Saturday, মে ১৮, ২০২৪
শিরোনাম

অনুকূলচন্দ্র ঠাকুর : জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

শেয়ার করতে এখানে চাপ দিন

আবদুল্লাহ আল মোহন


১.
‘মানুষ আপন টাকা পর, যত পারিস মানুষ ধর।’- ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র
অনুকূলচন্দ্র ঠাকুর, বাঙালি ধর্ম সংস্কারক, হিন্দু সাধক, চিকিৎসক এবং পাবনার সৎসঙ্গ আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা, সনাতন বা হিন্দুধর্মের সৎসঙ্গ নামক ধর্মসম্প্রদায়েরও প্রবর্তক হিসেবে সুপরিচিত। অনুকূলচন্দ্র ঠাকুর ১৮৮৮ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর (৩০ ভাদ্র ১২৯৫ বঙ্গাব্দ) আমাদের পাবনা জেলার হেমায়েতপুরে জন্মগ্রহণ করেন। উল্লেখ্য যে, ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র ১৯৬৯ সালের ২৬ জানুয়ারি দেহত্যাগ করেন। তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। পাবনা বললেই যে মানসিক হাসপাতালটির কথা সকলের মনে ভেসে ওঠে সেটি কিন্তু এই অনুকূলচন্দ্র ঠাকুরের আশ্রমের জমি অধিগ্রহণ করেই প্রতিষ্ঠা করা হয়। যা আমরা অনেকেই জানি না।আমাদের মনের অসুখের সুস্থতার মহান উদ্দেশ্যে উপমহাদেশে প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসা সেবা কেন্দ্রটির সাথে অনুকূলচন্দ্র ঠাকুরের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র ‘সৎসঙ্গ’ নামে একটি জনহিতকর সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। প্রকৃত অর্থে অনুকূল ঠাকুর মানবকল্যাণে তাঁর জায়গা-জমি যথাসর্বস্ব উৎসর্গ করে গেছেন। শ্রী শ্রীঅনুকূল চন্দ্রের পিতা-মাতার স্মৃতিরক্ষার্থে ‘স্মৃতি মন্দির’ মন্দির নির্মিত হয়েছিল। স্মৃতিমন্দিরটি অন্যান্য ইমারতের তুলনায় এখনো সুসংরক্ষিত অবস্থায় আছে। সম্প্রতি নব নির্মিত সৎসঙ্গ-আশ্রম-মন্দির সমন্বয়ে গঠিত স্থাপত্য নিদর্শনটি সহজেই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এখানে শ্রী শ্রীঅনুকূল চন্দ্রের জন্ম ও মৃত্যু বার্ষিকীকে কেন্দ্র করে বিরাট অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ঐ সময় এখানে প্রচুর ভক্ত ও অতিথির সমাগম হয়। অনুকূল ঠাকুরের নারী সংক্রান্ত বাণীর প্রতি আমার প্রবল আপত্তি আছে, তাঁর কিংবা ধর্মীয় গুরুদের অলৌকিকতায় যেমন আস্থা নেই, বিশ্বাসের ভাইরাসেও আক্রান্ত না হলেও একাধিকবার ‘সৎসঙ্গ’ আশ্রমের নানা আয়োজনে অংশ নিয়েছিলাম সুরের মোহে, মানুষের মানচিত্র পাঠলোভে। ফলে নৌকায় প্রবল উত্তল পদ্মা নদী পাড়ি দিয়ে অনুকূল ঠাকুরের ‘সৎসঙ্গ’ আশ্রম হয়ে ওপারের লালন সাঁইজির আখড়ার সাধুসঙ্গ সেরে রবি ঠাকুরের শিলাইদহ হয়ে আবারো পাবনার হেমায়েতপুরে ফেরার আনন্দময় অভিজ্ঞতার স্মৃতি বড়ই সুখেরই।
২.
সংশয়ী মনে কোন ঠাকুর দেবতায় আস্থা না থাকলেও এতকাল তবুও ঠাকুর বলতে তো একজনকেই চিনতাম, মানতাম, বুঝতাম তিনি রবি ঠাকুর কিন্তু একজন ‘পাবনার পুলা’ হিসেবে ঠাকুর বললে আরেকজনের কথা মনে না এসে পারে না, তিনিই অনুকূলচন্দ্র ঠাকুর। আমার প্রিয় স্বজন (নানা কারণে এখন প্রবাসী) প্রখ্যাত বাচিক শিল্পী রবি দা’র (Ravisankar Maitree) কল্যাণে যেমন অনেক জানার সুযোগ হয়, তেমনি প্রিয় কথাসাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের নানা লেখাতেও আমার এই স্বদেশী ঠাকুর মহাশয়ের পরিচয় পাই।আর এলাকার সন্তান হিসেবে সুযোগ পেলেই কতবার যে অনুকূলচন্দ্র ঠাকুরের আশ্রমে পরিভ্রমণে গেছি, তার কোন হিসেব নেই। তবে অনুকূলচন্দ্র ঠাকুরের জন্মতিথি উপলক্ষে প্রতি সেপ্টেম্বরে যে উৎসব আয়োজিত হয়, যেখানে দেশ বিদেশ থেকে নানা সাধু-সন্ন্যাসীগণ আসেন এবং সুরের সুরায় স্বর্গের কাছাকাছি থাকেন, সেই সময়গুলোতে একাধিকবার নিরবে, গোপনে অংশগ্রহণ করার সুযোগ নিয়েছি। কইতে কথা বাঁধে, বিয়ের পর সবাই প্রথম যায় হানিমুনে, আর এই অধম গিয়েছিলো ঠাকুর ভুমিতে। নানাভাবে সৎসঙ্গে সুরানন্দে জীবনানন্দ ভরপুর হয়ে উঠেছে সবসময়ই। সেসব কথা থাক, বারবার ফিরে পেতে, যেতে ইচ্ছে করছে সেই সুরের মেলায় ভেলায় সাধু সঙ্গ উপভোগের জগতে। আসলেই স্মৃতি বড্ড নৃশংস, মনঘাতক।
৩.
মালা মৈত্র রচিত ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে শক্তি মন্দির’ বইটি পাঠের পর অনুকূলচন্দ্র ঠাকুর এবং সৎসঙ্গ আশ্রম সম্পর্কে আমার ধারণাই পাল্টে যায়। ব্রিটিশ বিরোধী এবং ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে এই আশ্রম সংলগ্ন গোপন মুক্তি সংগ্রামী কর্মমকান্ড আমাকে দারুণ জাগিয়ে তোলে, অনুপ্রাণিত করে। অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতের মুক্তি সংগ্রামে নেতাজি সুভাষ বসুর সহযোগিতায় পাবনার এই শক্তি মন্দিরের স্বশস্ত্র প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটির গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা আমাকে দারুণভাবে গর্বিত করে। আর তখনও মনে ভাসে যে ঠাকুরের কথা তিনিই অনুকূলচন্দ্র ঠাকুর।
৪.
অনুকূলচন্দ্র ঠাকুরের পিতা শিবচন্দ্র চক্রবর্তী পেশায় ছিলেন একজন ঠিকাদার এবং মাতা মনোমোহিনী দেবী ছিলেন ভগবদ্ভক্তিতে পূর্ণ একজন মহীয়সী নারী। অনুকূলচন্দ্র পাবনা ইনস্টিটিউশনে নবম শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়ন করার পর পশ্চিমবঙ্গের নৈহাটি উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি কলকাতার ন্যাশনাল মেডিক্যাল স্কুল থেকে হোমিওপ্যাথিতে ডিগ্রি অর্জন করে নিজ গ্রামে প্র্যাক্টিস শুরু করেন।
৫.
অনুকূলচন্দ্র ঠাকুর (জন্ম : ১৪ সেপ্টেম্বর, ১৮৮৮ – প্রয়াণ : ২৬ জানুয়ারি, ১৯৬৯) বিশ্বাস করতেন: মানুষ শারীরিক, মানসিক ও আত্মিক এ তিন প্রকার ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। তাই তিনি মানসিক ব্যাধির চিকিৎসার প্রতিই বেশি জোর দিতেন, কারণ শারীরিক সুস্থতা অনেকটাই মানসিক সুস্থতার ওপর নির্ভর করে। তাই মায়ের নিকট দীক্ষা নেওয়ার পর অনুকূলচন্দ্র মানুষের আত্মিক উন্নয়নের জন্য কীর্তনদল গঠন করেন। কীর্তনের সময় তিনি মাঝে মাঝে দিব্যভাবে আবিষ্ট হয়ে পড়তেন। ওই সময় তাঁর মুখ থেকে উচ্চারিত বাণীসমূহ পরে সংগৃহীত হয়ে পুণ্যপুঁথি নামে প্রকাশিত হয়। তখন থেকেই লোকে তাঁকে ‘ঠাকুর’ বলে সম্বোধন করত।
৬.
সত্যনিষ্ঠা, সৎকর্মানুষ্ঠান এবং দীক্ষা গ্রহণের মধ্য দিয়ে মানুষের আত্মিক উন্নতি বিধানের উদ্দেশ্যে তিনি পাবনায় প্রতিষ্ঠা করেন সৎসঙ্গ আশ্রম। মূলতঃ স্বাবলম্বন ও পরনির্ভরশীলতা ত্যাগের দীক্ষাই অনুকূলচন্দ্রের সৎসঙ্গ আশ্রমের আদর্শ। শিক্ষা, কৃষি, শিল্প এবং সুবিবাহ- এ চারটি বিষয় হলো সৎসঙ্গের আদর্শ। অনুকূলচন্দ্র লোকহিতার্থে তপোবন বিদ্যালয়, দাতব্য চিকিৎসালয়, ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ, পাবলিশিং হাউজ, ছাপাখানা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করেন।
৭.
অনুকূলচন্দ্র বিপুল সংখ্যক গ্রন্থ রচনা করেছেন। এক হিসাব মতে, তাঁর রচিত বাংলা গ্রন্থের সংখ্যা ৮২ এবং ইংরেজি গ্রন্থের সংখ্যা ১২। এসবের মধ্যে পুণ্যপুঁথি, অনুশ্রুতি (৬ খন্ড), চলার সাথী, শাশ্বতী (৩ খন্ড), প্রীতিবিনায়ক (২ খন্ড) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের শিষ্যসম্প্রদায় এবং সৎসঙ্গের সাংগঠনিক কর্মকান্ড উভয় বাংলার নানা অঞ্চলে আজও সক্রিয়। ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন শহরে এর আশ্রম ও কার্যালয় আছে।
৮.
১৯৪৬ সালে তিনি বিহারের দেওঘরে যান এবং সেখানে সৎসঙ্গের আদর্শপুষ্ট একটি নতুন আশ্রম গড়ে তোলেন। ১৯৪৭ সালে বাংলা ভাগ হলে তিনি আর ফিরে আসেননি। ১৯৬৯ সালের ২৬ জানুয়ারি বিহারের দেওঘরে তিনি পরলোক গমন করেন।
৯.
এবার একটু ভক্তদের কাছে পরম প্রেমময় শ্রী স্রী ঠাকুর আনুকুল চন্দ্র প্রতিষ্ঠিত জীবের কল্যাণে আশ্রম সম্পর্কে কিছুটা ধারণা নেওয়া যাক। সৎসঙ্গ জনকল্যাণমূলক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। পাবনা জেলার হেমায়েতপুর গ্রামে এর কেন্দ্রীয় আশ্রম অবস্থিত। এর প্রতিষ্ঠাতা হিমাইতপুর নিবাসী শ্রীশ্রী ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র (১৮৮৮-১৯৬৯)। মানুষের মধ্যে প্রকৃত মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটাতে পারলেই যথার্থ কল্যাণ সাধন সম্ভব এই অনুভব থেকেই অনুকূলচন্দ্রের জীবনে সৎসঙ্গ আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। ‘সৎসঙ্গ’ নামে একটি সংগঠন ভারতের আগ্রার দয়ালবাগ নামক স্থানে পূর্ব থেকেই বিদ্যমান ছিল। রামানন্দ (১৪০০-১৪৭০), নানক (১৪৬৯-১৫৮১), কবীর (১৪৯৮-১৫৪৮), দাদু (১৫৪৪-১৬০৩) প্রমুখ সাধক বাহ্য আনুষ্ঠানিকতা বর্জিত অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী মরমিয়া ধর্মসাধনার যে ধারা প্রবর্তন করেন, আঠারো-উনিশ শতকের দয়ালবাগ সৎসঙ্গ ছিল তারই নব রূপায়ণ। এর প্রতিষ্ঠাতা স্বামীজি মহারাজের শিষ্য হুজুর মহারাজ ছিলেন অনুকূলচন্দ্রের জননী মনোমোহিনী দেবীর গুরু। অনুকূলচন্দ্র জননীর নিকটেই দীক্ষা লাভ করে তাঁর সহায়তায় সৎসঙ্গ আন্দোলন গড়ে তোলেন। সৎসঙ্গ জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের একটি মিলনক্ষেত্র। ১৯৫২ সালে এটি নিবন্ধীকৃত হয়ে প্রথম আত্মপ্রকাশ করে। মনোমোহিনী দেবী ছিলেন সৎসঙ্গ পরিষদের প্রথম সভানেত্রী। ‘অন্যে বাঁচায় নিজে থাকে। ধর্ম বলে জানিস তাকে\’ অনুকূলচন্দ্রের এই বাণীর আলোকে ধর্ম ও কর্মের সমন্বয়ে হিমাইতপুরের সৎসঙ্গ আশ্রমে আদর্শ শিক্ষাকেন্দ্র ‘তপোবন’, ‘মনোমোহিনী কলেজ অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’, ‘বিশ্ববিজ্ঞান কেন্দ্র’, ‘সৎসঙ্গ কেমিক্যাল ওয়ার্কস’, ‘মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ’, ‘সৎসঙ্গ প্রেস অ্যান্ড পাবলিশিং হাউজ’, ‘সৎসঙ্গ দাতব্য চিকিৎসালয়’, ‘কলাকেন্দ্র’, ‘মাতৃবিদ্যালয়’, ‘কুটিরশিল্প কেন্দ্র’, ‘সৎসঙ্গ কৃষি খামার’, সর্বসাধারণের জন্য ভোজনাগার ‘আনন্দবাজার’ ইত্যাদি গড়ে ওঠে। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, মহাত্মা গান্ধী, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক প্রমুখ রাজনৈতিক নেতা এবং দেশবিদেশের গুণিজন সৎসঙ্গ পরিদর্শন করে এর অসাম্প্রদায়িক ও মানবসেবামূলক কর্মকান্ডের প্রশংসা করেন। ১৯৪৬ সালে স্বাস্থ্যগত কারণে অনুকূলচন্দ্র বিহার রাজ্যের দেওঘর চলে যান। পরের বছর দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটলে তিনি আর ফিরে আসেননি; সেখানেই সৎসঙ্গের আশ্রম গড়ে তোলেন। ফলে হেমায়েতপুরের আশ্রম দুর্বল হয়ে পড়ে। ১৯৫২ সালে পূর্ব পাকিস্তান সরকার হুকুম দখল করে এ আশ্রমে মানসিক হাসপাতাল স্থাপন করে। বর্তমানে মূল আশ্রমসংলগ্ন ভূমিতে সৎসঙ্গ আশ্রম পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যশোর, ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, নেত্রকোনা প্রভৃতি জেলাসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও সৎসঙ্গের শাখা আশ্রম রয়েছে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে এবং পাশ্চাত্যেও এর কর্মধারা প্রসারিত। বর্তমানে অনুকূলচন্দ্রের জন্মভূমি হেমায়েতপুর সৎসঙ্গীদের নিকট পরমতীর্থ বলে গণ্য হয়।
১০.
নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু তিনবার শক্তি মন্দির এবং ঠাকুর দর্শনে আসেন। প্রথমবার আসেন I.C.S পাশ করার পর। ঠাকুর তখন কলকাতাতেই, দ্বিতীয় ও তৃতীযবার আসেন পাবনা সংসঙ্গ আশ্রমে। সুভাষ বসুর মা-বাবা ঠাকুরের দীক্ষিত ও একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন। একবার তারা ভক্তমন্ডলী সহ ঠাকুরকে পুরীতে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেদিনটি ছিল ১৯২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর। সেখানে ‘হরনাথ লজে’ প্রায় দুমাস রেখেছিলেন ঠাকুরকে। এই আদর্শ সৎসঙ্গী পরিবারের সন্তান সুভাষ বসু মা-বাবার কাছেই ঠাকুরের অমৃত জীবন কথা শুনেছিলেন। সুভাষ বসু ঠাকুর দর্শনে পাবনা সৎসঙ্গ আশ্রমে এলে ঠাকুরের অন্যতম ভক্তপার্ষদ পূজনীয় শ্রী সুশীল বসু তাঁকে আশ্রমের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখান।ঠাকুরের মতাদর্শ ও তাঁর পরিকল্পনার বিভিন্ন বিষয় নেতাজীর কাছে তুলে ধরেন সুশীলদা। আশ্রম ঘুরে নেতাজীর খুবই ভালো লাগল যে ঠাকুরের অধিকাংশ প্রচারকেরা বিবাহিত এবং সংসারী। ঠাকুরকে মাথায় রেখে সংসার ঠিক রেখেও বিশ্বসংসারের মাঙ্গলিক-ব্রতে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন এঁরা। আশ্রম ঘুরে নেতাজী বললেন – “সাধারনতঃ আশ্রম বলতে লোকে সন্ন্যাসী বা গৃহত্যাগীদের আশ্রমই বোঝে। গৃহী হয়ে পরিবার সহ আশ্রম জীবন -যাপন করবার দৃষ্টান্ত আপনারাই প্রথম দেখাচ্ছেন। পরিবার পরিজনের ভার ঘাড়ে করে,দৈন্য অভাব অভিযোগের মধ্য দিয়ে আপনারা এগিয়ে চলেছেন। তাই আমার মনে হয়, আপনারা একটা বড় গুরুদায়িত্ব নিয়েছেন। আপনারা যদি সত্যি সত্যি এভাবে আশ্রম গড়ে তুলতে পারেন তাহলে আপনারা দেশের কাছে একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন। গৃহী হয়েও আশ্রম জীবন যাপন করা যায় একথা লোকের কাছে আর অবিশ্বাস্য বলে বোধ হবে না। এরপর নেতাজী ঠাকুরের কাছে এসে ভক্তিভরে প্রাণাম করলেন। নেতাজীকে বসবার যে চেয়ার দেওয়া হয়েছে সেখানে বসলেন না তিনি – মাতৃভক্ত নেতাজী বললেন – “ঠাকুর আমার মায়ের ইষ্ট তাঁর সামনে আমি চেয়ারে বসতে পারি না”। বলে ঠাকুরের পদপ্রান্তেই বসে পড়লেন নেতাজী। ঠাকুর সস্নেহে নেতাজীর মা-বাবা এবং পরিবারের অন্যান্য সকলের কুশল সংবাদ নিলেন। তারপর নেতাজী ঠাকুরকে বললেন – “দেশের তো নানা কাজই করবার আছে। তা দেশের প্রকৃত সেবা করতে হলে কোথা থেকে আরম্ভ করতে হবে ? এ বিষয়ে আপনার মত কি? ঠাকুর নেতাজীর দিকে গভীর স্নেহল চোখে তাকালেন। তারপর ভাব বিভোর কন্ঠে বললেন -“আমার কথা হচ্ছে দেশের কাজ করতে হলে প্রথম মানুষ তৈরীর কর্মসূচী নিতে হবে। ভাল মানুষ পেতে হলেই বিবাহ-সংস্কার আশু প্রয়োজন। আর এটা এমনভাবে করতে হবে যাতে সব বিয়েগুলিই Compatible (সুসঙ্গত) হয়, আর Compatible বিয়ে মানেই বিহিত সঙ্গতি। বর্ণ, বংশ, আয়ু, স্বাস্হ্য ইত্যাদি সব হিসাব করে দেখে শুনে কজ করতে হয়। বিহিত বিবাহ হলেই ভাল সন্তানাদি আসে আর তখন তাদেরই দ্বারাই দেশের, দশের সবারই কাজ হয়। সেইজন্য মানুষ তৈরীর ব্যবস্থা আগে করা প্রয়োজন। দাশদা (দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ) যখন আমায় বললেন যে তিনি মানুষ খুঁজে পাচ্ছেন না যার উপর ভার দিয়ে তিনি একটু সরে দাঁড়তে পারেন তার উত্তরে আমি একথাই বলেছি”। ঠাকুরের কথা শুনে নেতাজীর চোখেমুখে গভীর চিন্তার ছাপ পড়ল। তাঁর চিন্তা জগত নতুন আলোড়ন সৃষ্টি হলো যেন। নেতাজী ঠাকুরকে বললেন- মানুষ তৈরীর যে আশু প্রয়োজন তা ভেবেছি,কিন্তু তা করতে হলে যে বিবাহ সংস্কার প্রয়োজন তা ভেবে দেখিনি।…. এখন ভেবে দেখছি ভাল সংস্কার-সম্পন্ন শিশু যদি না জন্মায় শুধু শিক্ষা তাদের বিশেষ কি করতে পারে ? বীজ থেকেই তো গাছ হয়, বীজ ভাল হলেই গাছ ভাল হবে। এটা আপনার কথা শুনে বুঝতে পারছি। কিন্তু এতে দীর্ঘসময় সাপেক্ষ। ঠাকুর দৃপ্তকন্ঠে বললেন – দীর্ঘ সময় তো নেবেই – আমরা তো এতদিন পর্যন্ত জাতির বা সমাজের জন্য কিছুই করিনি। বহু গলদ জমে গেছে। সাফ করতে সময় নেবে বৈকি? কোন Shortcut Programme (সংক্ষিপ্ত কর্মসূচী) এ জাতির সত্যিকার কল্যাণ হবে বলে আমার মনে হয় না।

(উৎসর্গ : সীমা বৌদি, লিটন Dhritabrata Sen বন্ধু যুগলেষু)

(অকৃপণ ঋণ / তথ্যসূত্র : বাংলাপিডিয়া, গুণিজন, অনুশীলন, উইকিপিডিয়া, দৈনিক প্রথম আলো, দৈনিক জনকণ্ঠ, দৈনিক ইত্তেফাক, ইন্টারনেট)

আবদুল্লাহ আল মোহন
১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/২৬ জানুয়ারি, ২০১৬/১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৬/২৬ জানুয়ারি, ২০১৭/১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৭/২৬ জানুয়ারি, ২০১৮/১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৮/২৬ জানুয়ারি, ২০১৯/১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

শেয়ার করতে এখানে চাপ দিন

সর্বশেষ খবর