অলোক আচার্য্য : বেড়া উপজেলার তের জমিদার বাড়ি কালের পরিক্রমায় আজ ভগ্নদশায় উপনীত হয়েছে। বেড়া উপজেলার হাটুরিয়া গ্রামে এই জমিদারির গল্প আজও লোকমুখে গল্পের মতো ঘোরে। জমিদারির পাইক-পেয়াদা, গানের আসর, পাশেই যমুনা নদীতে রাজাদের প্রমোদ তরীর কথা—এসব আজ মানুষের মুখে কেবল গল্প।
একসময় এ গ্রামে তেরজন জমিদার বাস করতেন। তাই এই গ্রাম তের জমিদারদের গ্রাম হিসেবে পরিচিত। তবে এই তের জমিদারের ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে অনেকটাই অজানা। বর্তমানে ভাঙাচোরা পলেস্তারা খসা দালান আর কয়েকটি পুকুর ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। গ্রামটি উপজেলা শহর থেকে একটু ভেতরে হওয়ায় গ্রামটির অবস্থাও তেমন সুবিধাজনক নয়। সব মিলিয়ে জমিদারদের এই গ্রাম আজ অনেকটাই উপেক্ষিত। এলাকার প্রবীণ ব্যক্তিদের কাছ থেকে জানা গেছে, একসময় ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্র ছিল এই হাটুরিয়া গ্রাম। বড় বড় বণিকরা বাস করতো এ অঞ্চলে। গ্রামের পার্শ্ববর্তী বাণিজ্যকেন্দ্র নাকালিয়ার সাথে কলকাতার নৌপথে সরাসরি যোগাযোগ ছিল।
১০০ বছর আগে এ গ্রামে দুই-একজন জমিদারের বাস ছিল। পরে এখানে জমিদারদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। একসময় এ সংখ্যা দাঁড়ায় তেরতে। তেরজন জমিদার হলো প্রমথনাথ বাগচী, কাঞ্চীনাথ বাগচী, উপেন্দ্রনাথ বাগচী, ভবানীচরণ বাগচী, কালী সুন্দর রায়, ক্ষীরোদ চন্দ্র রায়, সুরেন চন্দ্র রায়, সুধাংশু মোহন রায়, শক্তিনাথ রায়, বঙ্কিম রায়, ক্ষুদিরাম পাল, যদুনাথ ভৌমিক ও যতীন্দ্রনাথ ভৌমিক। এলাকার প্রবীণ ব্যক্তিদের মতে, এ জমিদারদের বসবাসের সময়কাল ছিল আনুমানিক ১৯১৫ সাল বা এর পর থেকে। জমিদারি প্রথা বাতিল হওয়ার আগ পর্যন্ত তারা এ গ্রামেই জমিদারি পরিচালনা করতেন।
জমিদারদের প্রত্যেকেই বাস করতেন প্রাচীরঘেরা অট্টালিকায়। অট্টালিকার পাশেই ছিল শান বাঁধানো ঘাট। সংরক্ষণ ও সংস্কারের অভাবে বর্তমানে বেশিরভাগ পুকুরই ভরাট হয়ে গেছে। যে কয়েকটি অবশিষ্ট রয়েছে তার অবস্থাও করুণ। একইরকম অবস্থা বড় বড় অট্টালিকাগুলোর। মালিকানা বদলের পর কিছু অট্টালিকা ভেঙে ফেলা হয়েছে। কিছু কিছু যত্নের অভাবে ভেঙে গেছে। সাক্ষী হিসেবে গ্রামে এখনও দু-তিনটি অট্টালিকার ভগ্নাবশেষ আজও রয়ে গেছে। জরাজীর্ণ এসব অট্টালিকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাস করছেন কয়েকটি পরিবার। এমনি একটি পরিবার দ্বিতল অট্টালিকায় বসবাস করা দিলীপ গোস্বামীর পরিবার। অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে ইজারা নিয়ে তারা বসবাস করছেন। দিলীপ গোস্বামীর ছেলে দীপক গোস্বামী জানান, অট্টালিকার এক স্থানে এর নির্মাণকাল ১৯১১ সাল এবং নির্মাতা হিসেবে জমিদার ক্ষীরোদ চন্দ্র রায়ের বাবা উমেশ চন্দ্র রায়ের নাম খোদাই করা ছিল। তিনি ছেলেবেলায় এখানে সুপরিসর জলসাঘরসহ অনেক কক্ষ দেখেছেন। হলরুমে ক্ষীরোদ চন্দ্র রায়ের পূর্বপুরুষের ছবি ছিল। জলসাঘরসহ সব কক্ষই জরাজীর্ণ। ছবিগুলোও নষ্ট হয়ে গেছে। ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও তারা এখানে বসবাস করছেন বলে জানা গেছে।
গ্রামের বিভিন্ন সমস্যার কথা স্বীকার করে হাঁটুরিয়া নাকালিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সমস্যাগুলো সমাধানের পাশাপাশি বিলীন হতে বসা ঐতিহ্যগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হবে।