বিশেষ প্রতিনিধি : পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার গাঙ্গহাটি গ্রামের মৃত ইসহাক আলী প্রামাণিকের ছেলে নায়েব আলী। মা মৃত রাবেয়া খাতুন। একটি হাত ও পা হারিয়ে ৪৭ বছর বয়সী নায়েব আলী আজ বড়ই অসহায়।
পা নেই বলে ক্র্যাচে ভর দিয়ে হাঁটতে হয় তাকে। বাম হাতের কব্জিটিও নেই। দু’দশক ধরে চলছে তার কঠিন এক জীবনযুদ্ধ। দুটি দুর্ঘটনার পর তাকে প্রচুর ওষুধ খেতে হয়েছিল। কোনো একটা ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় তার শ্বাসনালী শুকিয়ে সরু হয়ে গেছে। অন্তত ১৫ বছর আগে থেকে সমস্যাটি ধরা পড়ে। এক মুঠ ভাত গলা থেকে নামাতে আধা গ্লাস পানি খেতে হয় তাকে। সম্প্রতি সমস্যাটি বেড়েছে তার।
শারীরিক কষ্টের পাশাপাশি অর্থনৈতিক কষ্টে নিষ্পেষিত তিনিসহ তার দুটি সন্তান ও স্ত্রী। এত কষ্টের পরও তিনি পরের দুয়ারে হাত পাতেননি। ছোটখাটো ব্যবসা করে জীবন নির্বাহ করে আসছিলেন। কিন্তু আজ তার ব্যবসা নেই। করোনা সংকটে দোকান বন্ধ ছিল। আয় নেই, সঞ্চয়ও নেই। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ভাড়া শোধ করতে পারেননি তিনি। এজন্য দোকান ছেড়ে দিতে হয়েছে তাকে।
এখন পুরোপুরি বেকার হয়ে বাড়িতে আক্ষরিক অর্থেই বসে গেছেন। তার চার সদস্যের পরিবারে নেমে এসেছে অবর্ণনীয় দুর্গতি। খাদ্যনালীর রোগ সারানোর জন্য ওষুধও কিনতে পারছেন না তিনি।
আজ নায়েব আলী যে দুঃসহ জীবনের মুখোমুখি তার পেছনে আছে একটি মানবিকতার ঘটনা। যে মানবিক কাজটি করতে গিয়ে নায়েব আজ প্রতিবন্ধী। সেই ঘটনাটি নায়েব আলী আমাদের অনুরোধে শোনালেন।
জানালেন, নব্বই এর দশকে এসএসসি পাস করেন নায়েব আলী। ১৯৯২ সালের কোনো একদিনের কথা। তার গ্রাম পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার গাঙ্গহাটি গ্রামে জনৈক আব্দুল হাফিজ (মৃত) এর সন্তান সম্ভবা মেয়ে ছিল। মেয়েটির বাবা বেঁচে ছিলেন না। তবে তার মা ছিলেন। সন্তান প্রসব স্বাভাবিকভাবে না হওয়ায় মেয়েটি কষ্ট পাচ্ছিলেন। কেউ মেয়েটিকে হাসপাতালে নিয়ে যাননি। নায়েব জানান, তিনি বাড়ি এসে শোনেন মেয়েটি খুব কষ্ট পাচ্ছে। এটি নায়েব আলীর হৃদয় ছুঁয়ে যায়। তখন নায়েব আলী একটি টেম্পু (তখন এ এলাকায় টেম্পু ছিল) ভাড়া করেন। সেই টেম্পুতে তিনি এবং পাশের গ্রামের একজন পল্লী চিকিৎসক ছিলেন। নায়েব জানান, দুর্ভাগ্যবশত প্রসূতি মেয়েটি হাসপাতালে প্রসবকালীন সময়ে মারা যান। এরপর গভীর রাতে তারা মৃতদেহ সাথে নিয়ে ওই টেম্পুতেই বাড়ি রওয়ানা দেন।
টেম্পুটি বাড়ির কাছাকাছি পাবনা-ঢাকা মহাসড়কের শোলাবাড়িয়া নামক স্থানে এসে উল্টে পাশের খাদে পড়ে যায়। টেম্পুতেথাকা সবাই কম-বেশি আহত হন। গুরুতর আহত না হওয়ায় তিনজনই আবার মৃতদেহটিকে টেম্পুতে ঠিকমতো তুলে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন।
এ দুর্ঘটনায় নায়েব আলীর পায়ে ক্ষত তৈরি হয়। তার আত্মীয়-স্বজন তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার জন্য ওই দিন রাত একটার দিকে বাড়ির পাশে গাঙ্গহাটি মাতৃস্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে যান। সেখানে একজন চিকিৎসক ছিলেন যিনি রাতে সেখানেই থাকতেন। তাকে গভীর রাতে তারা ডেকে তুলেন এবং ওই চিকিৎসক নায়েবের ক্ষতস্থান যথাসম্ভব পরিষ্কার করে রক্ত বন্ধর জন্য সেলাই করে দেন।
নায়েব আলীর দুলাভাই খাজা নাজিম উদ্দিন বলছিলেন, দু’দিন পর তারা দেখেন নায়েব আলীর পা ফুলে গেছে। এতে নায়েব যন্ত্রণাকাতর হয়ে পড়েন।
তিনি বলেন, তখন তারা তাকে পাবনা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেখানে দু’দিন থাকার পর তার অবস্থার অবনতি ঘটে এবং নায়েব আলী জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। তার রক্তবমি হতে শুরু করে।
সেই সময়ে তার দেখভাল করা নায়েব আলীর দুলাভাই খাজা নাজিম উদ্দিন বলেন, তাকে দ্রুত রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু সেখানেও দু’দিন ফেলে থাকার মতো ছিলেন। তারা চিকিৎসকদের শরনাপন্ন হলে একজন চিকিৎসক দয়াপরবশ হন। তিনি দেখে শুনে অনেকটা হতাশ হয়ে বলেন, ছেলেটির অবস্থা ভালো না, খুবই সংকটাপন্ন এবং সে মারা যেতে পারে। ওই চিকিৎসক নায়েব আলীর কাছে যান এবং পরীক্ষা করে দেখতে পান তার কোমরের নিচ থেকে পুরা পায়ে কোনো বোধ নেই।
ওই চিকিৎসক জানান, অবিলম্বে তার পা বিচ্ছিন্ন না করলে তার জীবনহানি ঘটতে পারে। তখন চিকিৎসকরা দ্রুত তার অপারেশন সম্পন্ন করেন। তারা টগবগে যুবকটির একটি পা কেটে ফেলতে বাধ্য হন।
নায়েবের পা কেটে ফেলার পর তার সংজ্ঞাহীন অবস্থায় কাটে ২৮ দিন। জ্ঞান ফিরলে যখন দেখতে পান তার পা নেই তখন তিনি চিৎকার করে ওঠেন। তখন চিকিৎসক তাকে সান্ত্বনা দেন এবং জানান তার জীবন রক্ষার্থে এমনটি করতে তারা বাধ্য হয়েছেন । বেশ কিছুদিন হাসপাতালে থাকার পর অভিভাবকরা তাকে তারা বাড়ি নিয়ে আসেন।
এরপর নায়েব আলী জানান, তার পুরো জীবনটা এলোমেলো হয়ে যায়। তখন থেকে জীবনের স্বপ্ন বলতে শুধু দু’মুঠো খেয়ে বেঁচে থাকা। গরিব ঘরে জন্ম বলে সংসারের হালও ধরতে হয়।
জানান, তার মা যতদিন জীবিত ছিলেন তিনি তাকে কাছে রেখেছেন। বাড়ির কাছে বনগ্রাম বাজারে ৯৩-৯৪ সাল থেকে তিনি ইলেকট্রিক ও পরে একটি স্টুডিও ব্যবসা শুরু করেন।
তিনি জানান, স্টুডিও ব্যবসা তখন মোটামুটি চালু ছিল। দোকানের কাজ সেরে ক্যাশের টাকা নিয়ে গভীর রাতে ভ্যান যোগে বাড়ি ফিরতেন। এরই মধ্যে ১৯৯৮ সালের মাঝামাঝি রাত এগারোটার দিকে বাড়ি ফিরছিলেন। তখন বাড়ির কাছাকাছি জায়গায় গাঙ্গহাটি গোরস্থান নামক জায়গায় তিনি ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েন। ডাকাতদের ধারণা ছিল তার কাছে অনেক টাকা পয়সা হয়তো আছে। টাকা না পেয়ে ক্ষুদ্ধ ডাকাতরা তাকে এলোপাথাড়ি কোপায় এবং তিনি হাত দিয়ে ঠেকাতে গেলে বাম হাতের কব্জি দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ওই সময়ও তার স্বজনরা তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর তিনি প্রাণে রক্ষা পান।
কিন্তু নায়েবের পঙ্গুত্ব আরও বেড়ে যায়। শারীরিক ও মানসিকভাবে আরও অসহায় হয়ে যান। তবে এবারও নায়েব অদম্য। তিনি ভিক্ষার থলি নিয়ে নামেননি। তিনি আবারও তার ব্যবসা শুরু করেন। একটি হাত অকেজো আবার একটি পা নেই বলে নিরবে আত্মসমর্পণ করেননি। এক হাত দিয়েই তিনি ছবির কাজ করেছেন, ক্যামেরা ধরেছেন, লাইট ঠিক করেছেন।
নায়েব জানান, আবার একটি ধাক্কা খান তিনি। জানান, ডিজিটাল যুগ আসার পর পরই তিনি অর্থের অভাবে ডিজিটালাইজড্ হতে পারেননি। এতে তার নিয়মিত অনেক গ্রাহক অন্য স্টুডিওতে চলে যায়। অনেক ডিজিটাল স্টুডিও ওই সময় গড়ে ওঠে। পরে ডিজিটাল ব্যবসা শুরু করলেও তার ব্যবসা আর জমেনি। তিনি এরপর থেকে পেছাতে থাকেন। এরই মধ্যে ২০০০ সালে বিয়ে করেন। সন্তানাদি হয়। সংসারে টানাপোড়েন বাড়তে থাকে। এভাবেই চলছিল প্রায় এক যুগ।
তিনি জানান, নানা দুঃখ-কষ্ট, হতাশা বেদনা তিনি নিরবে সহ্য করে গেছেন দুটি সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে। হাজারও কষ্টের মধ্যেও একটি ছেলে এবার এসএসসি পাস করেছে এবং আরেকটি ছেলেকে তিনি দিয়েছেন হিফজ মাদরাসায়। সে হাফেজি পড়ছে।
নায়েব আলী জানান, এ বছর করোনা তাকে বেকার ও একেবারে অসহায় বানিয়ে দিয়েছে। তিনি জানান, করোনার কারণে দোকান বন্ধ হয়ে যায়। পরে দোকান খুললেও তাতে কোনো আয় রোজগার হয়নি। এদিকে কয়েক মাসের দোকানভাড়া বকেয়া পড়ে যাওয়ায় দোকান মালিক তাকে দোকান ছেড়ে দিতে বলেন।
নায়েব আলী জানান, এখন তিনি মারাত্মক অর্থসংকটে পড়েছেন। কারণ তার আয়ের উৎস বন্ধ। পৈত্রিক কোনো সহায় সম্পদ নেই যা দেখাশোনা করে খাবেন। তার বড় ছেলের কলেজে ভর্তি অনিশ্চিত, ছোট ছেলেটি বাড়িতে। তার বোর্ডিং খরচ যোগাতে পারছেন না।
তার স্ত্রী সাবিনা খাতুন জানান, দীর্ঘদিন ধরে তারা কষ্ট করে সংসার চালিয়েছেন। কারো কাছে তারা সাহায প্রার্থী হননি। তিনি জানান, এবার করোনা সংকটে তার স্বামী পুরা বেকার হয়ে গেছেন। দোকানের ভাড়া জোগাতে না পেরে দোকান ছেড়ে দিতে হয়েছে। দোকানে সাজানো সব সামগ্রী এখন বাড়িতে স্তুপ করে রাখা হয়েছে। যেগুলো দিয়ে জ্বালানি করা ছাড়া আর কোনো পথ নেই। তাদের ফটো স্টুডিওতে একটি পুরানা ফটোস্ট্যাট মেশিন ছিল সেটিও বাড়িতে এনে রাখা হয়েছে।
তিনি জানান, এখন নতুন করে তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর মতো অবস্থা নেই। বাড়িতে ঠিকমতো চুলা জ্বালানোই কঠিন হয়ে গেছে। এখন নতুন করে একটি দোকান করতে গেলেও অন্তত ৫০ হাজার টাকা দরকার। এ টাকাটা যোগাড় করা তাদের পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
নায়েব আলীর ছোট ছেলে শায়েখ আহমেদ জানায়, সে হাফিজি মাদরাসায় পড়ছে। তবে তার বাবা বোর্ডিং খরচ যোগাতে পারছেন না বলে তার মাদরাসায় যাওয়া হচ্ছে না।
নায়েব জানান, অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে বেঁচে থাকতে চান না। তিনি চান আবার একটি দোকান করতে। কিন্তু এজন্য অন্তত ৫০ হাজার টাকা দরকার। কিন্তু টানাটানির সংসারে ৫০ হাজার তো দূরের কথা ৫ হাজার টাকাও তার সঞ্চয় নেই। প্রতিটি দিন কাটে তার দুশ্চিন্তায়। কারণ সামনে শুধুই অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ।
দেশ- বিদেশের কোনো সহৃদয়বান ব্যক্তি তাকে কিছুটা আর্থিক সহায়তা করলে নায়েব আলী আবার তার ছোট ব্যবসাটি চালু করতে পারবেন। পরিবার পরিজন নিয়ে একটু শান্তিতে থাকতে পারবেন।