Sunday, মে ১৯, ২০২৪
শিরোনাম

পার্থ প্রতিম মজুমদার : জন্মদিনের শুভেচ্ছাঞ্জলি

শেয়ার করতে এখানে চাপ দিন

আবদুল্লাহ আল মোহন

১. আমি পড়েছি মহা বিপদে, স্বজনপ্রীতির যন্ত্রণায়! চারিদিকে গত কয়েকদিন যাবত কেবলই পাবনা, পাবনা আর পাবনা! পর পর গত কয়েকদিন ধরে কারো ‘বোঝা বড় দায়’গভীর ‘লীলাচক্রে’পাবনার কৃতিসন্তান কবি বন্দে আলি মিয়া আর মহাশ্বেতা দেবির জন্মদিন গেলো, মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের মহাপ্রয়াণ দিনও রাত পোহালো, ভোরের আলো নিয়ে এলো বাংলাদেশে মূকাভিনয়ের পথিকৃত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মাইম শিল্পী, নিঃশব্দ কবিতার কবি পার্থ প্রতিম মজুমদারের জন্মদিন। ১৯৫৪ সালের ১৮ জানুয়ারি তিনি পাবনার কালাচাঁদ পাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। বর্তমানে তিনি ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে অবস্থান করছেন। বিশ্বখ্যাত মূকাভিনয়গুরু ‘মাস্টার অব মাইম’খ্যাত মার্সেল মার্সোর প্রিয় ছাত্রের জন্মদিনে জানাই নিরন্তর শুভ কামনা, শ্রদ্ধা। ২. ‘পাবনার পোলা-মাইয়াদের’নিয়ে সচরাচর বলা হয়ে থাকে, ‘বাড়ি যার পাবনা, নাই তার ভাবনা’। কিন্তু আমি তো দেখছি ভাবতে ভাবতে পাগলই হয়ে যাবো, যাবার দশা হয়ে পড়েছে। তখনওতো শুভাকংখি স্বজনগণ ভালোবেসেই আবার সেই পাবনাতেই ঠেলে পাঠাবেন।তা পাঠান, কি আর করা! কি মজা, কি মজা ! এই শীতে মায়ের হাতের খেজুরের রসের ‘আয়েস করে পায়েস’ খাওয়ার সুযোগটা মিলবে। ফলে ‘রথ দেখা আর কলা বেচা’একবারেই সেরে আসতে পারবো। আর এই রমনীয় শীতের ভ্রমণটা মোটেই বেরসিক হবে না আগেই বলে রাখছি কিন্তু! রসেবশে কথায় কথায় সেদিন বটতলায় আমার সংশয়ী কবিবন্ধু মনমোহন দাস ভীষণ টিপ্পনি কেটে বলছিলো, ‘পাবনা বাড়ি / রসের হাড়ি’। আমার ‘প্রেম জানে না রসিক কাঁলাচাঁদ’ সুরসিক বন্ধুটি আসলেই জানেন, ‘যে জন প্রেমের ভাব জানে না, তার সঙ্গে নাই লেনা-দেনা’। আর তাই এই ‘পাবনার পোলা‘র প্রতি তার প্রীতির হাড়ি ঝোলানো গাছটি সবসময় কণ্টকমুক্ত রাখতে সচেষ্ট থাকেন। ধান ভানতে শীবের গীত থাক।৩.নিঃশব্দ কবিতার কবি পার্থ প্রতিম মজুমদার কলকাতায় যোগেশ দত্ত মাইম একাডেমীতে মাইম মূকাভিনয় শেখার পর ১৯৮২ সালে প্যারিসের মার্সেল মার্সেইয়ের মাইম স্কুলে ভর্তি হন। আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে তিনি ইউরোপের বিভিন্ন দেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রে নিয়মিত অনুষ্ঠান পরিবেশন করছেন। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এ মূকাভিনেতা একুশে পদক এবং ফরাসি সরকারের সর্বোচ্চ সাংস্কৃতিক খেতাব নাইট-এ ভূষিত হয়েছেন। মঞ্চের অস্কার হিসেবে খ্যাত ফ্রান্সের মলিয়্যের পুরস্কার পেয়েছেন ২০০৯ সালে। সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ফ্রান্স সরকারের শেভালিয়র (নাইট) উপাধি (২০১১ পেয়েছেন তিনি। তিনিই প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে এ পদক পেলেন।তিনি মঞ্চের পাশাপাশি ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডার বিভিন্ন চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন। তাঁর অভিনীত একটি ফরাসি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ২৬টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার পায়। প্যারিস, ফ্রাঙ্কফুর্ট, নিউ ইয়র্কসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাঁর মূকাভিনয়ের প্রদর্শনী হয়েছে। প্রসঙ্গত, ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন, নাইকি, আইবিএম ও ম্যাকডোনাল্ডের মতো বিশ্বখ্যাত কোম্পানির পণ্যের প্রচারে মডেল হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি। তাঁর মাধ্যমেই বাংলাদেশে মূকাভিনয় পরিচিতি লাভ করে। ৪.সালটা ১৯৫৪। বছরের শুরুটা ছিল আর পাঁচটা বছরের মতোই। পাবনা জেলার কেউ জানতো না। বাংলাদেশের কেউ জানতো না। এমনকি ফ্রান্সেরও কেউ জানতো না একজন শিল্পীর সম্ভাব্য আগমনের কথা। একজন মা শুধু জানতেন। তিনি চিনতেন তাঁর সন্তানকে। তবে শিল্পী হিসেবে নয়। তার চেয়েও বড় জাদুকর, বড় শিল্পী, যে তার হাসি দিয়ে মুছিয়ে দিতে পারে অন্তরালের সমস্ত দুঃখ। আর একজন প্রেস ফটোগ্রাফারও জানতেন। এই জানাও শিল্পী হিসেবে নয়। সফর সঙ্গী হিসেবে। এবাড়ি ওবাড়ি ছবি তোলার সময় তাঁর ধুতি-পাঞ্জাবী ধরে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য আর একজনের পৃথিবীতে আগমন ঘটতে চলেছে। অবশেষে সেই দিন এলো। সেই বছরেরই ১৮ জানুয়ারি পাবনা জেলার কালাচাঁদপাড়ায় জন্মগ্রহণ করলেন পার্থ প্রতিম মজুমদার। তিনি ছিলেন বাবা মায়ের দ্বিতীয় সন্তান৷ ভাই বোনের সংখ্যা ছিল চারটি। তিনি ছাড়া ছোটবড় আরও তিনটি ভাই আর চার ভাইয়ের একটি মাত্র বোন। তাঁর বাবার নাম হিমাংশু কুমার বিশ্বাস এবং মায়ের নাম সুশ্রিকা বিশ্বাস৷ তাঁর স্ত্রীর নাম জয়শ্রী (ঝুমু)। পার্থ প্রতিম ও ঝুমু দম্পতির এক ছেলে ও এক মেয়ে৷ ছেলের নাম সুপ্রতিম ও মেয়ের নাম দোয়েল৷ ছোট বেলার তাঁর নাম ছিলো প্রেমাংশু কুমার বিশ্বাস । ডাক নাম ভীম। পাবনার জমিদার এবং প্রখ্যাত উচ্চাঙ্গসঙ্গীতশিল্পী ওস্তাদ বারীণ মজুমদার ছিলেন তাঁর দুঃসম্পর্কের আত্মীয়। উল্লেখ্য ওস্তাদ বারীণ মজুমদারেরই সন্তান সমকালের জনপ্রিয় কন্ঠশিল্পী বাপ্পা মজুমদার। মুক্তিযুদ্ধের সময় বারীণ মজুমদারের মেয়েটি হারিয়ে যায়। তখন মেয়ে-হারানো বারীণ মজুমদারের অনুরোধে তিনি চলে যান ঢাকার ২৮ নম্বর সেগুনবাগিচার বাসায়। তখন থেকেই তিনি পার্থ প্রতিম মজুমদার নামে পরিচিত। ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি সেগুনবাগিচায় ছিলেন।৫.ছেলে একটা জন্মালো বটে কিন্তু একেবারেই লিকলিকে। তালপাতার সেপাই। ফুঁ দিলে উড়ে যাবে। ছেলের দিকে তাকালেই মায়ের মন মায়ায় ভরে যায়। আহা বেচারা, মানুষের স্বাস্থ্য এতো খারাপ হয়। অনেকেই ধারণা করেছিলেন যদি দুটো ডানা নিয়ে এ ছেলে জন্মাতো তাহলে উড়ে বেড়াতে এর কোন অসুবিধাই হতোনা। ঠাম্মার ধারণাও এর কিছু ব্যতিক্রম নয়। তাই তিনি পার্থকে ডাকেন ফুরফুরি বলে। ফুরফুরি হচ্ছে ফড়িং। এ ঘাস থেকে ও ঘাসে উড়ে বেড়ায় যে, পার্থ হলেন ঠাম্মার সেই ফড়িং। বাবার চিন্তা ছিল অন্য রকম। চিন্তাটা কোন অংশে দুশ্চিন্তার কিছু কম নয়। এই তালপাতার সেপাইটার গায়ে গতরে কি কোনদিন মাংস লাগবে? তার উপরে মা যদি তাকে ফুরফুরি ডাকেন তাহলে তো আর আশাই নেই। একদিন সাহস করে মাকে তিনি বলেও ফেললেন সেই কথা। তাঁর মা, ফুরফুরির ঠাম্মা, বললেন, ‘তুই তবে নাম ঠিক করে দে।’ নাম ঠিক হলো। মহাভারতের সবচেয়ে শক্তিশালী চরিত্রের নামে নাম- ভীম। বিষয়টা অনেকটা কানা ছেলের নাম পদ্মলোচনের মতোই। তারপরেও বাবার আশা নামের কারণে যদি ছেলের গায়ে একটু মাংস লাগে। সেই থেকে তিনি ভীম। পাবনার কালাচাঁদপাড়ার সবাই এই নামেই তাঁকে ডাকে। তাঁর বাবা মা ঠাম্মা আর বন্ধুরা সব্বাই। আরও একটা নাম কিন্তু তাঁর ছিল। সেটা প্রেমাংশু কুমার বিশ্বাস।৬.পাবনার কালাচাঁদপাড়াই পার্থর প্রথম স্কুল। বাড়ি থেকে মাত্র দু’তিনটি বাড়ি পরে ছিল জুবলী ট্যাংক নামে একটা বিশাল পুকুর। আর পুকুরের পাশেই জুবলী স্কুল। সেখানেই পড়াশোনার প্রথম পাঠ। এমন কিছু ভালো ছাত্র নয়। তারপরেও ক্লাসরুমের প্রথম বেঞ্চটা ছাত্রের খুব পছন্দের। ঐটাই পার্থকে স্কুলে টানতো। অন্য কিছু নয়। আর তাই রোজই এটা ধরা তাঁর চায়ই। ঘুম থেকে উঠেই এর বাড়ির উঠোন আর ওর বাড়ির বাগানের ভেতর দিয়ে চলে যেতেন সকালের স্কুলে। অন্য বাড়ির ছেলেরা তখনও হয়তো স্নান সারেনি, খাওয়া সারেনি। অথচ ঐদিকে বইখাতা রেখে পার্থ ফাস্ট বেঞ্চ দখল করে বসে আছেন।৭.এই স্কুলে ভর্তি হওয়ার ঘটনাটাও ছিল একটু অন্য রকম। বাবা নিয়ে গেছেন দাদাকে স্কুলে ভর্তি করাতে। দাদা বাবার সাথে সাইকেলে চড়ে স্কুলে গেল। ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হলো আর ফিরে আসলো পেছনের ক্যারিয়ারে বাঁধা একটা মস্ত বড় মিল্ক পাউডারের কৌটো নিয়ে। তখন স্কুলে ভর্তি হলে একটা করে মিল্ক পাউডারের কৌটা পাওয়া যেত। কিন্তু কৌটা যেটা পাওয়া গেল সেটাতো দাদার। তাতে তো তাঁর কোন অধিকার নেই। তাই তিনি আছড়ে বিছড়ে শুরু করলেন কান্না, তাঁকেও স্কুলে ভর্তি করাতে হবে। কিন্তু তখনওতো তাঁর স্কুলে যাওয়ার বয়স হয়নি আর মিল্ক পাউডারের কৌটার টান উপেক্ষা করার মতো বয়সও হয়নি। তাই কান্না আর থামেনা। তিনিইবা কি করবেন, কান্নার উপরে তাঁর নিজেরতো কোন নিয়ন্ত্রণ ছিলনা। অগত্যা বাবাকে আবার সাইকেলে চড়তে হলো। তবে এবার মেজ ছেলেকে নিয়ে। পার্থ স্কুলে ভর্তি হলেন আর মিল্ক পাউডারের বিরাট একটা কৌটা জয় করে হাসি মুখে বাড়ি ফিরে এলেন। তারপর থেকে স্কুলে যেতেন। পড়াশুনা তেমন কিছু নয়। শুধু ছোট ছোট বেঞ্চ আর ক্লাসে গিয়ে বসে থাকা। এটা ছিল প্রথম স্কুলের অভিজ্ঞতা।৮.স্কুল থেকে মিল্ক পাউডার জয় করে আনার পর সেটা চলে যায় মায়ের হেফাজতে। দাদারটাও, তাঁর নিজেরটাও। এই পাউডার বেশি খেলে পেট খারাপ হতো বলে তখনকার মায়েরা বাচ্চাদেরকে বেশি খেতে দিতেন না। তাই মা ওগুলোকে ছো মেরে নিয়ে রান্নাঘরের কাঠের আলমারিতে লুকিয়ে রাখলেন। ভাইবোনগুলো, পুরো দলটাই অতো ভালোমন্দ বোঝেনা, বুঝতে চায়ও না। তারা শুধু তক্কে তক্কে থাকে। মা কখন ঘুমোবেন। মা ঘুমোন আর ভাইবোনেরা নেমে পড়ে অভিযানে। কাঠের আলমারি থেকে সেই পাউডার চুরি করে রাখা হতো খাতা থেকে ছিঁড়ে নেওয়া পাতায়। সেইসাথে কিছুটা চিনিও চুরি করে নেওয়া হতো। তারপর পুরো দলটি চলে যেত জুবলী ট্যাংক পুকুর পাড়ে। সেখানে বসেই খাওয়া হতো। আর তারপরে ধরা পড়ার ভয়ে পুকুর পাড়ে চলতো ভাইবোনদের কুলকুচি। বাড়ি ফিরলে কেউ কিচ্ছুটি বুঝতে পারতো না।৯. চার ভাইবোন একসঙ্গে খেলতেন। হাডুডু, ফুটবল, ব্যাডমিন্টন, ডাংগুলি, চাকা চালানো, মার্বেল এসবের কোন কিছুই বাদ যায়নি খেলার তালিকা থেকে। মেয়েদের সাথে (এক্কা দোক্কা) খেলেছেন। শৈশবে মেয়েদের সাথে সখ্যতা তাঁর তাই কম ছিলনা। দুপুর বেলা মা ঘুমিয়ে পড়লে বাড়ি থেকে চাল ডাল তেল লবণ চুরি করে চলে যেতেন বাগানে। দুপুরের অন্যান্য বাড়ি থেকে মেয়েরা আসতো। আর বাগান থেকে আসতো শুকনো কাঠ আর পাতা। সবাই মিলে পিকনিক হতো। মেয়েরা খিঁচুড়ি রাঁধতো। কলা পাতায় খাওয়া দাওয়া হতো। দুপুর বেলা একথালা ভাত খেয়ে এসেই এই চুরি করে রান্না আর আবারও খাওয়া। ভালো লাগতো খুউব। সেই দুপুর কন্যাদের হাতের রান্নার স্বাদ মায়ের হাতের চেয়েও ভালো ছিল। তবে কি মায়ের রান্না খারাপ হতো। না, তাও নয়। ঐ রান্নাটা নয় বরং চুরি করে খাওয়াটাই সব কিছুর স্বাদ বাড়িয়ে দিত।১০. ফুরফুরি থেকে ততদিনে ভীম হয়ে গেছেন। কিন্তু উড়োউড়ি থামেনি। পাশের বাড়ির নারকেল গাছে তরতর করে উঠে যান। আর ঐ কোন মাথা থেকে ম্যাজিশিয়ানের মতো নারকেল পেড়ে আনেন। বৌদিরা দেখে, পাড়ার মেয়েরা দেখে। পাড়ার দাদাদিদিরা অনুরোধ নিয়ে আসে, মগডাল থেকে আম পেড়ে দিতে হবে। ঐ অতো ওপর আর সরু ডালে সমস্ত কালাচাঁদপাড়ায় আর কেইবা উঠতে পারে একমাত্র ভীম ছাড়া। তারতো শুধু নামই বদলেছে। চেহারাতো বদলায়নি কিছু। অনুরোধ রাখতেন। আম পেড়ে দিতেন। সেই আম কুঁচিয়ে শুকনো লঙ্কা আর লবণ দিয়ে পাড়ার দাদারা খেত, দিদিরা খেত। তাঁকেও হিস্যা দিত। কিন্তু এতো টক। বেশি খেতে পারতেন না। ফলে দাদাদিদিদের ভাগে কিছু কম পড়তো না। আর তাই অনুরোধগুলো ঘুরে ঘুরে আসতোই। ভীম নিজের জন্য যে যে গাছে উঠতো তার ভেতরে পেয়ারা, জাম, জামরুল আর সফেদা গাছ অন্যতম। এসব গাছেরতো আর কমতি ছিলনা। সমস্ত গাছেই ফলগুলো আনন্দ হয়ে ঝুলে থাকতো। ভীম সেই আনন্দ পেড়ে আনতেন। আর তাঁর লিকলিকে শরীর ছিল তাঁর প্রধান হাতিয়ার।১১. দাদু বাড়ী ছিল পাবনা শহরের সবচেয়ে বড় ঠাকুর বাড়ী। দাদু বাড়ির রথযাত্রাও হাজির হতো আনন্দের এক বিশাল চিত্র নিয়ে। রথের চারকোনায় চারটে মুর্তি। তার পাশে যে প্লাটফর্ম পার্থ সেখানে দড়িওয়ালা হাফপ্যান্ট পরে দাঁড়িয়ে থাকতেন। রথ চলতো আর রথের পেছনে পেছনে ভেঙে পড়তো পৃথিবীর সমস্ত মানুষ। অত ভীড়তো আর কোথাও কিছুতে হতোনা। শৈশবে তাই ঐ ভীড়ই ছিল পৃথিবীর সমস্ত মানুষের ভীড়। সেই ভীড়ের ভেতর থেকে মানুষ রথের উপরে পান, চিনি আর বাতাসা ছুড়ে মারতো। পার্থ মানুষের সেই ভালোবাসা আর ভক্তি রথের উপর বসে বসে কুড়োতেন। আর যাত্রা শেষ হলে একটা ছুট লাগাতেন। বাড়িতে লুকিয়ে লুকিয়ে মানুষের সেই ভক্তি আর ভালোবাসা খেয়ে ফেলতেন। সেই আনন্দ পৃথিবীর কোন দোকানে বিক্রি হয়না।১২. মা সুশ্রিকা বিশ্বাস গান গাইতে ভালবাসতেন। ভজন গাইতেন। নিজেই গাইতেন, কোন ওস্তাদ ছিলনা। বাড়িতে হারমোনিয়াম ছিল। ভাইবোনদের প্রতিদিন সেটা বাজানোর নিয়মও ছিল। কেউ মানতো না। পার্থ শুধু মাঝে মাঝে বাজাতেন মায়ের সাথে। কোন নিয়মের জন্য নয়। বাজাতে তাঁর ভালো লাগতো। এতে একটা সুবিধাও পেয়ে যান তিনি। বাড়ির সমস্ত কিছুইতো ছিল মায়ের অনুশাসনে। চালের ড্রামের পাশে ভাইবোনদের নাম লেখা আলাদা আলাদা বেত ছিল। সন্ধ্যায় পড়তে বসলে বা কেউ কথা না শুনলে সেই বেত চালের ড্রামের পাশ থেকে বেরিয়ে আসতো। তারপর নাম অনুযায়ী যে যার জায়গা খুঁজে নিত। মাঝে মাঝে হারমোনিয়াম ধরে ধরে সা রে গা মা করার কারণে পার্থ বেঁচে যেতেন।১৩. জুবলী স্কুলের টিফিন টাইমটা ছিল অন্যরকম। সে সময়টায় পূর্ব পাকিস্তানের শাসনকর্তা ছিলেন আইয়ুব খাঁন। তাঁর মনে হয়েছিল এদেশের দুবলো-পাতলা ছেলেদের স্কুল থেকে কিছু খাওয়া টাওয়া দেয়া দরকার। তাঁরই নির্দেশে সে সময়ে বিধান হলো দুপুরে স্কুলে ছেলেদেরকে রান্নাকরা খিঁচুড়ি দেওয়া হবে। মোটামোটা বুটের ডাল আর মোটা চালের সেই খিচুড়ি খাওয়ার জন্য লম্বা লাইন। কাঠফাটা দুপুরের রোদে স্কুল মাঠের লম্বা লাইনটা চলে গেছে একটা মস্তবড় আমগাছ তলায়। সেখানে দুইজন বাবুর্চি ডেক থেকে একটা থালার সাহায্যে খিঁচুড়ি তুলে লাইনে দাঁড়ানো ছাত্রদেরকে দিচ্ছে। দু’চারজন শিক্ষকও থাকতেন গাছের ছায়াটায়। ড্রিল স্যার বাঁশি আর বেত নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। কিছুক্ষণ পরপর বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে চিত্কার করে উঠতেন, ‘এই লাইন সোজা কর্, এই ঠিকমতো দাঁড়া, এই পেছন থেকে লাইন ঠেলছে কারা।’ আর ছাত্রদের কেউ কেউ সেই খিঁচুড়ি খাওয়ার জন্য বাসা থেকে থালা আনতো। এক হাতে তাদের বই খাতা ধরা থাকতো আর অন্য হাতে থালা। ভীমের বাড়ি থেকে বলে দেওয়া হয়েছিল, ওখানকার খিঁচুড়ি না খেয়ে যেন বাড়িতে এসে খাওয়া হয়। ওখানে ভাতের ভেতর কি পোকা মাকড় না কি খেয়ে আসবে। ভীম তাই রোজ কাগজ পেঁচিয়ে ঠোঙা বানিয়ে চলে যেত লাইনের একদম সামনে। আর খিঁচুড়ি নিয়েই এবাড়ির উঠোন আর ও বাড়ির বাগানের ভেতর দিয়ে চলে আসতো নিজেদের বাড়িতে। স্কুলের দু’তিন ঘর দূরেই বাড়ি। খিঁচুড়ি নষ্ট হতোনা। গরমই থাকতো। সেই খিচুড়ি খাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতো ছোট ভাই রূপকুমার। দুপুরের ঘুম নষ্ট করে দাঁড়িয়ে থাকতো জানালার পাশে। মোটা রড দিয়ে বানানো জানালার শিক। সেখান থেকেই মুখ সে বাড়িয়ে দিল। আর ওমনি তার ভীম দাদা হাত বাড়িয়ে দিল। সেই হাতে খিঁচুড়ির প্রায় গলে যাওয়া ঠোঙা। রূপকুমার খাচ্ছে। সেই গরম খিঁচুড়ি রূপকুমারের শরীরে লেগে শুরু হলো জ্বলাপোড়া। রূপকুমার লাফাচ্ছে, ‘দাদা জ্বলে গেল।’ দাদা বলছেন, ‘যা জল দিয়ে ধুয়ে আয়।’ রূপকুমার গেল জলের কাছে আর তার জানালা ধরে দাদা দাঁড়িয়ে আছেন রূপকুমারের ফেরার অপেক্ষায়। এই রকমই চলতো প্রতিদিন। প্রতিটি দুপুর বেলায়।১৪. দুই ভাই এর ভেতরে এই বোঝাপড়া হয়ে গেছে অনেকদিন। এক ভাই সেই দুপুরের রোদ, লম্বা লাইন, আর এর বাড়ির বাগান ওর বাড়ির উঠোন ঠেঙিয়ে একটা জানালার কাছে এসে দাঁড়াবে। আর সেখানে একজন আগে থেকেই দুপুরের ঘুম কামাই করে বসে আছে দাদার অপেক্ষায়। দুই ভাইয়ের সখ্যতা দেখে দুপুরের চড়াই আর শালিখেরা উঠোন আর চৌকাঠ থেকে উড়ে এসে গাছে গাছে বসে যায়। বাড়ির কেউ জানেনা। এমন ছোটখাট দু একটা অপরাধের কথা বাড়ির বড়দের না জানলেও চলে। এরকম ভাবেই প্রতিটি দুপুর আসে দুই ভাইয়ের জীবনে। আরো আসতো। কিন্তু একদিন দেখে ফেললেন পাশের বাড়ির জ্যোত্স্না পিসি। তিনি হিমাংশু কুমার বিশ্বাস এর চারটি ছেলেমেয়েকে মানুষ করেছেন মাতৃ স্নেহে। রূপকুমার অনেকদিন পর্যন্ত জানতো উনিই, মায়ের বয়সী ঐ জ্যোত্স্না পিসিই ওর মা। এই পিসিই দুজনের কীর্তিটি সবার আগে দেখে ফেললেন। আর দেখেই তাঁর কি চিত্কার। ‘এই ভীম তুই কি সব বিষ খাওয়াচ্ছিস’। ভীম দিল দৌড়। জানালার পাশে আর কেউই নেই। না এপাশে ভীম অথবা অন্যপাশের ছোটভাই রূপকুমার। অথচ পিসির চিত্কার আর থামেনা। চিলের ডানায় ভর করে নেমে আসা সেই দুপুর, বড়দের বেলায়, বড়দের জীবনে বোধহয় আসেনা কোনদিন।১৫. নিচের তলায় তিন ভাই একসঙ্গে ঘুমোতেন পার্থরা। একরাত্রে ঘুম ভেঙে গেল জলের পিপাসায়। জল খেতে উঠলেন তিনি। বাবার ঘরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় চোখে পড়ে গেল একটা সার্ট, বাবার, ঝুলে আছে আলনায়। সার্টের সাথে একটা পকেটও লাগানো আছে আর সেখান থেকেই খুচরো পয়সাগুলো দুর্বার আকর্ষণে তাঁকে টানতে লাগলো। সেই টান উপেক্ষা করা বড় কঠিন। বাবার পকেট থেকে পার্থর হাতের ভেতর আসতেই পরদিন তারা নাড়ু আর বাদাম হয়ে ফুটে উঠলো। বাড়িতে তো নাড়ু সব সময়ই হচ্ছে, কিন্তু দোকানের মতো নাড়ু তো আর কোন বাড়িতে কোনদিন বানানো যায়নি। তাই বাইরের খাবার কিনে খাওয়ার টানটা ফুটতে লাগলো রাত্রির পিপাসা হয়ে। প্রতি রাতেই পিপাসায় ঘুম ভেঙে যায় আর বাদামওয়ালার রেগুলার কাস্টমারের খাতায় নাম ওঠে ভীমের। শুধু বড় ভাইয়ের হিসেব মেলেনা কিছুতেই। ভীম এতো পয়সা পায় কোথা থেকে। যখনই তার সাথে দেখা হচ্ছে তখনই কিছু না কিছু তার মুখে। বাবার কাছে নালিশ গেল। বাবা মুচকি হেসে বললেন, ‘বাদ দে’। বাবা আসলে অনেকদিন ধরেই জানতেন। কিন্তু বড় ভাইটি আর বাদ দিতে পারেনা। সারাক্ষণ ভীমের পেছনে তার ছোক ছোক। অবশেষে একটা রফা হলো। যা কেনা হবে তার আধাআধি ভাগ হবে। এই আপস রফায় দুই ভাইই সন্তষ্ট।১৬.বাবা হিমাংশু কুমার বিশ্বাস ছিলেন প্রেস ফটোগ্রাফার ও প্রচন্ড সংকৃতিমনা। পাবনা শহরের যে কোন সাংকৃতিক কর্মকান্ডের সাথে সে সময় জড়িত ছিলেন। পাবনা শহরেই তাঁর স্টুডিও ছিল। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বেশ কয়েকটি বাংলা ও ইংরেজি দৈনিকে তিনি ফটোগ্রাফি ও সাংবাদিকতার কাজ করতেন। আগফা, গেভার্ট, ইলফোর্ট ইত্যাদি ফ্লিম কোম্পানির সাথেও তাঁর ভালো যোগাযোগ ছিল। এখানে উল্লেখ্য বিশ্বখ্যাত আগফা-গেভার্ট কোম্পানি ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে একমাত্র তাঁকে কালার ফটোগ্রাফিতে ট্রেনিং দেবার জন্য বেলজিয়াম ও জার্মানিতে নিয়ে যায়। তাঁর একটা সাইকেলও ছিল। সেই সাইকেল নিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়তেন দূর দূরান্তে ছবি তোলার কাজে। ভীম মাঝে মাঝে বাবার সফর সঙ্গী হতেন। বাবার সাথে সাইকেলে চড়ে দূরে যাওয়ার আনন্দতো ছিলই। বাড়তি পাওনা হিসেবে পাওয়া যেত বাইরের খাবার। কোন বাড়িতে ছবি তুলতে গেলে তারাতো খাবার দিতই আর দোকানের খাবারের স্বাদও খুব খারাপ ছিলনা। আর বাবার সাথে বেরুলে সেই বেলা আর পড়তে বসতে হতোনা। ফলে ফটোগ্রফার বাবার সফর সঙ্গী হতে বেশ আগ্রহই বোধ করতেন তিনি।১৭.পাবনাতে বনমালী ইন্সটিটিউট নামে একটা থিয়েটার ছিল, এখনো অবশ্য সেটি আছে। বাবা হিমাংশু কুমার বিশ্বাস ছিলেন সেখানকার সদস্য। ফলে ওরা যে সমস্ত আয়োজন করতো তার সবগুলোই পরিবারের সবাই মিলে দেখতে যেতেন ভীম। ওরা একদিন করল ”আলী বাবা চল্লিশ চোর”। আলী বাবা চিচিং ফাঁক বলে আর শব্দ করে দরজা খুলে যায়। সেই সন্ধ্যায় ভাইবোনেরা সবাই মিলে বাড়িতে ফিরে সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে চিচিং ফাঁক বলে আর মুখ দিয়ে দরজা খোলার আওয়াজ করে। একদল ভাইবোনের সম্মিলিত চিচিং ফাঁক উচ্চারণে অদৃশ্য দরজা খুলে যায়। এরপর সাহস যখন আর একটু বাড়লো তখন মায়ের শাড়ি চুরি করে মশারির স্ট্যান্ডে বেঁধে গোল করে ঘিরে দিলেন। সব ভাইবোন মিলেই করলেন। এটাই ছিল ভীম-এর জীবনের প্রথম স্টেজ। মায়ের শাড়ীর গন্ধমাখা স্টেজ। এভাবেই ভাইবোনোরা মিলে থিয়েটার থিয়েটার খেলতেন। কোনকোন দিন সারাদিন ধরে এই খেলা চলতো।১৮.ভীম চলেছে হামাগুড়ি দিয়ে। সে হলো রাজচক্কোতির ঘোড়া। আর তার পিঠের ওপর স্বয়ং রাজা মহাশয়। জরীর পোষাক নেই। পেছনে লোক লস্কর নেই। একদম উলঙ্গ রাজা। ‘এই সর, আমার ঘোড়া ডাইনে যাবে’। গাড়োয়ানের মতো রাজা নিজেই হাক ছাড়েন। এই রাজা হচ্ছেন ভীমের ছোট ভাই, রূপকুমার। ছবিটি তুলেছিলেন ভীম-এর বাবার স্টুডিওর কোন কর্মচারী। ভাই দুটির কিন্তু মডেল হওয়ার কোন ইচ্ছাই ছিলনা। দুই পয়সার মডেলের চেয়ে উলঙ্গ রাজা অথবা রাজার ঘোড়া হওয়াও অনেক সুখের। সেই সুখের আলো জানালা দিয়ে বেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল অনেকখানি। তারই কিছুটা অংশ ক্যামেরা বন্দী করে নিয়ে যান বাবার সেই কর্মচারী। আর সেটাই হয়ে যায় বাবার স্টুডিওর ব্যবসায়িক সিম্বল। পাবনার দুটো সিনেমা হলে বিরতির সময় সবাই যখন আলো জ্বেলে সিটের ছারপোকাগুলোকে খুঁজে বেড়াচ্ছে অথবা কেউ কেউ নায়ক নায়িকার বেদনায় ভারাক্রান্ত। আর কিছু মানুষ গিয়েছে বিড়ি ফুঁকতে। বিড়ি শেষ না করে তাঁদের আসার কোন রকম ইচ্ছেই নেই। ঠিক সেই সময়ে হলগুলোতে বিজ্ঞাপনী স্লাইড চলতো। সেই স্লাইডগুলোর ভেতর এই উলঙ্গ রাজা আর তাঁর হাফপ্যান্ট পরা লিকলিকে ঘোড়ার ছবিটিও ঠাঁই করে নেয়। ছবিটির নিচেই একটু ফাঁক দিয়ে লেখা ছিল কথাটি। ”এই মধুর স্মৃতি ধরে রাখুন”। রূপছায়া স্টুডিও, পাবনা।১৯.সুধাংশু কুমার বিশ্বাস ছিলেন ভীম-এর একমাত্র কাকা। তাঁর ডাক নাম নব। নব কাকা মানুষ হয়েছেন পার্থ প্রতিম এর বাবা হিমাংশু কুমার বিশ্বাস-এর ছত্রছায়ায়। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে তিনি কলকাতায় চলে যান চাকুরী করতে। সেখানকার জিওলজিকাল সার্ভে অব ইন্ডিয়াতে তিনি চাকুরী করতেন। সেখান থেকে যখন ফিরলেন তখন তাঁর মুখে শুধু কলকাতার গল্প। কলকাতার অমুক ভালো, তমুক ভালো। বাবা বললেন, ‘ছেলে দুটোকে তবে মানুষ করার দায়িত্ব নে নব। ওরা কলকাতায় পড়াশোনা করলে দেশে এসে অনেক ভালো কিছু করতে পারবে।’ তখন, সেই পাকিস্তান আমলে এফ ক্যাটাগরি ভিসায় ইন্ডিয়াতে পড়াশোনা করা যেত। কাকা দায়িত্ব নিলেন। পার্থ তখন সবে প্রাইমারী পড়াশুনা শেষ করেছেন। এক পবিত্র দিন দেখে পার্থ আর বড়দা’ দুজনে মিলে চলে এলেন কলকাতায়। সেই শহর থেকে আরও বাইশ কিলোমিটার দূরের এক সময়ের ফরাসী কলোনী। নাম চন্দন নগর। সেখানেই শুরু হলো দুই ভাইয়ের নতুন জীবন। পার্থ এখানকার ড. শীতল প্রসাদ ঘোষ আদর্শ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ক্লাস সিক্সে পাবনার কালাচাঁদপাড়ার সেই পরম প্রিয় শহরখানি ছেড়ে, মা আর বাবাকে ছেড়ে শুরু হল পার্থ প্রতিম মজুমদারের প্রথম প্রবাস জীবন। তবে তখন পর্যন্ত কিন্তু তিনি পার্থ প্রতিম মজুমদার নন। প্রেমাংশু কুমার বিশ্বাস। আর ডাক নাম সেই আদি ও অকৃত্রিম “ভীম”।২০.সেই যে প্রাথমিক শিক্ষা শেষের পর বড় ভাইয়েরা তাকে কাকা শুধাংশু কুমার বিশ্বাসের তত্ত্বাবধানে কলকাতা শহর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে চন্দননগরে পাঠিয়ে দেন, এখানেই তাঁর শিল্পজীবনের বাঁকটি বদল হয়। সেখানে ড. শীতল প্রসাদ ঘোষ আদর্শ বিদ্যালয়ে পড়ার সময় পরিচয় হয় মূকাভিনয় বা মাইমের আর্টিষ্ট যোগেশ দত্তের সাথে।তার কাছেই মাইম শেখা শুরু। পার্থ প্রতিম মজুমদার ১৯৬৬ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত কলকাতার যোগেশ দত্ত মাইম একাডেমীতে মাইমের উপর শিক্ষাগ্রহণ করেন৷ ১৯৭২সালে ভারতের চন্দননগর থেকে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন৷ ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত ঢাকা মিউজিক কলেজ থেকে স্নাতক হন৷ ১৯৮১ ও ১৯৮২ সালে মডার্ণ কর্পোরাল মাইমের উপর “ইকোল দ্য মাইম” নামে এতিয়েন দু্য ক্রু কাছে শিক্ষাগ্রহণ করেন৷ এরপর ১৯৮২ সাল থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত মারসেল মার্সোর কাছে “ইকোল ইন্টারন্যাশনালি দ্য মাইমোড্রামা দ্য প্যারিস” এ মাইমের উপর উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণ করেন৷২১.পার্থ প্রতিম মজুমদার পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে মূকাভিনয় নিয়ে গৌরবমন্ডিত করেছেন বাংলাদেশের পতাকাকে। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) দুটি অনুষ্ঠানে প্রথমবারের মতো মূকাভিনয় প্রদর্শন করেন তিনি৷ পরবর্তীতে ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায় ৪৮ বার মাইম প্রদর্শন করেন৷ এছাড়া ঢাকার ড্রামাটিক আর্টস স্কুলে মাইমের শিক্ষকতার পাশাপাশি বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন থিয়েটার গ্রুপের ছেলেমেয়েদের নিয়ে মাইমের উপর কর্মশালা পরিচালনা করেন৷ ১৯৮২ থেকে ১৯৮৫ সালগুলোতে তিনি প্যারিসের বিভিন্ন থিয়েটারে মোট ২৬টি শো করেন। এছাড়া লন্ডনে ২টি, গ্রীসে ২টি এবং স্পেনে মাইমের ২টি শো করেন। ১৯৮৪সালের জুলাই মাসে মারসেল মার্সোর সাথে আমেরিকা যান এবং সেখানে মার্সোর নির্দেশনায় ” ইকোল ইন্টারন্যাশনাল ডি মাইমোড্রামা ডি প্যারিস-মারসেল মার্সো” নামে একটি শো করেন৷ ১৯৮৫ সালের জুলাই মাসে পার্থ প্রতিম মজুমদার মারসেল মার্সোর কোম্পানি এবং “থিয়েটার দ্য লা স্পেহয়ার” এর সাথে যৌথ উদ্যোগে সারা ইতালিতে মাসব্যাপী “লে কারগো দ্য ক্রেপুসকুল” এবং ” আবিম” নামে দুটি মাইমোড্রামা প্রদর্শন করেন৷ এবছরগুলোতেই প্যারিসে দুটি ছোট বিষয়কে নিয়ে ক্যামেরার সামনে হাজির হন৷ এবং প্যরিসেই তাঁর কাজের উপর একটি বড় ভিডিও ধারণ করা হয়৷ এসময় ফ্রান্সের টেলিভিশনে তাঁর একটি কাজ প্রদর্শন করা হয়৷ এছাড়া লন্ডনে একটি ছোট ভিডিও ধারণসহ ‘বিবিসিতে’ তাঁর একটি কাজ প্রদর্শন করা হয়। ১৯৮৬ সালে মারসেল মার্সোর তত্ত্বাবধানে পার্থপ্রতিম মজুমদার মাইমের তত্ত্ব্ব বিষয়ক গবেষণা কাজের জন্য চুক্তিবদ্ধ হন৷ এছাড়া তিনি বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মাইম প্রদর্শন করেন। তিনি ‘নিঃশব্দ কবিতার কবি’ বলেও পরিচিত। বাংলাদেশে এইডসের বিরুদ্ধে বেশ কিছু সচেতনতামূলক আয়োজেনও অংশ নিয়েছেন তিনি।২২.পার্থ প্রতিম মজুমদার ছোটবেলা থেকেই সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে মানুষ হয়েছেন। বড় হয়ে হয়েছেন মূকাভিনয় বা মাইমের এক অনন্য সাধারণ শিল্পী। ৩০ বছরের বেশী সময়ে ফ্রান্স প্রবাসী এই মাইম শিল্পী মাইমের বিচারে সম্মানের শিখরে অবস্থান করছেন। যেখানে যান তিনি উজ্জ্বল করে আসেন বাংলাদেশের মুখ আর লাল-সবুজ পতাকা। বছরের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশে মাইম প্রদর্শন করে প্রচুর সুনাম অর্জন করেন পাবনার পদ্মাপাড়ের এই ছেলে। মালয়েশিয়ার সাংবাদিকদের কাছ থেকে ‘মাস্টার অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ উপাধি লাভ করা ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকে বহু আন্তর্জাতিক সম্মান ও পুরস্কার লাভ করেছেন। আমৃত্যু তিনি মাইম ও পৃথিবীর বুকে তাঁর ছোট্ট দেশটিকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসেন। সাধারণ জীবন যাপন আর শিল্পী জীবনের একটাই মাত্র স্বপ্ন তাঁর। বাংলাদেশের বুকে একটি পূর্ণাঙ্গ মাইম ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করার। দৈনিক সমকালের সাথে এক আলাপনে ঢাকায় একটি মাইম একাডেমী স্থাপন করার অগ্রগতি প্রসঙ্গে যেমনটি তিনি বলেছিলেন, ‘এখনও বলতে পারেন দৌড়ঝাঁপ পর্বে রয়েছি। কখনও মনে হয় যে অনেক এগিয়েছি। আবার কখনও হতাশা গ্রাস করে ফেলে। বিচারপতি কামাল উদ্দিন হোসেনের পুত্র ইশতিয়াক হোসেন আমার উদ্যোগের কথা জেনে নিজের বাড়ির একটি ফ্লোর এ কাজে ছেড়ে দিয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমানের কাছে যখনই এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করি, তখন মনে হয় কোনো বাধাই অসাধ্য নয়। আশা করব যে বিত্তবান ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান থেকে এ উদ্যোগে সহায়তা মিলবে। মূকাভিনয় শুধু বিনোদনমাধ্যম নয়, আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও এ অনন্য শিল্পের ব্যবহার রয়েছে। আপনি একটি অফিসে কাজ করছেনথ কীভাবে ঘরে প্রবেশ করবেন সবার সামনে, অভ্যাগতকে কীভাবে স্বাগত জানাতে হয়, অতিথি আপ্যায়নের পরিবেশনের সুন্দর-শোভন রীতি কী, এসবের জন্য রয়েছে পৃথক পৃথক দেহভঙ্গি। মূকাভিনয় শিক্ষার স্কুল আপনাকে এ ধরনের আরও নানা বিষয়ে শেখাতে পারে। মূকাভিনয় হচ্ছে আদিম শিল্পথ মানুষ যখন কথা বলতে পারত না, তখন অঙ্গভঙ্গি ছিল প্রকাশের মাধ্যম। নাটক, গান, নাচ, যাত্রা সবকিছুতেই প্রকাশের দেহভঙ্গি চাই। মডেলিংয়ের জন্যও তা অপরিহার্য। অনেক শিশু এখন খেলার মাঠ পায় না। তারা নিজেদের শরীরটা সুন্দর করতে পারে। যেখানে পড়বে কিংবা পরবর্তী জীবনে কাজ করবে সেখানে নিজেকে সুন্দর করে উপস্থাপন করবে। তাদের জন্য আসুন, সবাই মিলে কিছু করি। বয়স্কদের জন্যও এর প্রয়োজন রয়েছে। আমার জীবনে মোটামুটি সচ্ছলতা রয়েছে। নিজের বা পরিবারের জন্য নয়, দেশের জন্যই এমন একটি প্রতিষ্ঠান আমি গড়ে তুলতে চাই। শুধু মূকাভিনয় নয়, সব ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেই পৃষ্ঠপোষকতার দরকার রয়েছে। বাঙালি জাতি সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ এবং এ জন্য সুনামও রয়েছে। তবে সময়ের দাবি তো এখন অনেক। বিশ্বায়নের এ যুগে সর্বত্র নিজেদের তুলে ধরার জন্য অর্থনীতি যেমন শক্তিশালী করতে পারে, তেমনি সংস্কৃতিও গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র।’২৩.‘আমি স্বপ্নের জাল বুনি’ শিরোনামে পার্থ প্রতিম মজুমদারের স্মৃতিচারণমূলক লেখাটি পরিসরে বড় হলেও পাঠ করা প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় উপস্থাপন করা হলো।-২৩.১ ‘ষাট যখন দরজায় ধাক্কা দেওয়ার জন্য উন্মুখ তখন ‘অ্যাকশন’ বলার সঙ্গে সঙ্গে যেমন একজন অভিনেতা সুন্দর করে অ্যাঙ্গেল দিয়ে তাকায়, আমি আজকাল রাস্তায় যেতে যেতে নিজেই নিজেকে ‘অ্যাকশন’ বলি আর ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাই, গুনগুন করি ‘মুছে যাওয়া দিনগুলি আমায় যে পিছু ডাকে…’।২৩.২সোনার চামচ মুখে নিয়ে আমার জন্ম হয়নি। ৪ মাঘের হাড়কাঁপানো শীত আর প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে মধ্যদুপুরে পাবনার বাড়ির উঠানে (আঁতুড়ঘর) আমার জন্ম। সংখ্যালঘু হিন্দুরা দেশ বিভাগের কারণে দেশত্যাগে ব্যস্ত হলেও আমার বাবাকে তাঁর চার পুত্র ও এক কন্যাসন্তান নিয়ে দেশত্যাগের কথা বলতে বা আলোচনা করতে শুনিনি।২৩.৩বাবাকে তাঁর পেশাগত কারণে পাবনা জেলার বিভিন্ন শহর-গ্রামে যেতে হতো। মাঝেমধ্যে নাছোড়বান্দা আমি সঙ্গ নিতাম। আবিষ্কার করলাম, বিশাল এক ভুবন। বাড়ির বাইরেও অন্য এক পৃথিবী। স্বচক্ষে অবলোকন করলাম বিভিন্ন ধর্মের সামাজিক লোকাচার, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আরও কত কী! পড়ালেখার চেয়েও তখন আমার অনেক বেশি আনন্দ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ায়। খুব রোগা ছিলাম বলে ডাকনাম রাখা হয়েছি ‘ফড়িং’। সুতরাং একটা ফড়িং এ-পাড়া ও-পাড়া করে বেড়ালে কেউ কি তার খবর রাখতে পারে। দাদুবাড়ি কালাচাঁদ বাড়িতে নাটমন্দির ছিল, যেখানে বছরে দুবার রাতব্যাপী ১০ দিন ধরে যাত্রা, নাটক, নাচ, গান আরও কত কিছু যে হতো, তা বলে শেষ করা যাবে না। চৈত্র মাসে পাবনার চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে ‘হাজরা বা গাজন’ নামে মাসজুড়ে একটা উৎসব হয়, যা দেশের অন্য কোনো শহরে হয় না। সে এক বিশাল আয়োজন। তাতে আমার উপস্থিতি কারও চোখেও পড়ত না। মহরমের তাজিয়া-লাঠিখেলায়, কবরস্থান-শ্মশান কোথায় নেই আমি। আমি তো ফড়িং কারও ‘সু’ বা ‘কু’ কোনো দৃষ্টিতেই আমি পড়ি না। আবিষ্কার করলাম প্রতিটি উৎসবের একটা ঐতিহ্য রূপ-গন্ধ-ছন্দ আছে। খুঁজে পেলাম তার ভেতর থেকে দেহভঙ্গি, অভিব্যক্তি আর নৈঃশব্দের সংগীত। আকৃষ্ট হলাম কিন্তু জানতাম না এগুলোকে কী বলে? কথা না বলেও আমরা অনেক কথা বলি, ভাষা ব্যবহার না করেও আমরা দেহ দিয়ে এমন অঙ্গভঙ্গি করি, যা ভাষা উচ্চারণের চেয়েও অনেক বেশি প্রকট ও শক্তিশালী। যাকে নাম দেওয়া হয়েছে ‘বডি ল্যাংগুয়েজ’ বা ‘দৈহিক ভাষা’। আরও পরে জেনে ছিলাম এগুলোকে সম্মিলিত করেই একটা শিল্পের জন্ম হয়েছে যার নাম ‘মূকাভিনয়’ বা ইংরেজিতে ‘মাহিম’ আর ফরাসিতে ‘মিম’। প্রতিটি মানুষের রয়েছে আলাদা ব্যক্তিত্ব, ভিন্ন অভিব্যক্তি, রহস্যেঘেরা তার অঙ্গভঙ্গি। জীবনের এত পেশা-নেশা থাকতে এই রহস্যেঘেরা শিল্পকেই আলিঙ্গন করে জীবনের ৪০টি বছর কাটিয়ে দিলাম।২৩.৪মূকাভিনয়ের শৈল্পিক রূপ চাক্ষুষ করার সুযোগ হয় ষাটের দশকের শেষ দিকে কলকাতায় যোগেশ দত্তের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর। পারিবারিক পরিচয়ের গণ্ডিতে তাঁর কাছেই আমার প্রথম হাতেখড়ি।সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশে ঢাকায় যখন আমি স্থিত তখন আমি ‘ঢাকা সংগীত মহাবিদ্যালয়ের’ ছাত্র। হাঁটি হাঁটি পা পা করে মূকাভিনয়ের অনুশীলন একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রবাসে গঠন হওয়া সংগঠন ‘গণসাংস্কৃতিক পরিষদ’ নামের ড্যান্স ড্রামা দলে প্রখ্যাত নাচের শিল্পী ও শিক্ষক আমানুল হকের কাছে নৃত্যে প্রশিক্ষণ লাভ করি। দেশব্যাপী এই দলের প্রতিটি প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করি। মঞ্চ ও টেলিভিশনে একক মূকাভিনয় প্রদর্শনের সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ দর্শকদের অভূতপূর্ব সাড়া পাই এবং সেই ভালোবাসাই আমাকে আজকের এই স্থানে পৌঁছে দিয়েছে।২৩.৫ফরাসি রাষ্ট্রদূত লুইমরোর চোখে পড়ে যাওয়াতে ও ফরাসি দূতাবাসের আন্তরিক চেষ্টায় এশিয়ার প্রথম মাইমের স্কলারশিপ জুটে যায় ফরাসি দেশের। সেই আট মাসের জন্য আসা অচিন দেশে আমি কাটিয়ে দিলাম তিনটি দশক। লালকার্পেট ও ফুলের মালা দিয়ে আমাকে কেউ বরণ করেনি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আসা শিল্পীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে আর অমানুষিক পরিশ্রম করে আমাকে টিকে থাকতে হয়েছে। আজও তার শেষ হয়নি। আমি মাঝেমধ্যে আমাকে প্রশ্ন করি আমি কি সত্যি অনেক প্রতিভাবান ব্যক্তি? অনেক বড় শিল্পী? না আমি দুটোর একটাও না। যে প্রতিকূল পরিবেশ থেকে আজ আমি মাইম শিল্পকে যেখানে পৌঁছাতে পেরেছি, নিজের স্বীকৃতি আদায় করে নিতে পেরেছি তা শুধু সম্ভব হয়েছে আমার লক্ষ্যে স্থির থাকা আর দাঁতে দাঁত চেপে লেগে থাকার সুবাদে। প্রতিদিন ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা ক্লাস করার পর মৃতপ্রায় অবস্থায় যখন হোস্টেলে ফিরতাম ঘরের কার্পেটের মাঝে চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়তাম আর অনুভব করার চেষ্টা করতাম ‘মহিলা সমিতি’ মঞ্চে বা ‘টিএসসি’ মঞ্চে অথবা ‘শিল্পকলার’ মঞ্চে আমার শো শেষে হলভর্তি দর্শকদের আন্তরিক উচ্ছ্বাস ও হাততালি। আমার অক্সিজেন নেওয়া শেষ, তৈরি হতাম আবার পরের দিনের জন্য। প্যারিসের প্রথম চার বছর বলতে গেলে সূর্যের মুখই আমি দেখিনি। একটি থিয়েটার নাম তার ‘থিয়েটারের নবজন্ম’ এর মাটির নিচে ছিল ‘মারসেল মার্সো’র আন্তর্জাতিক মাইম স্কুল ‘ইকোল ইন্টারন্যাশনাল মাইমোড্রামা মারসেল মার্সো, প্যারিস’ সেই স্কুলে সকাল সাড়ে আটটার মধ্যে ঢুকে যেতাম, বেরোতাম রাত ১০টায় বা কখনো রাত ১২টায়। আমি প্রতিভাধর হয়তো ছিলাম না কিন্তু অল্প প্রতিভাকে প্রতিদিন ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা ঘষেছি। শনি-রবি যেখানে সবার ছুটি সেই উইকেন্ডেও বিশেষ ব্যবস্থায় চাবি নিয়ে অনুশীলন করতাম। কলকাতায় যোগেশ দত্তর কাছে অনুশীলন করার সময় পকেটে তেমন পয়সা ছিল না বলে কলকাতার ফুটপাতের ঝুপড়ি দোকানে এটা স্লাইস পাউরুটি আর এক প্লেট ঘুঘনি বা আলুর দম দিয়ে দুপুরের খাওয়া শেষ করেছি। তেমন প্যারিসেও ক্লাসের শেষে প্রায় বন্ধ হয় সান্ডউইচের দোকান থেকে সারা দিন ধরে পড়ে থাকা অবিক্রীত সান্ডউইচ অতিকষ্টে চিবোতে চিবোতে মেট্রো বন্ধ হয়ে যাওয়াতে চার-পাঁচ কিলোমিটার হেঁটে হোস্টেলে ফিরেছি।২৩.৬মারসেল মার্সো ছাড়াও স্কুলটির সঙ্গে জড়িত ছিলেন পৃথিবীর বিখ্যাত সব শিক্ষক, যাঁদের কাছ থেকে আমরা আপ্রাণ নেওয়ার চেষ্টা করেছি। মাইম, প্যান্টোমাইম, করপোরাল মাইম, মাইমোড্রাম ছাড়াও প্রতি সপ্তাহে দুবারে চার ঘণ্টা করে শিখতে হয়েছে থিয়েটার একরোবেটিকস, ব্যালে, মডার্ন ড্যান্স, থিয়েট্রিক্যাল একরোবেটিকস, লাঠি, সোর্ড খেলা ইত্যাদি। যতভাবে দেহকে নরম করা যায় এবং একই সঙ্গে শক্তি অর্জন করা যায় তার সব শিক্ষাই আমাদের দেওয়া হয়েছে। মাঝেমধ্যে পৃথিবীর অন্যান্য দেশ থেকেও শিক্ষক-শিক্ষিকা এসেছেন আমাদের অন্য ধরনের কিছু শেখাতে। পৃথিবীর বিখ্যাত শো যখন প্যারিসে চলছে আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছে তা বিনা মূল্যে দেখার জন্য, কারণ আমরা প্রবাদপ্রতিম মার্সোর ছাত্র। কথার ছলে আমাকে মার্সো একবার বলেছিলেন যে ষাটের দশকের প্রথম দিকে তিনি যখন ভারতবর্ষে শো করতে গিয়েছিলেন পণ্ডিত নেহরু তখন ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী। নেহরু দ্বিধা করছিলেন ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন কি না। অনুষ্ঠান শেষে মঞ্চে উঠে ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী জড়িয়ে ধরে নিজের পরিহিত কোটে লাগানো গোলাপ ফুল খুলে মারসেল মার্সোকে উপহার দিয়ে পরদিন বাড়িতে ডিনারে ডেকেছিলেন।২৩.৭এই মানুষটি আমাকে তাঁর ছাত্র থেকে দলের সদস্য ও একই সঙ্গে ‘পুত্রসম’ অভিহিত করেছেন। মনে পড়ে আমার প্রথম আমেরিকা ভ্রমণ মারসেল মার্সোর সঙ্গে ১৯৮৪ সালে। আমাদের দলের থাকার জায়গা হয়েছিল শিকাগো ইউনিভার্সিটির ইন্টারন্যাশনাল ক্যাম্পাসে। প্রতি রাতে শো শেষে হোস্টেলে ফিরে তার লবিতে চলত মার্সোকে ঘিরে আমাদের রাতব্যাপী আড্ডা। তিনি তাঁর সারা জীবনের ঘটে যাওয়া সুখ-দুঃখের গল্প যেমন বলতেন তেমন অঙ্গভঙ্গি করে তাঁর ভাবগুরু চার্লি চ্যাপলিনের স্ত্রী কীভাবে প্যারিসের ‘অরলি’ বিমানবন্দরে চ্যাপলিনের মুখোমুখি হয়ে যখন কথা শুরু করেছেন ‘ও তুমিই সেই সাদামুখের বিখ্যাত ব্যক্তি।’ চার্লি চ্যাপলিন তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছেন, উত্তর দেওয়ার আগেই চার্লি চ্যাপলিনকে কীভাবে হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন তা আমাদের দেখাতেন। আমরা হেসে গড়িয়ে পড়তাম। আসলে মার্সো ছিলেন আমার মেনটর বা নির্দেশক এবং একই সঙ্গে গুরু ও পিতা। এই বিশাল শিল্পীর কাছে তাঁর অন্তরের কাছে যে আমি কীভাবে পৌঁছে ছিলাম তা ভাবতেও আজ অবাক লাগে। নব্বইয়ের দশকে ইনস্টিটিউট দ্য ফ্রঁস একাডেমি ফ্রঁসেজ তাঁকে যখন একাডেমিয়ানের স্বীকৃতি দেয় একাডেমি কুপলের ওই বিশেষ অনুষ্ঠানে তাঁর ছাত্রদের মধ্যে থেকে তিনি শুধু আমাকে তাঁকে সহযোগিতা করার জন্য নির্বাচন করেছিলেন। এ এক বিশাল সম্মান।২৩.৮মারসেল মার্সো বেঁচে থাকা অবস্থায় আমি ভাবতেও পারিনি দেশে স্থায়ীভাবে ফিরে যাওয়ার কথা। আর তিনিও সেটা চাননি। ২০০৮ সালে ‘ঢাকার লাভ ফাউন্ডেশন’ আমাকে আমন্ত্রণ জানায় তাদের কনভেনশনে শো করার জন্য। ঢাকার বিশাল মঞ্চে তাদের আমন্ত্রিত বিদেশি অতিথিদের সম্মানে আমার একক ও আমার নির্দেশিত মাইমোড্রামা ‘জীবনের জন্য শ্বাস’ পরিবেশিত হয়। হলভর্তি সারা দেশের বিখ্যাত চিকিৎসক ও তাঁদের পরিবার এবং বিদেশি অতিথিদের মুহুর্মুহু করতালিতে ও উচ্ছ্বাসে আমি সিক্ত হই। তখন অনেকেই আমাকে অনুরোধ করেন কেন আমি দেশে আন্তর্জাতিকমানের একটা মাইম ইনস্টিটিউট তৈরি করছি না! যা হতে পারে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একমাত্র ইনস্টিটিউট। এখানে উল্লেখ্য যে আমি প্রথম এশিয়ান যে মারসেল মার্সোর কাছে প্রথম কাজ করার বা ছাত্র হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। এর আগেও যতবার দেশে গেছি অনেক মানুষই আমাকে একই কথা বলেছেন। আমিও ভাবলাম, কেন নয়? মার্সো আর এই পৃথিবীতে নেই তাঁর কাছ থেকে ও তাঁর স্কুল থেকে সারা জীবন পরিশ্রম করে যা শিখেছি তা যদি নিজ দেশের কিছু ছেলেমেয়ের মধ্যে রেখে যেতে পারি এই অতি প্রাচীন ও একই সঙ্গে আধুনিক এই শিল্প বেঁচে থাকবে চিরদিন। যার দ্বারা উপকৃত হবে আমাদের নতুন ও বর্তমান প্রজম্ম। তারা উপকৃত হবে প্রথম তাদের দৈহিক গঠনে, সাংস্কৃতির প্রতিটি কর্মকাণ্ডে বিশেষ করে যারা নাটক, যাত্রা, নাচগান, চলচ্চিত্রে অভিনয়, মডেলিংয়ের সঙ্গে জড়িত। মাইম বা মূকাভিনয়কে বলা হয় সব পারফরমিং শিল্পের আদিরূপ বা ভিত্তি। আর একটা চিন্তাও মাথায় ছিল আমার। তো বয়স হচ্ছে এই শিল্পের জন্য দরকার শারীরিক ফিটনেসের, যা ভবিষ্যতে আমার পক্ষে হয়তো ধরে রাখা সম্ভব নাও হতে পারে। গত সাড়ে চার বছরের অক্লান্ত চেষ্টায় আমি একটা ইটও গাঁথতে পারিনি। আমি দেশে গিয়ে নিজ খরচায় দিনের পর দিন থেকেছি। আমার পরিচিত সরকারি ও বেসরকারি সব জায়গাতেই আমার পরিকল্পনার কথা মৌখিক বলেছি ও লিখিত দিয়েছি। সবাই আমাকে শতভাগ আশ্বাস দিয়েছেন কিন্তু শক্ত দেয়ালকে আমি ঠেলে সরিয়ে আশার কোনো আলো দেখতে পাইনি।২৩.৯রাষ্ট্রীয় সম্মান ‘একুশে পদক’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে নিতে আমি যেতে পারিনি ফ্রান্সের অন্য শহরে একই সন্ধ্যায় আমার শো থাকার কারণে। কিন্তু আমি আমার পেশাগত সব কাজ বাদ দিয়ে এই সাড়ে চার বছরে নিজ দেশে বারবার গেছি। ঢাকায় বসে না থেকে সারা দেশের বিভিন্ন গ্রুপ থিয়েটার অলিয়ঁস ফ্রঁসেজের আমন্ত্রণে বরিশাল, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, পাবনা, রংপুর, ফরিদপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, যশোর মাইমের ওয়ার্কশপ করতে ছুটে বেড়িয়েছি বিনা পারিশ্রমিকে। সারা দেশে যে সাড়া আমি পেয়েছি এই শিল্পটি সঠিকভাবে শেখার জন্য তাতে আমি অভিভূত। আমার দ্বারা সামান্য যেটুকু হতে পারত একটি আন্তর্জাতিক মানের ‘মাইম’ ইনস্টিটিউট। যেখানে ছাত্রছাত্রীরা শুধু মাইমই শিখবে না, তারা একই সঙ্গে শিখবে দেহকে ভালো রাখার সব ধরনের কলাকৌশল। আসল কথা শরীরটাকে ভালোবাসতে শিখতে হবে। যেদিন শরীরটা ভালো থাকে না সারা পৃথিবীর সব আনন্দ সেদিন বিষাদ লাগে। এই কথাটি আমি হয়তো যাঁদের সামর্থ্য আছে, তাঁদের বোঝাতে পারিনি সঠিকভাবে। আমারই অক্ষমতা। তবুও আমি প্রতিদিন নতুন সূর্য উদয়ের সঙ্গে সঙ্গে স্বপ্ন দেখি। ‘স্বপ্নের পর স্বপ্ন’ নিয়ে জাল বুনি।’২৪.এবার পাখির চোখে কিংবা একনজরে ‘দ্য লিভিং লিজেন্ড’ পার্থপ্রতিম মজুমদারজন্ম : ১৮ জানুয়ারি, ১৯৫৪, পাবনার কালাচাঁদপাড়ায়বাবা : হিমাংশু কুমার বিশ্বাস,মা : সুশ্রিকা বিশ্বাসস্ত্রী : জয়শ্রী (ঝুমু)সন্তান : পুত্র সুপ্রতিম ও মেয়ে দোয়েল।পড়াশোনা : পাবনার জুবিলী স্কুল, কলকাতার ড. শীতল প্রসাদ ঘোষ আদর্শ বিদ্যালয়, ১৯৬৬ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত কলকাতার যোগেশ দত্ত মাইম একাডেমিতে মূকাভিনয়ের ওপর শিক্ষা গ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালে ভারতের চন্দননগর থেকে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত ঢাকা মিউজিক কলেজ থেকে স্নাতক হন। ১৯৮১ ও ১৯৮২ সালে মডার্ন কর্পোরাল মাইমের ওপর ইকোল দ্য মাইম নামে এতিয়েন দ্যু ক্রুর কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেন। এর পর ১৯৮২ সাল থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত মারসেল মার্সোর কাছে ইকোল ইন্টারন্যাশনালি দ্য মাইমো ড্রামা দ্য প্যারিসে মাইমের ওপর উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করেন।কর্মজীবন : ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি) প্রথমবারের মতো মূকাভিনয় প্রদর্শন করেন তিনি। পরবর্তীতে ১৯৭৫-১৯৮১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায় ৪৮ বার মাইম প্রদর্শন করেন। ১৯৮২-১৯৮৫ সালগুলোতে তিনি প্যারিসের বিভিন্ন থিয়েটারে মোট ২৬টি শো করেন। এ ছাড়া লন্ডনে ২টি, গ্রিসে ২টি এবং স্পেনে মাইমের ২টি শো করেন। এর পর তিনি পৃথিবীর বহু দেশে মূকাভিনয় প্রদর্শন করেছেন। তিনি মঞ্চের পাশাপাশি ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডার বিভিন্ন চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন। তার অভিনীত একটি ফরাসি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ২৬টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার পায়। তিনি ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন, নাইকি, আইবিএম ও ম্যাকডোনাল্ডের মতো বিশ্বখ্যাত কোম্পানির পণ্যের প্রচারে মডেল হিসেবেও কাজ করেছেন।পুরস্কার ও সম্মাননা : কলকাতা যোগেশ মাইম একাডেমি থেকে মাস্টার অব মাইম (১৯৮৭), একুশে পদক (২০১০), ফ্রান্স সরকারের শেভালিয়র (নাইট) উপাধি (২০১১), বাংলা একাডেমি ফেলোশিপ (২০১৪) উল্লেখযোগ্য।(অকৃপণ ঋণ / তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া, গুণিজন, দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা, দৈনিক প্রথম আলো, দৈনিক ভোরের কাগজ, দৈনিক জনকণ্ঠ, দৈনিক সমকাল, দৈনিক যুগান্তর, ইন্টারনেট)আবদুল্লাহ আল মোহন১৮ জানুয়ারি, ২০১৬ / ১৮ জানুয়ারি, ২০১৭/ ১৮ জানুয়ারি, ২০১৮

শেয়ার করতে এখানে চাপ দিন

সর্বশেষ খবর