সাঁথিয়া থেকে তাইজুল ইসলাম :
সাঁথিয়া ডাববাগান শহীদদের আত্মার শান্তি ও মাগফেরাত কামনায় বধ্যভূমির সকল শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানালেন সাবেক সফল স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্হায়ী কমিটির সভাপতি বেড়া সাঁথিয়া সংসদীয় আসনের মাননীয় সংসদ সদস্য এ্যাড.শামছুল হক টুকু এমপি।
পাবনার বেড়া উপজেলার নগরবাড়ী ঘাট ছেড়ে পশ্চিম দিকে কাশিনাথপুর পেরিয়ে বগুড়া-নগরবাড়ী মহাসড়ক সংলগ্ন সাঁথিয়া উপজেলার পাইকরহাটি গ্রামের (বর্তমান নাম শহীদনগর) ডাববাগান নামক স্থানে একাত্তরের ১৯ এপ্রিল পাক হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সম্মুখ প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়।
একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ শোনার পর থেকেই সমগ্র বাঙালি জাতি স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজেদের আরও সংগঠিত করে সর্বাত্মক আন্দোলনের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে। হানাদার বাহিনী কর্তৃক বন্দি হবার প্রাক্কালে একাত্তরের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এর পর তার সেই আহবান ও নির্দেশেই বাঙালিরা দেশব্যাপী পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলে।
ঢাকা থেকে আসা পাক হানাদার বাহিনী উত্তর জনপদের এই স্থানে মুক্তিসেনাদের সম্মুখে প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। মুক্তিসেনাদের পক্ষে এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন ইপিআর সুবেদার গাজী আলী আকবর। (বাড়ি কুষ্টিয়া জেলার শান্তিডাঙ্গা গ্রামে)। এ যুদ্ধে বেশিরভাগ যোদ্ধা ছিলেন বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ বাহিনী আনসারসহ অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধা। এই রাস্তা দিয়ে পাকসেনারা নগরবাড়ী থেকে বগুড়া যাবার চেষ্টা করে। খবর পেয়ে মুক্তিসেনারা ডাববাগানে অবস্থান নেয়। প্রথমবারের মতো পাকসেনারা সম্মুখযুদ্ধে টিকতে না পেরে ব্যাপক ক্ষতি ও হতাহতের পর পিছু হটে নগরবাড়ী ফিরে যায়। যুদ্ধে প্রায় ৫০ জন পাকসেনা নিহত হয়। চূর্ণ হয় তাদের শক্তি, তাদের মনোবল। এদিকে সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন ইপিআর হাবিলদার মমতাজ আলী, হাবিলদার আঃ রাজ্জাক, নায়েক হাবিবুর রহমান, সিপাহী এমদাদুল হক, সিপাহী ঈমান আলী, সিপাহী রমজান আলীসহ আরও অনেক ইপিআর সদস্য। পাকবাহিনী ওই সকল শহীদ ইপিআর সদস্যদের দেহ এসিড ঢেলে পুড়িয়ে দেয়।
সম্মুখযুদ্ধে পরাজয়ের পর পিছু হটে যাওয়া পাকবাহিনী নতুন করে শক্তি বৃদ্ধি করে রাতের বেলা আবার আক্রমণ করে। এবার পাকবাহিনীর বিশাল শক্তির কাছে টিকতে না পেরে মুক্তিসেনারা পিছু হটে যায়। পাকসেনারা এবার গ্রামবাসীর উপর অমানবিক নির্যাতন চালায়। একে একে পুড়িয়ে দেয় ডাববাগানের পার্শ্ববর্তী গ্রাম রামভদ্রবাটি কোড়িয়াল, বড়গ্রাম, সাটিয়াকোলা প্রভৃতি গ্রাম। নির্বিচারে গুলি চালায় নিরীহ গ্রামবাসীর উপর। লোকজনদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ধরে এনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করে শ’শ’ স্বাধীনচেতা গ্রামবাসীকে। এদের মধ্যে করমজার প্রাক্তন চেয়ারম্যান আফাজ ডাক্তার, আঃ লতিফ, শেখ কাজেম আলী, খোয়াজ শেখ, পিয়ার মন্ডল, জাকের আলী শেখ, সৈয়দ আলী মোল্লা, জগনারায়ণ বিশ্বাস প্রমুখ। যে গাব গাছটির কাছে নিয়ে এসে গ্রামবাসীকে হত্যা করা হয়েছিল, সেটি এখনও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আরও আছে সেই ডাববাগান। এলাকাবাসী জায়গাটির নতুন নামকরণ করেছে ‘শহীদনগর’।
একাত্তরের ১৯ এপ্রিলের সেই ভয়াল রাতের কথায় শহীদনগরবাসী ফিরে যায় সেদিনের স্মৃতিতে। খুঁজে পেতে চায় সেসব শহীদ ভাইদের যাদের তাজা রক্তে ভিজে গেছে গ্রামের মেঠোপথ। শহীদনগরে রয়েছে ‘গণকবর’। এখানে ঘুমিয়ে আছেন শ’শ’ মুক্তিপাগল গ্রামবাসী।
শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিকে স্মরণীয় করার জন্য বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০০১ সালের ১৯ এপ্রিল তথ্যকালীন এমপি এখানে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ভাস্কর্য “বীর বাঙালি” নামে একটি ‘ স্মৃতিসৌধ’গড়ে তোলেন।