Sunday, ডিসেম্বর ১০, ২০২৩
শিরোনাম
ডলি সায়ন্তনীকে নির্বাচনে চান পাবনার সংস্কৃতিকর্মীরাওনার্স পরিচয় দেন ডাক্তার, দিচ্ছেন সর্ব রোগের চিকিৎসাডলি সায়ন্তনীর প্রার্থীতা ফেরার অপেক্ষায় সুজানগর, আমিনপুরের মানুষঅবহেলা অব্যবস্থাপনায় অকার্যকর পাবনার সেচ উন্নয়ন প্রকল্প, বিপাকে কৃষকসাঁথিয়ায় ভোটার হালনাগাদকারীদের পাওনা দিতে গরিমসি করছেন নির্বাচন অফিসারআটঘরিয়ায় গলায় ফাঁস দিয়ে গৃহবধূর আত্মহত্যা, স্বামী আটকসাঁথিয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রবেশ পথে মন্দির নির্মাণ করার চেষ্টা ॥ জনমনে অসন্তোষসাঁথিয়ায় চলাচলের রাস্তায় বেড়া,অবরুদ্ধ ১৬ পরিবারআটঘরিয়ায় বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট উদ্বোধনবেড়ায় পাট ক্ষেত থেকে ভ্যান চালকের লাশ উদ্ধার

খোলা বইয়ে পরীক্ষা কেন?

শেয়ার করতে এখানে চাপ দিন

রেজাউল করিম শেখ

এক.
মুখস্ত বিদ্যায় পাঠ্যবইয়ের সাথে শিক্ষার্থীদের প্রকৃত অর্থে কোনো সংযোগ থাকে না। এর প্রমাণ আমাদের দেশের সকল সেবা খাতের বেহাল দশা। খোলা বইয়ে পরীক্ষা নেওয়ার ধারণা পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হলে পাঠ্যেবইয়ের প্রতি ব্যাপক মনোযোগ আকর্ষিত হবে। কারণ এখানে প্রশ্নপত্র প্রণয়নে বুদ্ধির ছাপ থাকে। বই ও বাস্তব জীবনের ঘনিষ্ট সম্পর্ক তৈরী হওয়ার কৌশল থাকে। উদাহরণের সার্বজনীনতা বাদ দিয়ে পরিচিত পরিবেশ স্থান পায়। পাঠের উদ্দেশ্য এবং ফলাফল যা হওয়া উচিত তার প্রায়োগিক দিক বেশি প্রাধান্য পায়। যেহেতু বই দেখে লেখার সুযোগ রয়েছে তাই শিক্ষার্থীরা সঠিক উত্তর লিখতে বারবার পড়তে থাকে নির্দিষ্ট পাঠ। অনেক মুক্ত চিন্তার প্রশ্ন থাকে, যেহেতু সে যেকোনো মাধ্যম হতে উত্তর সংগ্রহ করতে পারে এবং ভাবতে হয় ফলে তার জ্ঞান-ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করে।
‘আমার ঘর, আমার ইস্কুল’ কার্যক্রমের মাধ্যমে শিখা একাডেমির শিক্ষার্থীরা এর সুফল পাওয়া আরম্ভ করেছে। প্রাপ্ত তথ্য বলছে, একজন শিক্ষার্থী এক নম্বরের একটি প্রশ্নোত্তর খুঁজতে একটি তিন পৃষ্ঠার গল্প পাঁচবার পড়েছে! এখন তার গল্পটি নিশ্চয় ভালো বুঝতে সহায়ক হবে। একটি বড় ব্যাপার হলো, এর পূর্বে সে পড়ে না থাকলেও এখন পড়া হয়ে গেল।
জ্ঞান বইয়ের অক্ষরকে অতিক্রম করে মস্তিষ্কে স্থান করে নিচ্ছে। ভাবনা ও চিন্তার দুয়ার খুলে বুদ্ধির বিকাশ তরাণ্বিত হচেছ। শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা ভীতি, পড়া ভীতি দূর হচেছ। অযথা ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর পরিবার, প্রতিষ্ঠান ও সমাজের চাপ কমছে শিশুর উপর হতে। যা সত্যিই তার আনন্দ ও বড় হয়ে উঠার সহজ পথ। পড়াটা হচ্ছে খোঁজার- সবচেয়ে মূল্যবান বস্তু খোঁজার। এখানে মূলমন্ত্র হলো- খুঁজলেই পাবে।
তারা সত্যিই মহৎ হৃদয়ের চিন্তাশীল অনুসন্ধানী মানুষ হবে।

দুই.
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও পরিচালনা ছিলো আমার স্বপ্ন, সাধ ও কাজ। খুব অল্প বয়সে যখন প্রিয় ঢালারচর ছেড়ে সাগরকান্দি মামার বাড়িতে চলে আসি মূলত পড়ার জন্য, তখন ভেতরে ভেতরে আমি ঢালারচরেই রয়ে গেছিলাম। মনের পথ ধরে হেঁটে যেতাম প্রিয় বাড়ি থেকে প্রিয় মেঠোপথ পেরিয়ে প্রিয় ইস্কুলে। কিন্তু ঢালারচরে তখন মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিলো না, আরো দেখলাম এইদিকে যেমন সুন্দর সুন্দর ইস্কুল ওু ভালো ভালো শিক্ষক আছেন ওদিকে নেই। তারপর পত্র-পত্রিকা ও ইসলামি বই-পত্র পড়ে, ঋষি-মুনিদের জীবনী পড়ে শিক্ষা নিয়ে কেমন এক ঘোর তৈরী হলো। সপ্তম শ্রেণিতেই স্বপ্ন দেখা শুরু করলাম, একটি বিদ্যানিকেতন হবে- কুরআন, হাদিস, বিজ্ঞান আর সাহিত্য সমৃদ্ধ পড়াশোনা হবে। এখনও মাঝে মাঝে সেই সময়ের ডায়েরি নেড়েচেড়ে দেখি। নিজের ভেতরে নিজেই হেঁটে বেড়াই।
দিন যতোই বেড়েছে সমাজ ও সমাজস্থ মানুষের বিপরীত মুখী মনোভাব স্পষ্ট হতে দেখেছি। প্রতিজন প্রতিজনকে হেয় ও তুচ্ছ করার প্রয়াস দেখেছি। ক্রমান্বয়ে অপরের ক্ষতির কারণ হতে দেখেছি। রাজনীতি ও সমাজনীতি কেবল প্রতিহিংসার ও জিঘাংসার হতে দেখেছি। তারপর আর সবার মতো দুর্নীতি দূর্বৃত্তায়ন দেখেছি। ক্লাস ফাঁকি দেওয়া, অপ্রয়োজনীয় বই পাঠ্যতালিকায যুক্ত করে অবৈধ অর্থ উপার্জন ইত্যাদি নানাভাবে শিক্ষকদের অনৈতিক চরিত্রের সাথে পরিচিত হয়েছি। অপরদিকে বিখ্যাত ও সৃজনশীল ব্যক্তিদের জীবনী পড়ে পড়ে ভেতরে এক অন্যরকম জগত তৈরী হতে দেখেছি। এভাবে ইস্কুল জীবনে নানা কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়ে পড়লাম। ইস্কুলে যুব কমিটি গঠন, বিতর্ক-কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন ইত্যাদি করতে থাকলাম। এখন যে সাগরকান্দি রিয়াজ উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির জন্য জরিমানার টাকা গুণতে হয়- সেটাও আমার প্রস্তাব ও সেই সময়ের ক্লাস ক্যাপ্টেন এর নিয়ে প্রণীত নীতিমালার ফসল। যদিও এ নিয়ে এখন শিক্ষক ও ব্যবস্থাপনা কমিটি বাণিজ্য করায় খুব অপরাধ বোধ কাজ করে। কিন্তু তখন সত্যিই কাজে দিয়েছিলো ইতিবাচকভাবে। কারণ যখন ক্লাস না হওয়া আমরা ও শিক্ষকবৃন্দ একরকম মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেলাম, তখন শিক্ষকগণের কথা ছিলো – ছাত্রছাত্রী না থাকলে বা না আসলে ক্লাস হবে কেমনে? সেই সময়েই এই ভাবনা ভেবে এসে পরের দিন ক্লাসে উপস্থাপন করলাম, সকলের সম্মতিতে প্রধান শিক্ষক ও অন্যান্য শিক্ষকদের সই নিয়ে নোটিশ আকারে টাঙিয়ে দিলাম। এই সকল নিয়ে পরবর্তীতে বলা যাবে। আজ এটার স্মরণের উদ্দেশ্য হলো- আমরা সত্যিকারেই একটা প্রয়োজনীয় শিক্ষার দ্বার উন্মোচন করতে চাই। মানুষের যা কাজে দেবে। তা না হলে কেন হুদাই কোনো সরাসরি মানে আর্থিক মুনাফার সম্ভাবনা যে খাতে নেই, সেখানে এতো এতো অর্থ ঢালবো কেন? আমার ও শিখা একাডেমির আরো কয়েকজন প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্যের সাকূল্যে প্রায় দশ লাখ টাকা গেছে। পরে আরো কয়েকজন সুহৃদের অর্থও যুক্ত হয়েছে, হচ্ছে। এখনো প্রায়ই টাকা দিতে হয় আমাদের এ প্রতিষ্ঠানে।
এইকথা বলার উদ্দেশ্য স্পষ্ট- তা হলো কেন ও কী কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করেছি ও অন্যদের কোথায় আলাদা হবে তার একটি ইঙ্গিত রাখা। এখানে যদি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় সহযোগিদের প্রতি কৃতজ্ঞতা না জানা তা বেমানান হয়। সত্যিই খুবই কৃতজ্ঞ আমি এদের প্রতি।

তিন.
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে পরিচালনার অভিজ্ঞতা পাঁচ বছর হয়েছে। এর মধ্যে নানা চরাচর অতিক্রম করেছি। বিপুল বিস্ময়ে মানুষের নানা রকম বোধ, বিশ্বাস ও কর্মকাণ্ড দেখেছি। ইচ্ছা ও অনিচ্ছা দেখেছি। আজকের বিষয়ের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হলো অভিভাবকদের শিক্ষা ভাবনা ও চাহিদা ও পরীক্ষায় অপ্রয়োজনীয় অগ্রণীয় অনৈতিক চাপ তৈরী করা। সামান্য ইস্কুল পরীক্ষায় তারা হলে বলে দিতে যায়, লিখে দিতে যায়! ইস্কুলের শিক্ষকের নিকট গৃহশিক্ষক হওয়ার প্রস্তাব নিয়ে যায়। পরীক্ষায় প্রথম হতে পারেনি বলে, ব্যবস্থাপনা কমিটি কিংবা নপম সভাপতি বা নির্বাহী পরিষদের নিকট অভিযোগ জানায়। অথচ হাতে গোনা দুই-এক জন ছাড়া কেউ আসে না বা বলে না ‘তার শিক্ষার্থী আসলে কি শিখছে- আর শেখা উচিত ছিলো’ । এটাও বলে না যে, তাদের বোধ-বুদ্ধি-সংযম ও সৃজনের শিক্ষা কতটুকু হলো! তারা কেবল সনদ আর নম্বরের বাহবা চায়! তারা তাদের সন্তানদের একটা নষ্ট প্রতিযোগিতার মাধ্যমে পৃথিবীর অনুপোযোগী করে গড়ে তুলতে চায়। ব্যথিত হয়েছি, হই- মাঝে মাঝে ক্ষিপ্তও হই। অনেককে তাড়িয়েও দিয়েছি, এ প্রতিষ্ঠানে তাদের শিক্ষা নেই বলে।
এই এদের জন্য হৃদয়ে ব্যাথাও অনুভব করি। আসলে তো তাদের শিক্ষা নেই। দোষ তো তাদের নয়। আমাদেরই আরো দায়িত্বশীল হওয়া উচিত সিদ্ধান্ত টানি।

চার.
এখন কাজের কথায় আসি। করোনাকালে একদিকে অস্থিরতা ভর করেছে। হতাশাও বেড়েছিলো। কিন্তু কী ভাবতে মনে হলো- এটা আসলে একটা প্রজন্মকে সঠিক পথে চালিত করার সুযোগ। মানে কাজ করতে হবে। শিক্ষার্থীদের নিয়ে ওদের শিক্ষা জীবন অব্যাহত করা নিয়ে ভাবতেই, প্রকৃত বাস্তব ওদের জানাতে হবে এই দায়বোধ আসতেই ঘরে ঘরে শিক্ষা পৌছে দেওয়ার ভাবনা তৈরী হলো। পরীক্ষা পদ্ধতিরও সংস্কারের ইচ্ছে হলো। মানে প্রথাগত মুখস্ত করে লেখার ইতি ঘটানোর প্রস্তাবনা তৈরী করে দিলাম নপম নির্বাহী পরিষদে। গৃহিত হলে কাজ আরম্ভ হলো বাস্তবায়নে। সে সিদ্ধান্ত ১০ মে ২০২০ তারিখের। এখন আমি ভাবছি, করোনা গেলেও কিভাবে এটা ধরে রাখা যায়। এবং নির্বাহীদের আমি প্রস্তাব করবো- আর নয় মুখস্ত, এবার হোক আত্মস্থ। মানে পরীক্ষার সময় গেটে আর কোনো বিশেষ ব্যক্তিকে পাহারাদার করতে হবে না, জানালা-দরোজা বন্ধ করতে হবে না। ইস্কুলের শিক্ষককে গৃহশিক্ষক হতে হবে না। নম্বরের প্রতিযোগিতা হবে না। প্রতিযোগিতা হবে নিজের সাথে নিজের; কে কতটুকু বুঝতে পারলো, জানতে পারলো। একাজে শিক্ষকদের যদিও চাপে পড়তে হবে। কারণ বোঝানো ও জানানোর দায়িত্ব তো তাদেরই ঘাড়ে!

পাঁচ.
পরিশিষ্টে আসি। গত ১০ জুন থেকে প্রথম পর্বের চূড়ান্ত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। একাজ সমন্বয়ের দায়িত্বে রয়েছেন নপম সহসভাপতি আরিফুল ইসলাম । প্রশ্ন প্রণয়ণ মানোন্নয়নে কাজ করছেন সাধারণ সম্পাদক রিপন আলী, অর্থ সম্পাদক আফরোজা খাতুন, নির্বাহী সম্পাদক সন্দ্বীপ ঘোষ। সুপারভাইজারের দায়িত্বে আছেন শিখা একাডেমির ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নাসিম হোসাইন, মাঠ পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের সাথে যোগাযোগ, প্রশ্ন-খাতা পৌছে দেওয়া, সংগ্রহ করার কাজ করছেন সহকারী শিক্ষক নজরুল ইসলাম, মাঠকর্মী সাগর হোসেন ও রাকিবুল ইসলাম। দাফতরিক ও মাঠ পর্যায়ের কাজে সার্বিক সহযোগিতা করছেন প্রিয় শিক্ষানবিশ কর্মী হৃদয় সরকার, আরাফাত হোসেন আরব। আর কম্পিউটার অপারেটরের বিশাল দায়িত্বে বসেছেন প্রিয় নিশান খান। ওদের প্রতি কৃতজ্ঞা জানিয়ে সমাপনে যাচ্ছি।
এই পরীক্ষার ব্যাপারে যেটুকু খবর পেয়েছি, তাতে জেনেছি বাচ্চারা অনেকেই খুব মজা পাচ্ছে। বই দেখে প্রশ্ন করা হলেও তারা সঠিক উত্তর খুঁজতে হিমশিম খাচ্ছে। বারবার পড়ছে। উত্তর খুঁজছে। না পেলে কর্মকর্তা ও শিক্ষকদের নিকট কল করছে। অনেক অভিভাবক প্রশ্ন সহজ করার অনুরোধ করেছে।
আমরা চাই তারা বুদ্ধিমান সৃজনশীল ও সার্থক মানুষ হোক। ফলে আমরা আমাদের কাজ অব্যাহত রেখেছি। অভিভাবকদের বোঝাতে চেষ্টা করছি : দেশের ও দশের করুন দশা থেকে মুক্ত করতে প্রচলিত ভুয়া ব্যবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। যেভাবে প্রকৃত অর্থে বুদ্ধির বিকাশ হয়, জীবন ও জগত নিয়ে নতুন নতুন ভাবনা তৈরী হয়, মানবিক বোধ জন্ম নেয় সেভাবেই শিক্ষা দিতে হবে। মেধা যাচাইয়ের নামে মেধার জুস ও নির্বোধ প্রজন্ম তৈরীর মাধ্যমে সম-স্বরের ভেড়ার পাল গড়ে তোলার কোনো যুক্তি নেই।

লেখক : রেজাউল করিম শেখ, প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি, নপম,
ইমেইল : nrf2011@hotmail.com

শেয়ার করতে এখানে চাপ দিন

সর্বশেষ খবর