জন (জাতীয় তথ্য বাতায়ন ২০১০ এর শুমারী অনুযায়ী) মানুষ বাস করে। এর মধ্যে প্রায় ৫০ হাজরের বেশি রয়েছেন রিকশা, ভ্যান, ইজিবাইক, নসিমন, করিমন চালক, বিভিন্ন যানবাহনের হেলপারসহ নিম্ন আয়ের দিনমজুর।
বেড়া উপজেলার আমিনপুর থানাধীন মাশুন্দিয়া মধ্যপাড়া গ্রামের বাসিন্দা রিকশাচালক মো. শাহিন সরদার আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমার চার জনের সংসার। করোনার কারণে মানুষ রাস্তায় বের হচ্ছেন না। ঠিকমতো ভ্যান চালাতে পারছি না। গত সপ্তাহে বাঁধের হাটে ওষুধ কিনতে গিয়ে পুলিশের লাঠিচার্জে নিজেও অসুস্থ হয়ে বেকার ঘরে বসে আছি। ঘরে খাবার নেই। ঘরে যে সঞ্চয় ছিল তা এরই মধ্যে শেষ হয়ে গেছ। এভাবে আর কয়দিন চলবে, করোনায় মরা লাগবে না, পেটে না খেয়েই মরে যাব।
উপজেলার শানিলা গ্রামের ষাটোর্ধ্ব অপর এক রিকশাচালক বলেন, ‘মার্কেট বন্ধ। মুদির দোকানপাট খোলা থাকলেও তা প্রায় ক্রেতাশূন্য। কোনো গাড়ি চলছে না। মানুষ বাইরে বের হচ্ছেন না। কোনো ভাড়া নেই। অথচ চাল-ডাল-শাক-সবজি-মাছ সবকিছুর দাম বেড়ে গেছে। কেউ কোনো সাহায্যও করছেন না। সংসার চালাতে পারছি না।’
জাতসাখিনী ইউনিয়নের নয়াবাড়ি গ্রামের ভ্যানচালক রতন বলেন, ‘চাল-ডাল দেওয়ার কোনো খোঁজ নেই। শুধু সচেতন হইতে বলে। এ কথা শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেছে। আমরা যারা না খেয়ে আছি। কেউ এসে দু’বেলা খোঁজ নিলো না- কী খেলাম, না খেলাম। শুধু মুখ বাঁধতে কয়। পেটে খাবার না থাকলে শুধু মুখ বেঁধে কী হবে?’
এই একই রকম অবস্থা বেড়া উপজেলার প্রান্তিক জনপদের শ্রমজীবী মানুষদেরও। আমিনপুরের এক দিনমজুর বলেন, সারাদিন কিছু মানুষ রাস্তাঘাটে শুধু ওষুধ ছিটায়, আরে ব্যাটারা ওষুধ ছিটাইয়া কী হইব? পেটে খাবার দাও। ওষুধ নিয়ে নিজের বাড়ি ছিটাও গে।
এদিকে গত তিন দিনেও বেড়া উপজেলার হতদরিদ্র বহু মানুষ বিভিন্ন ইউপি কার্যালয়ের কোনো সাহায্য পাননি। তারা ত্রাণ দেওয়ার জন্য দাবি জানান। এসময় বিভিন্ন ইউপি সদস্যরা সামনে এসে তাদের সঙ্গে কথা বলে ত্রাণ দেওয়ার আশ্বাস দেন। এছাড়া নাম ঠিকানাসহ তাদের তালিকা লিপিবদ্ধ করেন।
এ বিষয়ে বেড়া উপজেলার মাশুন্দিয়া ইউপি চেয়ারম্যান মো. মিরোজ হোসেনের সাথে মুঠোফোনে কথা বললে তিনি জানান, “আমি আমার ইউনিয়নে ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রায় ১৫০০ পরিবারকে কিছু ত্রাণ (প্রত্যেক পরিবারের জন্য পাঁচ কেজি চাউল, ১ কেজি আলু, ১ কেজি ডাউল ও ১ কেজি খাবার তেল) প্রদান করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। ইতোমধ্যে কিছু বিতরণ করা হয়েছে এবং বাকিগুলোও পর্যায়ক্রমে বিতরণ করা হচ্ছে। এছাড়াও আমার ইউনিয়নের জন্য ৩১০ পরিবারের জন্য প্রাথমিকভাবে ১০ কেজি করে চাউল সরকারি ত্রাণ তহবিল থেকে এসেছে, যা পর্যায়ক্রমে বিতরণ করা হচ্ছে। আরও ৩০০ পরিবারের নামের তালিকা চাওয়া হয়েছে এবং তালিকা প্রস্তুতের কাজ চলছে। যদি কোন হতদরিদ্র ব্যাক্তি আমার তালিকায় বাদ পড়ে, খোঁজ পেলে তা সংগ্রহ করে বিতরণ করা হবে।” সরকারি ত্রাণ বিতরণের স্বচ্ছতার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন “আমার শরীরে এক বিন্দু রক্ত থাকতেও আমি ত্রাণ বিতরণে কোন অনিয়ম করব না বা সহ্যও করব না।”
উপজেলার রুপপুর ইউপি চেয়ারম্যান আবুল হাশেম উজ্জ্বলের সাথে মুঠোফােনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, বেড়া উপজেলা আওয়ামীলীগের পক্ষ থেকে আমার ইউনিয়নে ১২৯ জনকে ত্রাণ দিয়েছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে আমার ইউনিয়নের অসহায় ৫০০ পরিবারকে ত্রাণ দিচ্ছি। সরকারিভাবে আমার ইউনিয়ন পরিষদ থেকে তালিকাভূক্ত ৩১০ জন দুঃস্থ ও অসহায়ের মাঝে ত্রাণ বিতরণের কাজ শুরু করেছি। প্রায় প্রতিদিনই আমার ইউনিয়নে ত্রাণ বিতরণ চলছে। আমার ইউনিয়নে কেউ না খেয়ে থাকবে না- চেয়ারম্যান হিসেবে আমি ঘোষণা করছি।
এ খবর লেখার সময় জাতসাখিনী, পুরাণভারেঙ্গা ও নতুনভারেঙ্গা ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তারা ফোন রিসিভ করেননি। ওই সব ইউনিয়নসমূহে সঠিকভাবে ত্রাণ বিতরণ হয়েছে কি-না তা এখন পর্যন্ত সঠিক কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে অনেকেরই অভিযোগ রয়েছে এ ব্যাপারে। সঠিক সময়ে যত দ্রুত সম্ভব ত্রাণের সামগ্রী হত দরিদ্রদের নিকট পৌছানোর জন্য দাবি জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বেড়া উপজেলার সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা নানারকম পোস্ট শেয়ার করছেন বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে ।
কাশিনাথপুর থেকে বুলবুল সৈয়দ নামের এক স্কুল শিক্ষক তার ফেসবুকে লেখেন, যেহেতু এখনও সবার কাছে ত্রাণ পৌঁছায়নি, সেহেতু ভ্যান চালকদের তালিকা তৈরি করে প্রত্যেককে দিনের কিছু সময় ন্যূনতম আয়ের সুযোগ দেওয়া দরকার। নতুবা পরিবার-পরিজন নিয়ে ওরাও পথে বসতে বসেছে।
কাশিনাথপুর মহিলা ডিগ্রি কলেজের বাংলা বিষয়ের প্রভাষক মাসুদ রানা বলেন, ত্রাণ সামগ্রী বিতরণের ক্ষেত্রে যেন কোন অনিয়ম না হয়। প্রকৃতপক্ষেই যারা হতদরীদ্র তারাই যেন ত্রাণ পান।
এডভোকেট শামসুল হক টুকু-অধ্যাপক লুৎফুন্নেছা ফাউন্ডেশনের সেক্রেটারী ডা. আমিরুল ইসলাম সানু বলেন, উপজেলার কোথাও যদি ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম হয় এবং কোন অসহায় মানুষ ত্রাণের অভাবে না খেয়ে থাকে, তবে আমাদের জানালে আমরা আমাদের দিক থেকে তার কাছে ত্রাণ পৌঁছানোর ব্যবস্থা করব। উপজেলায় কেউ না খেয়ে থাকবে সেটা আমরা চাই না।
আমাদের সময় পত্রিকার বেড়া উপজেলা প্রতিনিধি ও আমিনপুর থানা প্রেসক্লাবের সেক্রেটারী আলাউল হোসেন বলেন, দিন এনে দিন খাওয়া মানুষেরা পড়েছে সীমাহীন দুর্ভোগে। এমন অবস্থায় হতদরিদ্র পরিবারের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে সরকার, জনপ্রতিনিধি, বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও বিত্তবান ব্যক্তিরা। তবে সেটা কোথাও কোথাও সুশৃংখল নয়, বরং জনসম্পৃক্তারই একটা অংশে দাঁড়িয়েছে।
আমিনপুর থানা প্রেসক্লাবের সভাপতি হাফিজুর রহমান হাফিজ বলেন, ইতোমধ্যে কিছু এলাকায় ত্রাণ বিতরণ শুরু হয়েছে। সংবাদকর্মী হিসেবে আমাদের কাছেও বেশ কিছু অভিযোগ এসেছে। অনেক ইউপি চেয়ারম্যান নিজেরা যাচাই-বাছাই ছাড়াই শুধুমাত্র নেতাকর্মীদের ওপর ত্রাণ বিতরণের দায়িত্ব ছেড়ে দেয়ায় অনেক হতদরীদ্র ত্রাণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। জনপ্রতিনিধিদের এ বিষয়ে আরও সচেতন হতে অনুরোধ করেন তিনি।
চলমান পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন শৃংখলা রক্ষায় ও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতের জন্য কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেন। মানবিক সহায়তা কর্মসূচিকে সুন্দর, সুশৃঙ্খল ও সুসমম্বিত করার লক্ষ্যে দূর্যোগ বিষয়ক স্থায়ী আদেশবলি (এসওডি) অনুযায়ি করোনা পরিস্থিতিতে মানবিক সহায়তা প্রদানের আগে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কোথায়, কখন, কতটি পরিবারকে (নামের তালিকাসহ) কী ধরনের ত্রাণ সহায়তা করতে চান তা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করে উপজেলা বা জেলা প্রশাসনকে অবহিত করলে অসহায় কোন পরিবারের বাদ পড়ার সম্ভাবনা থাকবে না বলে মত প্রকাশ করেছেন স্থানীয়রা।