বিশেষ প্রতিবেদক : সাঁথিয়ায় দুই যুগ ধরে পরিত্যক্ত থাকা পোনা মাছ উৎপাদনের খামারে আবার শ্বেতবিপ্লব ঘটেছে। এখন সেখানে গড়ে উঠেছে হাঁসের খামার, মাছের খামার গো- খামার, ছাগলের খামার। গাভী- ছাগলের দুধ, রুপালী মাছ কিম্বা হাসের ডিম সব মিলিয়ে এক সার্থক শ্বেতবিপ্লব। এতে শুধু খামারটি লিজ গ্রহীতারাই উৎসাহিত নন। এলাকার অনেক যুবক উৎসাহিত। কেউ কেউ এখানে কাজের সুযোগ পেয়েছেন কেউ কেউ এ খামার দেখে নিজেরাই নিজস্ব খামার গড়ে তুলেছেন। গত তিন দশকের নানা ব্যর্থতা ও সফলতার কথা সম্প্রতি খামারে বসে বলছিলেন খামারের লিজ গ্রহীতা কালিপদ হালদার। তিনি যেন এ খামারের গল্পের পুরানা নাবিক। সবাই তাকে ছেড়ে চলে গেলেও তিনি শত কষ্টের মাঝে খামারটিতে সুদিন ফিরে আসার প্রতীক্ষায় ছিলেন।
খামারের লিজ গ্রহীতা কালিপদ হালদার জানান, নব্বই এর দশকে পাবনার সাঁথিয়ায় পানি উন্নয়ন বোর্ড পোনা উৎপাদনের জন্য সাঁথিয়ার নন্দনপুরে খামার স্থাপন করেছিল। সেখানকার উৎপাদিত পোনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের মূল সেচ প্রকল্পে মাছ উৎপাদনের খামারে দেয়ার জন্য। ২৮টি মৎস্য চাষি সমিতিও ছিল। প্রত্যেক সমিতি থেকে একজন করে প্রতিনিধি নিয়ে এ পোনা উৎপাদন খামার পরিচালিত হচ্ছিল। কিন্তু ইছামতি সেচ ক্যানেলের উৎসমুখের সাথে খামারের সংযোগস্থলে প্রতিবন্ধকতা থাকায় পানি সরবরাহ করা দুরুহ হয়ে পড়েছিল। ফলে পানির অভাবে খামারটিতে পোনা উৎপাদন বন্ধ করে দিতে হয়। আবার মূল সেচ ক্যানেলে সমবায়ী মাছ চাষও এক সময় বন্ধ হয়ে যায়। খামারটির বাৎসরিক লিজমানি দিতে অনেক মৎস্যজীবী উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। ধীরে ধীরে ২৮ মৎস্যজীবীর প্রায় সবাই এ খামারের প্রতি উদাসীন হয়ে যান। এদের সভাপতি কালিপদ হালদার খামার আঁকড়ে পড়ে থাকেন। তবে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনার অভাবে তিনি তেমন কিছু করে উঠতে পারেননি। ধীরে ধীরে একটি পরিত্যক্ত খামারে পরিণত হয় এটি। সুনশান পরিবেশে মাদকসেবীদের নিরাপদ আবাসস্থলে পরিণত হয় এক সময়। এছাড়া এখানে ঘাপটি মেরে বসে থাকত ছিনতাইকারীরা।
দীর্ঘ তিন দশক পর পরিত্যক্ত এ খামারটিতে আবার প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে এসেছে। কর্মমুখর পরিবেশ বিরাজ করে সারা দিন। আর রাতের ঘুটঘুেটে আঁধার কেটে এখন সেখানে আশার আলো জ্বলে।
এ খামারের বিষয়ে কালিপদ হালদার বলেন- প্রয়োজনীয় পুঁজি আর দিক নির্দেশনার অভাবে দীর্ঘদিন ধরে লোকসানের বোঝা টেনেছি। এখন খামারটি নতুন করে সাজানোর চেষ্টা করেছি। সাফল্য ধরা দিবে নিশ্চয়। তিনি জানান, সরকারি বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারিরা তাকে কারিগরি পরামর্শ দিয়েছেন। আর পারিবারিক ও আত্মীয়-স্বজনের মাধ্যমে সংগ্রহ করা টাকায় ছোট সমন্বিত খামার গড়ে তুলছি। তবে সরকারিভাবে প্রণোদনা বা ঋণ সহায়তা পেলে তিনি খামারটি আরো বড় করতে পারতেন। তিনি জানান, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন এক ইঞ্চি জায়গাও ফেলে না রাখতে। সে হিসেবে আমার উদ্যোগটি নিশ্চয়ই সরকারি সহায়তা পাওয়ার উপযোগী। কারণ তিন দশক পড়ে থাকা খামারটি চালু করেছি, কর্মমুখর করেছি আবার এখানে ১০-১৫ জন লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। এখানে এখনো যে জায়গা রয়েছে তাতে খামার বাড়াতে পারলে অন্তত ৫০০ লোকের প্রত্যক্ষভাবে কর্মসংস্থান হতে পারে। আর পরোক্ষভাবে আরো বহু লোক (যেমন ঘাস সরবরাহকারী, ভ্যান চালক, জ্বালানী সরবরাহকারী, মাছ ও গোখাদ্য বিক্রেতা ) এর কর্মসংস্থান হতে পারে।
কালিপদ হালদার বলেন- এখানে ১০টি পুকুর রয়েছে। তিনি লিজ গ্রহিতা হলেও তার এত পুজি নেই যে, ১০টি মাছের খামার চালু করা যাবে। একটি হাঁসের খামার করা হয়েছে। তিনি জানান, এখানে ১০টি হাঁসের খামার গড়ে তোলা যেতে পারে। দুটি গরুর খামার গড়ে তোলা হয়েছে। এখানে অন্তত: ৫০টি গো- খামার গড়ে তোলা সম্ভব। তিনি বলেন- এজন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দরকার। তিনি জানান, যে কোন ব্যাংক কর্তৃপক্ষ সরেজমিন এলেই এখানে সম্ভাবনার চিত্র দেখতে পাবেন। তিনি প্রয়োজনীয় ঋণের জন্য বিভিন্ন অফিসে যোগাযোগ করছেন বলে জানান। তিনি বলেন- এ পর্যন্ত যেটুকু করেছি তাতে লাভ শুরু হয়নি। তবে এখানকার পশু-পাখিগুলো সুস্থ থাকলে তিনি লাভের মুখ দেখবেন বলে আশা করেন। এতে এখানে কর্মরতরাও টিকে যাবেন, তিনিও কিছু লাভবান হবেন।
এখানে কাজ পাওয়া ম্যানেজার শিক্ষিত যুবক রবিউল ইসলাম জানান, তিনি বেকার ছিলেন। ছোটবেলা থেকে তিনি দেখে এসেছেন এটি পরিত্যক্ত। সে খামারটি চালু হওয়ায় তিনি খুশি হন। একদিন খামারটি দেখতে আসেন। পরে উদ্যোক্তা কালিপদ হালদার তাকে ম্যানেজার হিসেবে নিযুক্ত করেন। তিনি বলেন- তার অধীনে ১০-১২ জন সার্বক্ষণিক কর্মচারি রয়েছেন। তাদেরও রুটি রুজির ব্যবস্থা হয়েছে। খামারটি ধীরে ধীরে আরো বড় হলে এখানে এ এলাকার অন্তত: ৫ শ’ লোকের কর্মসংস্থান সম্ভব। তবে পুঁজি কম থাকার কারণে খামারটির পরিধি ধীরে ধীরে বাড়ছে বলে তিনি জানান।
কর্মরত শ্রমিক বাকিবিল্লাহ জানান, তিনি এখানে কাজ পেয়েছেন। মাস গেলে বেতন পাচ্ছেন। তিনি স্ত্রী পরিবার নিয়ে এখন বেশ ভাল আছেন। শ্রমিক ফিরোজ বলেন- এখানে হাঁসের খামার, মাছের খামার, গরুর খামার, কবুতরের খামার , চিনা মুরগির খামার, ছাগলের খামার, ভেড়ার খামার রয়েছে। এসব দেখতেও তার ভাল লাগে, খাবার দিতেও ভাল লাগে। এখান থেকে পাওয়া বেতনে তার সংসার চলে বলে জানান। অন্যান্য শ্রমিকও একই রকম কথা বলছিলেন।
এ খামারে বেড়াতে এসেও অনেকে খামারি হয়েছেন। ডা. আমিরুল ইসলাম সানু জানান, তিনি শখের বসে এখানে নেমেছিলেন একদিন। এসে দেখেন জমজমাট হাঁসের খামার। তিনি এখানে কর্মরত শ্রমিকদের কাছ থেকে একটা ধারণা নেন। এরপর নিজ এলাকায় হুঁইখালি কয়েক বন্ধু মিলে পুকুরের সাথে সমন্বিত হাঁসের খামার গড়ে তুলেছেন বলে জানান।
একই রকম কথা বলছিলেন প্রকৌশলী আকাশ। – তিনি এ খামারে বেড়াতে এসে দেখেন ছাগলের খামার। এখানে শ্রমিকদের সাথে কথা বলে ছাগল লালন-পালন ও জাত সম্বন্ধে ধারণা নেন। এরপর সাঁথিয়া পৌর সদরে পৈত্রিক জমিতে ছাগলের খামার গড়ে তুলেছেন। তিনি জানান, একটি মাত্র শেড দিয়ে শুরু করেছি। আগামীতে খামারাটি বড় করার ইচ্ছা রয়েছে।
এদিকে কালিপদ হালদার বলেন তার চেষ্টার কথা, অধ্যবসায়ের কথা। তিনি জানান, সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে গেছেন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছে গেছেন, এমন কি এলাকার মাননীয় সংসদ সদস্য, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আলহাজ¦ এ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকুর কাছেও গিয়েছিলেন সাহায্য- সহযোগিতার জন্য। মাননীয় সংসদ সদস্যের কাছ থেকে তিনি বেশি উৎসাহ পান বলে জানান। অনেক লোকের কর্মসংস্থান হবে বলে এমপি মহোদয়ও তাকে আশ্বাস দিয়েছেন সরকারি প্রণোদনা বা ঋণ পেতে সহযোগিতা করবেন।