Saturday, মে ১৮, ২০২৪
শিরোনাম

শাহ আব্দুল করিম: প্রয়াণ দিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

শেয়ার করতে এখানে চাপ দিন

আবদুল্লাহ আল মোহন


১.
‘হিন্দু-মুসলমান এটা বড় নয়; আমরা বাঙালি, আমরা মানুষ’।- শাহ আবদুল করিম
বাংলা বাউল গানের কিংবদন্তি হিসেবে পরিচিতি পাওয়া শিল্পী শাহ আবদুল করিম । সুনামগঞ্জের কালনী নদীর তীরে বেড়ে উঠা শাহ আবদুল করিমের গান ভাটি অঞ্চলে জনপ্রিয় হলেও সে সীমা ছাড়িয়ে দেশ-বিদেশে-শহরের মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা পায় তার মৃত্যুর মাত্র কয়েক বছর আগে। ভাটি অঞ্চলের মানুষের জীবনের সুখ প্রেম-ভালোবাসার পাশাপাশি তার গান কথা বলে সকল অন্যায়, অবিচার, কুসংস্কার আর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধেও। প্রায় দেড় সহস্রাধিক গান লিখেছিলেন বলে জানা যায়। আর কত গান মুখে মুখে রচনার পর হারিয়ে গেছে তার সংখ্যাও অজানাই রয়ে গেছে। ২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম মৃত্যুবরণ করেন। উল্লেখ্য যে, ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তিনি জন্মগ্রহণ করেন। এই বাউল সম্রাটের স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। তিনি তো আমাদের লোকজ সংস্কৃতি, সাহিত্যকে শুধু সমৃদ্ধই করেননি, চিরদিন থাকবেন আমাদের মৌলিক চেতনার প্রদীপ হয়ে। তাকে নিয়ে একটি প্রমাণ্যচিত্র নির্মাণ করছেন চিত্র নির্মাতা শাকুর মজিদ। ‘ভাটির পুরুষ’ নামে এই চিত্রকর্মটি একটি দলিল। নিরহংকারী, সদালাপি, নিঃস্বার্থবান এই মহান বাউল কবি আবহমান বাংলার মরমী প্রাণের ধ্রুব প্রতীক। তার গান হোক স্বরূপ অন্বেষণে আমাদের পাথেয়। যেমনটি তিনি প্রয়াণের আগে আশাবাদী হয়ে বলেছিলেন, চেয়েছিলেনও ‘মানুষ আমার গান গাচ্ছে, শুনছে—এটা আমার সৌভাগ্য। আমি সারাজীবন মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। আর মানুষের ভালোবাসা নিয়েই মরতে চাই।’আজ খুব বেশি করে তাই তাকে মনে পড়ছে, আমার মতো আরো অজস্রজনের, সেটাই তো ভালোবাসা, নয় কী ?
২.
বাউল গানের কিংবদন্তী শিল্পী শাহ আবদুল করিমের গান প্রথম শুনি, তার নাম-পরিচয়ও প্রথম জানতে পারি দৈনিক ভোরের কাগজে কাজ করার সময় প্রিয় সাংবাদিক এবং ‘দলছুট’-এর গায়ক প্রয়াত প্রিয়জন সঞ্জীব চৌধুরীর কাছে।পরে ইমপ্রেস টেলিফিল্মে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের সাথে শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান ‘সোনালী দরোজা’য় রাতভর এডিটিং চলাকালেও সঞ্জীবদার সঙ্গ পাই তাদের গানের ভিডিও এডিটিং-এর সুবাদে। সায়ীদ স্যারের আগ্রহের কারণে সঞ্জীবদার কন্ঠে ‘গাড়ি চলে না, চলে না, চলে নারে গাড়ি চলে না / চড়িয়া মানব গাড়ি, যাইতেছিলাম বন্ধুর বাড়ি/ মধ্যপথে ঠেকলো গাড়ি, উপায়বুদ্ধি মিলে না।/ আব্দুল করিম ভাবছে এবার, কণ্ডেম গাড়ি কী করবো আর / সামনে ভীষম অন্ধকার, করতেছি তাই ভাবনা।’গানটি সে রাতে একাধিকবার শোনার ও এবং শাহ আবদুল করিমের জীবন ও সাধনা বিষয়ে আরো সুপরিসরে জানার বিরল সুযোগ ঘটে। আর তাই শাহ আবদুল করিমের সুরের ও নামের সাথে সাথেই গুরু সঞ্জীবদার কথাও ভেসে আসে আমার মনে।সে সব স্মৃতি আপাতত থাক।তবে ২০০৫-০৬ সালে সিলেটে চাকুরির সময়েও বাউল এ শিল্পীর গান তার স্বকণ্ঠে শোনার ও তার সাথে আলাপনের সুযোগ হয় সিলেটেরই একাধিক সাংবাদিক বন্ধুর সৌজন্যে। সেসব স্মৃতিও আজ ভীষণই মনে পড়ছে।
৩.
‘কোন মিস্ত্রী নাও বানাইছে কেমন দেখা যায় / ঝিলমিল ঝিলমিল করেরে ময়ূরপঙ্খী নায়..” কিংবা “গ্রামের নোওজোয়ান হিন্দু মুসলমান / মিলিয়া বাউলা গান আর ঘাটু গান গাইতাম / আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম….’ এমন অসংখ্য কালজয়ী গানের কিংবদন্তী স্রষ্টা বাউল কবি শাহ আবদুল করিম প্রশ্ন উত্তর-পর্ব গানে একজন বাগ্মী তার্কিক এবং যুক্তিবাদি হিসেবে তিনি সবসময়ই ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। আর এভাবেই তিনি গোটা বাংলাদেশ এমনকি বিদেশে অবস্থানকারী বাঙালি সঙ্গীত প্রেমীদের কাছে হয়ে ওঠেন একজন পরম নমস্য ব্যক্তিত্ব।প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বল্প শিক্ষিত হয়েও শাহ আবদুল করিম যে প্রকৃত অর্থেই একজন অসাম্প্রদায়িক চেতনার, মানবতাবাদি মরমী কবি ছিলেন, খাঁটি মানুষ ছিলেন, সে প্রমাণ আমরা তার রচিত নানা গানের পঙক্তি থেকে সহজেই পেতে পারি। যেমন, ক. আশেকের রাস্তা সোজা … আশেক থাকে মাশুক ধ্যানে, এই তার নামাজ এই তার রোজ … খ. মন পাগলা তুই লোক সমাজে লুকিয়ে থাক মন মানুষ তোর মনমাঝে আছেরে নির্বাক। গ. মনমাঝি তোর মানবতরী ভবসাগরে ভেসে যায় বেলা গেলে সন্ধ্যা হলে পাড়ি দেওয়া হবে দায় …। আর এভাবেই আমাদের গ্রামীণ জনপদের ভনিতাহীন বাউল কবি নিরন্তর সে সত্যটি তার গানে বার বার অন্বেষণ করেছেন তা হচ্ছে, সেই পরম সত্তা যে সত্তা নিয়ন্ত্রণ করছে এই মন-মানবমণ্ডল। শাশ্বত সত্যের মুখোমুখি নিজেকে দাঁড় করিয়েছেন শাহ আবদুল করিম। তার গান এভাবেই হয়ে উঠেছে সকল কুসংস্কারহীনতার ও মানবগোষ্ঠীর আত্মদর্পণ।জীবনের শেষবেলায় এই বাউলের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিলো, ‘কোনো অপ্রাপ্তি কিংবা স্বপ্ন’ পূরণ বাকি আছে কী না। জবাবে শাহ আবদুল করিম বলেছিলেন, ‘আমার জীবনে কোনো অপ্রাপ্তি নেই। এ জীবনে অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। এরপর কোনো অপ্রাপ্তি থাকতে পারে না। বাংলাদেশ একসময় সত্যিকারের অসামপ্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিতি পাবে—এটাই আমার স্বপ্ন।’
৪.
শাহ আবদুল করিম (জন্ম: ১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯১৬ – মৃত্যু: ১২ সেপ্টেম্বর, ২০০৯) একজন স্বশিক্ষিত কবি। তার চেতনাই তার সৃজনের জ্ঞানশিক্ষা। বাংলার মাটি, জল, সবুজ, সুন্দরমা প্রকৃতিই তাঁর পাঠশালা। সেই পাঠশালার চিত্রছায়ায় পাঠ নিতে নিতে তিনি অনুধাবন করেছেন জীবনকে, জীবনের একক নিয়ামক শক্তিকে।তাইতো তিনি অকপটে বলতে পারেন, ‘কেউ বলে দুনিয়া দোজখ, কেউ বলে রঙের বাজার / কোনো কিছু বলতে চায় না, যে বুঝেছে সারাসার।’আবার বাউল বলছেন,
ভব সাগরের নাইয়া …
মিছা গৌরব করোরে পরার ধন লইয়া।
একদিন তোমায় যাইতে হবে এই সমস্ত থুইয়া।।
পরার ঘরে বসত করো, পরার অধীন হইয়া
আপনি মরিয়া যাইবায় এইভব ছাড়িয়া।।
কী ধন লইয়া আইলায় ভবে, কী ধন যাইবায় লইয়া
ভবে আইয়া ভুলিয়া রইলায় ভবের মায়া পাইয়া।।
বাউল আবদুল করিম বলে, মনেতে ভাবিয়া
মন্ত্র না জানিয়া ঠেকলাম, কালসাপিনী ছুঁইয়া।। (কালনীর কূলে/ গান: ৪০)
এই যে মায়াঘোর, এই যে বিত্তবৈভব কিংবা কামসাগরের স্রোতে ভেসে যাওয়া, তা থেকে পরিত্রাণ খুঁজেছেন কবি। হ্যাঁ, এসব বিত্ত বৈভবের প্রকৃত মালিক কে? আমরা সবাই তো এর বাহক মাত্র। এই অস্থাবর ভূলোকের মায়া ছেড়ে যেতে হবে সবাইকেই একদিন।
৫.
শাহ আবদুল করিম একজন প্রখর সমাজ সচেতন বাউল কবি। বিভিন্ন গণস্বার্থ বিষয়ক ইস্যুতে তিনি গান রচনা করেছেন অগণিত। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধপূর্ব এবং যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তিনি গ্রামে গ্রামান্তরে, হাটে বাজারে গণ জাগরণীর গান গেয়ে বেরিয়েছেন মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। বাউল কবি শাহ আবদুল করিমের গানে বাংলাদেশের গণ মানুষের আকাক্ষার কথা যেমনি প্রতিফলিত হয়েছে তেমনি লিপিবদ্ধ করেছেন তিনি প্রতিটি গণ-আন্দোলনের কথাও। মহান ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান-আন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, পঁচাত্তরে জাতির জনককে সপরিবারে হত্যার মর্মান্তিক কাহিনী, দেশে সামরিক শাসকের কালো ছায়া, নব্বই- এর গণঅভ্যুত্থান এসবই স্পষ্ট এবং জোরালোভাবে অত্যন্ত সত্যনির্ভর হয়ে উঠে এসেছে কবি শাহ আবদুল করিমের গানে। তিনি ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনে সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন। মওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহওরাওয়ার্দী, জাতির জনক শেখ মুজিবের সান্নিধ্য তার জীবনের চির মধুর স্মৃতি। ‘স্বাধীন বাংলার ইতিহাস’ পর্বে তাঁর লেখা একটি দীর্ঘ গানের কয়েক পঙক্তি এখানে প্রণিধানযোগ্য। তিনি গেয়েছেন উদার কণ্ঠে:
বাংলার দালাল রাজাকার, করেছিল কি ব্যবহার
তাহাদের কথা আমার আজো মনে পড়ে
বাংলার দুর্দিনে এই দালাল রাজাকারে
ইসলামের দোহাই দিয়া শত্রুকে সমর্থন করে।।
শেখ মুজিব ঘোষণা দিলেন, বাঙালি অস্ত্র ধরিলেন
ওসমানী দায়িত্ব নিলেন, মুজিব কারাগারে
নজরুল, তাজউদ্দিন ছিলেন দেশের ভিতরে
দেশপ্রেমিকগণ নিয়ে তখন মুজিব নগর সরকার গড়ে।।
(কালনীর কূলে/ গান: ১৩৭)
আবার এভাবে তার নানা গানেও উঠে এসেছে আমাদের মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত সমাজের চাওয়া পাওয়ার কথা।
৬.
‘গণমানুষের কবি’খ্যাত সিলেটেরই সন্তান দিলওয়ার ‘কালনীর ঢেউ প্রসঙ্গে দুটি কথা’ শীর্ষক লেখায় শাহ আবদুল করিমের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন, ‘শিল্পী শাহ আবদুল করিম আমাদের কর্মবিমুখ বন্ধ্যাত্বজনিত নৈরাশ্যের জগতে একটি গভীর নলকূপের সমান’। দিলওয়ার আরও লিখেছিলেন, ‘আমাদের দিগ্ভ্রান্ত সমাজে হাজার হাজার আবদুল করিম নীরবে এসে নীরবে চলে যায়। আমাদের আবদুল করিম এই অমাবস্যার পাহাড়ে উজ্জ্বলতম অন্তর্জ্বালা নিয়ে প্রতিবাদে বিস্ফোরণ হয়ে সক্রিয় থাকুন, এটাই কাম্য।’ অবশ্য কবি দিলওয়ার ১৯৮১ সালে শাহ আবদুল করিমকে নিয়ে উল্লিখিত লেখাটি লিখেছিলেন। এরপর দুজনেই দীর্ঘদিন বেঁচে ছিলেন। ঘনিষ্ঠ এই দুই বন্ধুর অন্তরঙ্গতা শেষ বয়সে এসে কিছুটা চির ধরেছিল। উভয়ের মত ও পথের কিছু ভিন্নতা তৈরি হলেও গান এবং কাব্যচর্চায় আজীবন সক্রিয় ছিলেন নিজেদের মতো করে। ২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর মারা গিয়েছিলেন বাউলসাধক শাহ আবদুল করিম আর ২০১৩ সালের ১০ অক্টোবর মারা গেলেন গণমানুষের কবি দিলওয়ার। উভয়ের শারীরিক প্রয়াণ সত্ত্বেও তাঁদের সৃষ্টির অমিয়ধারা বাঙালির সাহিত্যক্ষুধা মেটাবে যুগের পর যুগ। উভয়ের স্মৃতির প্রতি আবারো আমার গভীর শ্রদ্ধা।
৭.
শাহ আবদুল করিমকে বাউলগানের সর্বশেষ কিংবদন্তি বলা হয়ে থাকে। তিনি বাংলা লোকগানের অগ্রগণ্য সাধকদের একজন। অসম্ভব জনপ্রিয় ও তত্ত্ববহুল বাউলগানের পাশাপাশি তিনি রচনা করেছেন অজস্র গণসংগীত, যা ‘সর্বহারার দুঃখজয়ের মন্ত্র’ বলে সারস্বতসমাজ কর্তৃক প্রশংসিত হয়েছে। মানুষজন ভালোবেসে তাঁকে ‘বাউলসম্রাট’ অভিধায় অভিষিক্ত করেছেন। সেই শাহ আবদুল করিমের গান শুধু মনোরঞ্জনের জন্য নয়। তার গান অনেক পথনির্দেশনাও দিয়ে যায়। প্রতিটি গানের আলাদা ভাব রয়েছে। রয়েছে সাধারণ মানুষের কথা। তাকে তো তাই গণমানুষের বাউল বলা হয়। কারণ সমাজের সব স্তরের মানুষ তার গানের কথা বোঝে। একটি গানে আপনকথাও লিখেছেন, ‘সংসার বড় হইলো/ খোরাকির টান পড়ে গেলো/ জমি-জমা যা ছিল সব ফ্যালাইসি বেইচ্যা/ কষ্ট করে আছি এখন বাইচ্যা।’ আর তাই জীবনের অন্তিমে এসেও তার মনে হয় বাউল গানে নিজেকে জড়িয়ে তিনি ভুল করেননি। চরম অর্থসংকট ও পারিবারিক দৈন্যতা সত্বেও সংশয়হীনভাবে বলছেন, ‘আমি তো কোনো কিছু পাওয়ার আশায় গান গাই না। আমার মনে গান চায় তাই গান গাই। গান গাই বলেই তো তুমি আমার কাছে এসেছ, তাই না?’
৮.
বাউল কবি শাহ আবদুল করিম ১৩২২ বঙ্গাব্দের ফাগুন মাসে, ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলার কালনী নদীর তীরে উজানধল গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন।কবির নিজের ভাষ্য অনুযায়ী “মা বলেছেন জন্ম আমার ফালগুন মাসের প্রথম মঙ্গলবার।” শাহ আবদুল করিমের বাবা ছিলেন ইব্রাহিম আলী, মায়ের নাম নাইয়রজান বিবি। গ্রামের নৈশ বিদ্যালয়ে মাত্র ৮দিন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেন তিনি। তারপর যা শিখেছেন নিজের চেষ্টায়। দারিদ্র্যের মধ্যেই কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠেন শাহ আবদুল করিম। শৈশব থেকেই একতারা ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। সঙ্গীতের প্রতি তিনি এতটাই অনুরাগী ছিলেন যে তা ছেড়ে চাকরিতে জড়াননি তিনি। ফলে কাটেনি তাঁর দারিদ্র্য এবং বাধ্য হয়ে নিয়োজিত ছিলেন কৃষিশ্রমে। জীবন কেটেছে সাদাসিধেভাবে। তবে কোনও কিছুই তাঁর সঙ্গীতপ্রেম ঠেকাতে পারেনি।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাউল ও আধ্যাত্মিক গানের তালিম নিতে থাকেন কমর উদ্দিন, সাধক রশিদ উদ্দিন, শাহ ইব্রাহীম মোস্তান বকশ এর কাছ থেকে। দীর্ঘ এ সঙ্গীত জীবনে বাউল ও আধ্যাত্মিক গানের পাশাপাশি ভাটিয়ালি গানেও বিচরণ ছিল তাঁর। লালন শাহ, পাঞ্জু শাহ ও দুদ্দু শাহ এর দর্শনে অনুপ্রাণিত ছিলেন আবদুল করিম। তার বাউল হয়ে ওঠার পেছনের শক্তি সম্পর্কে বলেছেন, ‘নিঃসন্দেহে কালনী নদী। বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কালনী নদীর প্রেমে পড়েই আমি বাউল হয়েছি। তাছাড়া হাওরের আফাল (ঢেউ) আমাকে বাউল বানিয়েছে। ভাটির অপরূপ রূপবৈচিত্র্য না থাকলে হয়তো আমি বাউল হতে পারতাম না। কালনী নদীর উত্তাল স্রোত আর হাওর আমাকে প্রেম শিখিয়েছে। তবে এরও আগে একটা ঘটনার কথা বলতেই হয়। আমি তখন খুব ছোটো ছিলাম। আমার এক দাদা সারিন্দা বাজিয়ে গাইতেন—’ভাবিয়া দেখ তোর মনে/মাটির সারিন্দারে বাজায় কোন জনে’। এ গানটি আমার মনের ভেতরে ঢুকে যায়। এরপর ধীরে ধীরে গানের জগতে ঢুকে পড়ি।’ আবার, কৃতজ্ঞতার সাথে তার স্ত্রী সরলা’র কথাও স্মরণ করেছেন এভাবে, ‘আজকের করিম কখনোই করিম হইত না, যদি সরলার মতো বউ না-পাইতাম। সরলা আমার শত অত্যাচার মুখ বুঝে সহ্য করছে, আমার গানের পথে কখনো বাধা দেয় নাই। বরং কইছে—’আফনে গান ভালা পাইন, তাই আমিও গান ভালা পাই’। গাঁও-গেরামে গিয়া গান গাইতাম, মাসের পর মাস আমি বাড়িছাড়া। ঘরে চাউল-ডাইল আছে কি না, কুনুদিন খবর নেই নাই। কিন্তু সরলার কোনো অভিযোগ-অনুযোগ নাই। সব মাথা পাইতা নিছে। এই যে মানুষ আমারে চিনে, সরলা এই ছাড় না দিলে আমি তো কবেই শেষ হইয়া যাইতাম! অথচ সেই সরলা বিনা চিকিত্সায় মারা গেল। টাকার অভাবে আমি সরলার চিকিৎসাটুকু পর্যন্ত করাতে পারলাম না। এ দুঃখ আমাকে আমৃত্যু তাড়াবে।’
৯.
স্বল্পশিক্ষিত বাউল শাহ আবদুল করিম প্রায় দেড় সহস্রাধিক গান লিখেছেন এবং সুরারোপ করেছেন। বাংলা একাডেমীর উদ্যোগে তাঁর ১০টি গান ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে। শিল্পীর চাওয়া অনুযায়ী সিলেট বিভাগীয় কমিশনারের উদ্যোগে বাউল আব্দুল করিমের সমগ্র সৃষ্টিকর্ম নিয়ে সিলেট জেলা মিলনায়তনে তার রচনাসমগ্র (অমনিবাস) প্রকাশিত হয়। কিশোর বয়স থেকে গান লিখলেও কয়েক বছর আগেও এসব গান শুধুমাত্র ভাটি অঞ্চলের মানুষের কাছেই জনপ্রিয় ছিল। সাম্প্রতিককালে এ সময়ের বেশ কয়েকজন শিল্পী বাউল শাহ আব্দুল করিমের গানগুলো নতুন করে গেয়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করলে তিনি দেশব্যাপী পরিচিতি লাভ করেন। বাউল শাহ আবদুল করিমের ৬টি গানের বই প্রকাশিত হয় তার জীবিতকালেই। বইগুলো হলো- আফতাব সংগীত, গণ সংগীত, কালনীর ঢেউ, ভাটির চিঠি, কালনীর কূলে এবং দোলমেলা। তাঁর উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে আরও রয়েছে- ‘গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু-মুসলমান…… আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’, ‘বন্দে মায়া লাগাইছে, পিরিতি শিখাইছে’, ‘বসন্ত বাতাসে’, ‘আমি কূলহারা কলঙ্কিনী’, ‘সখী, কুঞ্জ সাজাও গো’ ইত্যাদি।
১০.
বাউল শাহ আবদুল করিম ২০০১ সালে একুশে পদক লাভ করেন। এছাড়া দ্বিতীয় সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ডস অনুষ্ঠানে এই বাউল সম্রাটকে আজীবন সম্মাননায় ভূষিত করা হয়। এছাড়াও ২০০০ সালে কথা সাহিত্যিক আবদুর রউফ চৌধুরি পদক পান। বাউল সাধক শাহ আবদুল জীবনের একটি বড় অংশ লড়াই করেছেন দরিদ্রতার সাথে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সময় তার সাহায্যার্থে এগিয়ে এলেও তা যথেষ্ঠ ছিল না।উল্লেখ্য, ২০০৬ সালে সাউন্ড মেশিন নামের একটি অডিও প্রকাশনা সংস্থা তার সম্মানে ‘জীবন্ত কিংবদন্তীঃ বাউল শাহ আবদুল করিম’ নামে বিভিন্ন শিল্পীর গাওয়া তার জনপ্রিয় ১২ টি গানের একটি অ্যালবাম প্রকাশ করে। এই অ্যালবামের বিক্রি থেকে পাওয়া অর্থ তাঁর বার্ধক্যজনিত রোগের চিকিৎসার জন্য তার পরিবারের কাছে তুলে দেয়া হয়। এই কিংবদন্তি বাউল কবি ১৯৬৪ এবং ১৯৮৫ সালে প্রবাসী বাঙালিদের আমন্ত্রণে সঙ্গীতানুষ্ঠানে অংশ নিতে দুবার ইংল্যান্ড ভ্রমণ করেছেন। নানা পুরস্কার-সম্মাননা পাওয়া নিয়ে একান্ত সরল অনুভূতি জানাচ্ছেন অকপটে, ‘পদকের আশায় কোনোদিন গান গাইনি। গান গাইছি মনের টানে। মানুষ ভালো পাইয়া সম্মান দিছে। তবে এইসবের প্রতি আমার বিন্দুমাত্রও আগ্রহ নাই। এমনও তো ঘটনা আছে—পদক আনতে শহরে গেছি, আইবার সময় পকেটে টাকা নাই। এই পদক-টদকের কোনো দাম নাই। মানুষ আমারে ভালা পায়, সেইটাই আসল কথা।’ এক সাক্ষাৎকারে এ নিয়ে তার ক্ষোভের কথা বলেছিলেন এভাবে, ‘এত সংবর্ধনা, সম্মান দিয়ে আমার কী হবে? সংবর্ধনা বিক্রি করে দিরাই বাজারে এক সের চালও কেনা যায় না। পেটে যদি ভাত না থাকে করিম মেডেল গলায় দিয়ে কী করবে?’
১১.
শেষ বয়সে এসে বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম দীর্ঘদিন শ্বাসকষ্ট, কিডনির জটিলতা, ফুসফুসে ইনফেকশন এবং বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন। চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায়ই ২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে উজান ধল গ্রামে স্ত্রী সরলা বিবির কবরের পাশে সমাহিত করা হয়। কালণীর ঢেউ আছড়ে পড়া উজানধলের বাড়িতে প্রিয়তমা স্ত্রী সরলার পাশে আজ চিরনিদ্রায় শায়িত বাউল সম্রাট । সেই সমাধি ঘিরে আজো প্রতিটি ক্ষণে বেজে উঠে তার শিষ্যদের বাঁশির করুণ রাগিনী কখনোবা কাঠিঢোলে উতাল শব্দে মুখর হয়ে উঠে উজান ধলের আকাশ বাতাস।
১২.
বাউল এই কবি তার গান নিয়ে আপন ভাবনার কথা বলেছেন এভাবে, ‘আমি গানপাগল মানুষ। গানই আমার জীবনে সবকিছু। ছোটবেলা থেকে আজ পর্যন্ত গান গেয়ে এসেছি। দেশ-বিদেশের অনেক জায়গায় গান গাইবার জন্য মানুষ আমাকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে গেছে। আমি অনেক জায়গায় গেছি। গান গাইবার জন্য মানুষের সম্মান ও ভালোবাসা পেয়েছি।’ বলছেন, ‘ভর-আসরে হাজারো মানুষের সামনে গান গাওয়ার মজাই আলাদা। আসলে মানুষের কাছাকাছি থাকতেই আমি বেশি পছন্দ করি।’ সেই তিনিই সমাজ ও রাজনীতি নিয়ে বলেছেন, ‘আমি অমুক দল-তমুক দলের রাজনীতি-টাজনীতি সমর্থন দেই না। আসল কথা হলো মানুষের পক্ষে কথা কওয়া। গরিব, শ্রমিক ও দিনমজুর মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য সারাজীবন কথা বলেছি, গান গেয়েছি। আমি একটা গানে বলেছি—’শোষণের বিরুদ্ধে আমি শোষিতের গান গাই।/আপোসহীন সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে চাই’ বিপ্লব আর সংগ্রাম আমার গানের মূল চেতনা। আমার রাজনীতিও তা-ই। যেখানে অন্যায় সেখানে প্রতিবাদ, সেটা গান ও কথায় দুভাবেই করে যাচ্ছি। তবে বিভিন্ন জায়গায় শেখ মুজিবের সঙ্গী হওয়ায় অনেকে ভাবত আমি বুঝি তাঁর দল করি। একবার তো আওয়ামী লীগের নেতারা আমাকে সুনামগঞ্জ আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক করেছিল। গান-টান গাইতাম বলে হয়তো আমাকে এই পদ দিয়েছিল।’
১৩.
বাউল শাহ আবদুল করিম কবিয়াল রমেশ শীলের সঙ্গেও এক মঞ্চে গান গেয়েছেন। অনেক বিখ্যাত বাউলসাধকদের সঙ্গেও তার পরিচয় ছিল। এ সম্পর্কে বলেছেন, ‘কাগমারীতে রমেশ শীলের সঙ্গে এক মঞ্চে গান গেয়েছি। তিনি এ সময় আমার গান শোনে প্রশংসা করে উত্সাহও দিয়েছিলেন। এছাড়া উকিল মুন্সী, জালালউদ্দীন খাঁ, আবদুস সাত্তার, বারিক মিয়া, কামাল উদ্দিন, আবেদ আলী, মিরাজ আলী, দুর্বিন শাহ, মজিদ তালুকদার—এঁদের সবার সঙ্গে গান গেয়েছি। আরও অনেকের সঙ্গে গেয়েছি, যাঁদের নাম তাৎক্ষণিকভাবে মনে পড়ছে না।’ লালনের গান সম্পর্কে তার মূল্যায়ন, ‘লালনের গানকে আমি খুব গুরুত্ব দেই। তাঁর গান ছোটোবেলা থেকেই শুনছি ও গাইছি। তাঁকে আমি একজন বড় দার্শনিক মনে করি। তাঁর গানে তত্ত্ব আছে, দর্শন আছে।’ আর রাধারমণ কিংবা হাসন রাজাকে নিয়ে বলেছেন, ‘রাধারমণের গান তো আমাদের ভাটি এলাকার প্রায় সব মানুষই জানে। যাঁরা গান গায় না, তাঁরাও রাধারমণের গান মনের আনন্দে গান। বিয়ে বাড়িতে, কীর্তনে রাধারমণের গান প্রচলন আছে। আর হাসন রাজা ইদানীং মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা পাইছে। আরও আগে উজির মিয়া নামে এক গায়ক হাসন রাজার গান সব সময় গাইতেন, তাঁর নামগন্ধ পর্যন্ত এখন কোনো মানুষ নেয় না। রাধারমণ আর হাসন রাজা—দুজনেই প্রকৃত সাধক।’
১৪.
সাধারণত বাউলেরা দেহসাধনা নিয়ে মগ্ন থাকেন। কিন্তু তার গানে আমরা দেহসাধনার পাশাপাশি গণমানুষের মুক্তির বিষয়টিও জোরেসোরে উচ্চারিত হতে দেখেছি। ‘এটা কি বাউলের চরিত্রের বৈপরীত্য নয়?’ এমন প্রশ্নের জবাবে বাউল শাহ আবদুল করিম বলেন, ‘মানুষ-ই যদি না থাকে তাহলে দেহসাধনা করবে কে? দেহসাধনা করতে তো কেউ বাধা-টাধা দিচ্ছে না, তবে বিপন্ন মানুষের কথাও চিন্তা করতে হবে। গণমানুষের মুক্তি প্রয়োজন। তাই আমি সুযোগ পেলেই মানুষের দুঃখ-দুর্দশার কথা তুলে ধরি।’
১৫.
দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত বাউল কবি শাহ আবদুল করিমের একটি সাক্ষাৎকারের চুম্বকাংশ আগ্রহী পাঠকের জন্য তুলে ধরার লোভ সামলাতে পারছি না।-
প্রশ্ন : আপনার সেই বিখ্যাত গান ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’ সম্পর্কে জানতে চাইছি। এটা কোন প্রেক্ষাপটে লেখা?
শা আ ক : আগের দিন আর নাই। আমরা যৌবনে যা দেখেছি, তা আর এখন নাই। মানুষে-মানুষে মেলামেশা উঠে গেছে। আগের মানুষ সহজ-সরল ছিল। আর এখন মানুষ তালাতালি মারামারি কাটাকাটিতে ব্যস্ত। কারে মেরে কে খাবে, এটাই এখন আসল কাজ। আগে হিন্দু-মুসলমানে একটা সুসম্পর্ক ছিল। হিন্দুদের বাড়িতে পূজাটুজা হলে মুসলমানেরা যেত, মুসলমানদের বাড়িতে ঈদটিদ এলে হিন্দুরাও আসত। নিজেদের মধ্যে সমপ্রীতি ছিল। ধর্মটর্ম দিয়া সংসার চালাইত না, ব্যবসা-বাণিজ্য তো দূরের কথা। জাতের কোনো ভেদাভেদ ছিল না। এগুলো হঠাত্ করে হারিয়ে গেছে। এখন এক ধর্মের মানুষ আরেক ধর্মের মানুষকে সহ্য করতে পারে না।
প্রশ্ন : এই যে ধর্ম নিয়ে সারা বিশ্বেই উশৃঙ্খলতা-মারামারি, এটা কীভাবে দেখছেন?
শা আ ক : একটু আগে বললাম না, এটা অধর্ম। ধর্মকে পুঁজি করে কিছু ধান্ধাবাজ ব্যবসা-বাণিজ্য করছে। এদের কাছ থেকে দূরে থাকতে হবে। কিছু মোল্লা-মুন্সি-পুরোহিত ধর্মের দোকান খুলেছে। নিজেদের স্বার্থের জন্য এরা কথায় কথায় বিভেদ সৃষ্টি করে। আর আমাদের বাংলাদেশ তো হিন্দু-মুসলমানের দেশ। মানুষে-মানুষে কত সমপ্রীতি ও বন্ধন ছিল। আজ তা হারিয়ে যাচ্ছে। বড়ই আফসোস হয়। আমি শিষ্যদের বলি, আমরা হিন্দু-মুসলমান এটা বড় নয়; আমরা বাঙালি, আমরা মানুষ। পৃথিবীর সব মানুষ ভাই-ভাই, এই কথাটা মনে রাখতে পারলে আর কোনো ঝগড়া-বিবাদ থাকত না বোধহয়।
প্রশ্ন : আপনার গ্রামের উগ্রপন্থি কট্টর মৌলবাদী গোষ্ঠীরা নাকি আপনার স্ত্রী সরলা এবং প্রিয় শিষ্য আকবরের জানাজা পরাতে রাজি হয়নি?
শা আ ক : ঠিক। আমার স্ত্রী সরলা মারা যাওয়ার পর গ্রামের ইমাম সাহেব বললেন—’বাউলের স্ত্রীর জানাজা পড়ানোর দরকার নাই।’ আবার আকবর মারা যাওয়ার পর মসজিদের মাইকে তার মৃত্যুর সংবাদ প্রচার করেনি। তার দোষ, সে আমার সঙ্গে থেকে গানটান গেয়ে নাকি বেশরা ও ইসলামবিরোধী কাজ করেছে। তাই সে আমার মতোই কাফের হয়ে গেছে। বেতনভোগী ইমামের কথা শুনে আর রাগে-দুঃখে নিজেই আমার বাড়িতে কবর খুঁড়েছি। আকবরের জানাজা পড়িয়ে দাফন করেছি। গ্রামের কেউ কেউ আইছিল, কেউ কেউ আয়ে নাই।
প্রশ্ন : অনেক আগেও সেই একই ধরনের ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর শিকার হয়ে আপনি বাড়ি ছেড়েছিলেন। সে সময়ের কথা কী মনে আছে?
শা আ ক :মনে আছে কিছু কিছু। ঈদের নামাজে গেছি। এক মুরুব্বি আমাকে দেখেই বললেন, ‘করিম ইসলাম ধ্বংস কইরা ফালাইতাছে। গানবাজনা ইসলামে হারাম, এরপরও সে গান গাইতাছে। এইটার বিহিত করা দরকার’। তিনি ইমাম সাহেবকে সামনে রেখে সব মানুষের সামনে তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘গান গাওয়া ইসলামে হালাল কি না?’ ইমাম সাহেব বললেন—’গানের সুরে যদি আল্লাহকেও ডাকে, তাহলেও গুনা হবে’। ব্যাস, আর যায় কই? ওই মুরুব্বি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন—গান ছাড়ব কি না? আমি বললাম—সেটা কখনোই আমি পারব না। উত্তর শুনে ওই মুরুব্বি মানুষটি রেগে গেলেন। তিনি বললেন, ‘এত স্পর্ধা, ইমাম সাহেব ও মুরুব্বিদের মুখের ওপর কথা। সেটা মেনে নেওয়া যায় না।’ এরপর আমি বললাম, ‘এখন বললাম গান ছেড়ে দেব, পরে ছাড়লাম না। তাই এ ধরনের মিথ্যা কথা আমি বলতে পারব না। নিজে যা বিশ্বাস করি, তা-ই বলেছি। আপনার যদি এ কারণে আমাকে গ্রামে জায়গাও না দেন, তাতেও আমি রাজি। আমি পাশের দাসগ্রাম ভাঙাডহরে চলে যাব। আমার বিশ্বাস—তারা আমারে জায়গা দিব।’ এমন সময় আরেক মুরুব্বি আমার পক্ষ নিয়ে উঠে বললেন, ‘হিন্দু-মুসলমানের দেশ। কে না বাউলা-ঘাটু গান গাইছি। আর এখন ঈদের নামাজে আইসা এর বিচার বইছে। এ বিচার তো পরেও করা যায়।’ এরপর আরও কয়েকজন একই রকম কথা বললে শেষে সবাই চুপ হয়ে যান। পরে নামাজ শেষে বাড়ি ফিরি। মনটা খারাপ হয়ে যায়। এরপর থেকে প্রায় প্রতি শুক্রবারে জুম্মার নামাজের আগে-পরে মসজিদে মুসল্লিরা আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলে—গান-বাজনা করে আমি নাকি বেশরা কাজ করছি। তখন গ্রামের আশপাশে সারারাত ধরে ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছিল। সেই ওয়াজে দেশের বিশিষ্ট ওয়াজিরা এসে আল্লা-রসুলের নাম না-নিয়ে আমার শ্রাদ্ধ করার কাজে যোগ দিয়েছিল। রাতভর অকথ্য ভাষায় আমাকে গালিগালাজ করেছিল। শেষে একসময় পরিবারের নিরাপত্তার কথা ভেবে গ্রাম ছাড়ি।
প্রশ্ন : পরে আবার বাড়ি ফিরলেন কীভাবে?
শা আ ক : হেমন্তে বাড়ি ছেড়েছিলাম, পরের বর্ষায়ই গ্রামে প্রতিযোগিতামূলক বাউল গানের আসর বসে। সে আসরে আমাদের গ্রামের বাউলদের ভিন গ্রামের বাউলেরা হারিয়ে দিচ্ছিলেন। এ অবস্থায় গ্রামের সবাই মিলে আমাকে আবার গ্রামে ফিরিয়ে নিয়ে এসে ওই বাউলদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় খাড়া করায়। আমরা জিতেও যাই। পরে গ্রামবাসীরাই আমাকে গ্রামে থাকার জন্য জোরাজুরি করে। এরপর গ্রামেই থেকে যাই।
প্রশ্ন : আর ঈশ্বর কিংবা সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে আপনার ভাবনা কী?
মানুষের মাঝেই ঈশ্বর বিরাজমান। মানুষের সেবা করা মানে ঈশ্বরের সেবা করা। এটাই সত্যি, এটাই বাস্তব কথা। কথায় আছে না, ‘জীবে প্রেম করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর’। আমি একটি গানে লিখেছি—’তন্ত্রমন্ত্র করে দেখি তার ভিতরে তুমি নাই/শাস্ত্রগ্রন্থ পড়ি যত আরো দূরে সরে যাই/কোন সাগরে খেলতেছ লাই/ভাবতেছি তাই অন্তরে।’ তন্ত্রমন্ত্র না পড়ে মানুষের সেবা করলেই স্রষ্টার সন্ধান পাওয়া যায়। তাই আমি বলেছি—’মসজিদ-মন্দির-গির্জাঘরে/কেউ খোঁজে জঙ্গল-পাহাড়ে/আবদুল করিম বিশ্বাস করে/আমাতে তুমি রয়েছ’ মানুষের ভালোবাসা পেলেই আমি মনে করি স্রষ্টার ভালোবাসা পাওয়া যায়। কারণ মানুষ ছাড়া স্রষ্টা নয়। ধর্মে আছে—’আমি ছিলাম গুপ্ত ভাণ্ডার, আমাকে প্রকাশ করতেই এই সৃষ্টি।’ তো সৃষ্টিটাই তাঁর রূপ। মানুষ যদি না থাকে তাহলে স্রষ্টা ডাকবে কে?
প্রশ্ন : আপনার দেওয়া একটি সাক্ষাত্কার পড়েছিলাম। সেখানে আপনি এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, ‘মন্ত্রপড়া ধর্ম নয়, কর্মকেই ধর্ম মনে করি। লাখ লাখ টাকা খরচ করে হজ পালনের চেয়ে এই টাকাগুলো দিয়ে দেশের দুঃখী-দরিদ্র মানুষের সেবা করাটাকে অনেক বড় কাজ মনে করি। কতিপয় হীন মোল্লা-পুরুত আমাদের ভাইয়ে-ভাইয়ে বিভাজন নিয়ে এসেছে।’
শা আ ক : হ্যাঁ, বলেছিলাম বোধহয়। আমি এখনো সেটা বিশ্বাস করি। একটা গান আছে না? ‘শতবর্ণের গাভী রে ভাই, একই বর্ণের দুধ, ত্রিজগত্ ভ্রমিয়া দেখি একই মায়ের পুত’। তুমি হিন্দু হলে পূজা করো, মুসলমান হলে নামাজ পড়ো, এতে তো কেউ বাধা দিচ্ছে না। তাহলে এসব নিয়ে দ্বন্দ্ব কেন? আসলে স্বার্থের কারণেই ধর্ম নিয়ে দলাদলি-মারামারি হচ্ছে।
প্রশ্ন : একই সাক্ষাত্কারে আরও কিছু কথা আমার মনে ধরেছিল। একেবারে পল্লি একটি অঞ্চলে বসে আপনি এ ধরনের চেতনা লালন করতে পারেন, সেটি অবিশ্বাস্য লাগে।
শা আ ক : তুমি কোনটির কথা বলছো?
প্রশ্ন : ওই যে আপনি বলেছিলেন—’ঈশ্বরকে আমি মনে করি একটা পেঁয়াজ, খোসা ছিলতে গেলে নিরন্তর তা ছিলা যায় এবং হঠাত্ এক সময় দেখি তা শূন্য হয়ে গেছে। আমি ঈশ্বরকে এক বিশাল শক্তি হিসাবে গণ্য করি, ব্যক্তি হিসাবে নয়। ব্যক্তি কখনো একই সময়ে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রূপে অবস্থান করতে পারে না; শক্তি তা পারে। বৈদ্যুতিক শক্তির কথা ধরুন, একই সঙ্গে কোথাও বা ফ্যান ঘুরাচ্ছে, কোথাও বাতি জ্বলাচ্ছে, কোথাও ইন্ডাষ্ট্রি চালাচ্ছে…। আল্লা নিজেই যখন কর্তা, তার তাহলে এত কেরানি রাখার কী দরকার আমি বুঝে উঠতে পারিনি।’ এ কথা নিয়ে বেশ আলোচনা-সমালোচনা হয়েছিল।
শা আ ক : আমি মিথ্যে কথা তো বলিনি। এটাই সত্য। এটাই আমি মনে করি। নিজে যেটা বিশ্বাস করি, হূদয়ে লালন করি, ধারণ করি, সেটাই আমি অকপটে বলি। কারো হুমকি-ধামকি কিংবা সমালোচনার ধার ধারি না। এক গান লিখেছিলাম—’পাই না তোমার ঠিক-ঠিকানা/ নাম শুনে হলেম পাগল/ যার-তার ভাবে সবাই বলে/ বুঝি না আসল-নকল’। তবে এখন সে প্রসঙ্গে যাচ্ছি না। এটা যার যার বিশ্বাস। তুমি আল্লা-ভগবান-গড-ঈশ্বর যা-ই বলো না কেন, সবাই একটা শক্তি হিসাবে কাজ করছে। এর বাইরে কিন্তু নয়।
প্রশ্ন : এটা ছাড়াও দেশের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন প্রসঙ্গ নিয়েও কিন্তু বেশ বিতর্ক উঠেছিল। অনেকে মনে করেন—বোধহয় এ মন্তব্যের কারণেই হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে আপনার সম্পর্কের অবনতি হয়েছে।
শা আ ক : হুমায়ূন সাহেব অত্যন্ত জ্ঞানী-গুণী মানুষ। আমি তাঁকে শ্রদ্ধাও করি। আমাকেও তিনি শ্রদ্ধা করেন, ভালোবাসেন। একবার তিনি টিভিতে একটি অনুষ্ঠান বানানোর জন্য একজন লোককে আমার কাছে পাঠালেন। প্রচার আমি কোনোসময়ই চাইনি, তখনো তা-ই করেছিলাম। কিন্তু লোকটির চাপাচাপিতে ঢাকা গেলাম। হুমায়ূন সাহেব আমার সাক্ষাত্কার নেওয়ালেন, গান গাওয়ালেন। আমি ফিরে আসার সময় উনি সৌজন্যসাক্ষাত্টুকু পর্যন্ত করলেন না, গাড়ির ড্রাইভারকে দিয়ে কিছু টাকা পাঠিয়ে দিলেন। আমার হাসি পেল। এই টাকার জন্য কি আমি এতদূর ঢাকা ছুটে গিয়েছিলাম? আমি হাওরের বনে-বাদাড়ে বড় হয়েছি, মনটা সে রকমই বড়। টাকা আমার কাছে কিছুই না। এই করিম টাকার ধান্ধা করলে এতদিনে অনেক বড়লোক হতে পারত! কই, কখনো তো টাকার পেছনে ছুটিনি। এ ঘটনাটি আমাকে খুব পীড়া দেয়। পরে অনুষ্ঠানটি প্রচারের তারিখও তিনি আমাকে জানাননি। সে ঘটনাই আমি সাক্ষাত্কারে বলেছিলাম। পরে আর কখনো হুমায়ূন আহমদের কাছে যাইনি। সত্য কথা বলার কারণে যদি সম্পর্কের অবনতি হয়ে থাকে—তাতে তো আমার আর কিছুই করার নাই।
প্রশ্ন : কিন্তু আপনি নাকি হুমায়ূন আহমেদকে ‘মরা গরুর হাড্ডির কারবারি’ বলেছিলেন?
শা আ ক :এটা আসলে ঘটনার প্রেক্ষাপটে বলা একটি কথা। মূলত মানুষের কাছে মানুষের মূল্যটাই আসল—সেটাই বলেছি। আর আমি জানি—যে করিম এখন না খেয়ে দিনের পর দিন কাটাচ্ছে, একদিন সে করিমকে নিয়েই ব্যবসা হবে, বাণিজ্য হবে। মরা করিমের হাড্ডি নিয়ে টানাটানি হবে, দর কষাকষি হবে। বৈশাখ মাসে আমার চোখের সামনে গ্রামেরই অনেক গৃহস্থ পরিবার পাঁচশ-ছয়শ মণ ধান তোলেন, কিন্তু আমার বাড়িতে পাঁচ বা ছয় মণ ধান ওঠে না। যদি নিজের স্বার্থ নিয়ে ভাবতাম তাহলে এতদিনে পাঁচতলা দালান তৈরি করতে পারতাম। কিন্তু টাকার লোভে তো চরিত্র আর মনুষ্যত্ব বিকিয়ে দেইনি, এটাই আমার তৃপ্তি। আর কিছু নয়। এ করিম সবসময় মানুষের কথা বলতে চেয়েছে। মানুষের ভালোবাসা নিয়েই আমি এখন মরতে চাই।

(অকৃপণ ঋণ / তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সমকাল, দৈনিক সংবাদ, দৈনিক জনকণ্ঠ, দৈনিক প্রথম আলো, দৈনিক কালের কণ্ঠ, ইন্টারনেট )

আবদুল্লাহ আল মোহন
১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬/১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭/১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৭/১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮/১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৮/১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯/১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

শেয়ার করতে এখানে চাপ দিন

সর্বশেষ খবর